CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




কাহিনী ও কবিতা




উষাহরণ কাব্য

(অসম্পূর্ণ)

[উষাহরণ কাব্যের পৌরাণিক কাহিনী: দৈত্যরাজ বাণ শিবের উপাসক ছিলেন ৷ উপাসনার দ্বারা তিনি শিবকে তুষ্ট করেন ৷ শিব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে বাণের বিপৎকালে তিনি বাণকে রক্ষা করবেন ৷ বাণের কন্যা উষা কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের রূপে আকৃষ্ট হয়ে তার সহচরীর সাহায্যে অনিরুদ্ধকে দৈত্যপুরে নিয়ে আসেন এবং গােপনে গন্ধবর্মতে তাকে বিবাহ করেন ৷ বাণরাজা এই বিবাহের কথা শুনে অনিরুদ্ধের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং যুদ্ধে অনিরুদ্ধকে দারুণভাবে পরাস্ত ও বন্দী করেন ৷

অনিরুদ্ধের মুক্তির জন্যে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বাণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন ৷ এই যুদ্ধে বাণ সম্পূর্ণ রূপে পরাস্ত হলে তিনি কৃষ্ণের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ৷ অতঃপর কৃষ্ণের দয়ায় মহাকাল নামে বিখ্যাত হয়ে শিবের অনুচরবর্গের মধ্যে গণ্য হন ৷ – স]


প্রথম কাণ্ড

(কোকিল নাম প্রথম সর্গ)

গাও পুনঃ হে কোকিল যে গান গাহিয়া
আসীন পুষ্পিত বৃক্ষে পাখি-রূপে বিধি
ত্রিদিবে বিরােধ-দাহ, মহাযুদ্ধ মর্ত্যে
ঘটাইলে কুহরিয়া ফুলের আড়ালে
করিল যে বেলা স্নান দৈত্যবালা উষা
কুসুম-শয়ন ত্যজি দিব্য বাণপুরে ৷
উঠিয়া অনুঢ়া বালা হেরিল বাহিরে
প্রাতঃকালে প্রস্ফুটিত কোকনদ সরে,
হেরিল অরুণ শােভা, খেলিছে বিটপী
তরুলীলা, দেখাইছে লুক্কাইছে হাসি
সূর্যের তরুণ আলাে ৷ সমীরণ ধরি
গুঞ্জরিছে পুষ্পদলে শিশির লভিয়া,
মধু কুহরিছে পিক ৷ মধুময় স্বরে
কুহরিলে, দৈত্যবালা, সখীগণে ডাকি ৷
“উঠ, চারুনেত্রা, প্রিয় সখি, ওই হের
সুন্দর পৃথিবী উঠি নাহিছে শিশিরে ৷
নীরস পূর্বাহ্ন নিদ্রা ৷ আয় ইচ্ছা করে
যাই নাহি দ্রুত জলে যেথা শৈবলিনী
অযুত-তরঙ্গ-স্বরা ৷
তীর-ফুল-দল বহি নিৰ্ম্মল সলিলে
ছুটে চারু উপবন চুম্বনে শীতলি ৷”
শুনিয়া সে প্রিয় বাণী নাগরাজবালা
যেন কোকিলের কুহু সুদূর নিকুঞ্জে
আইল অলসগতি ৷ এখনাে রহিল
বিশাল নয়নে নিদ্রা যেন পুষ্পে রেণু
কুমারী রুচিরাননা চারুনেত্রা চারু
নাগরাজকন্যা ৷ তারে প্রথম বয়সে
উদ্ধৃদুর্গ নাগপুর ভস্মসাৎ করি
যেন জয়ধ্বজা রথে বাণ মহাবাহু
আনিল সদর্পে ৷ পূর্ণ যৌবনে রূপসী
উষার চরণ সেবে দাসী নাগবালা ৷
বিংশতি কুমারী আসে উষার স্বজনী,
ভগিনী আইল সঙ্গে চন্দ্রলেখা চারু,
মন্দগতি, রাজকন্যা কিন্তু দাসীগর্ভে ৷
ছিল নদীকূলে বন, রচেছে শ্রমিয়া
বিখ্যাত দানব শিল্পী পাণ্ডবের সভা
যার খ্যাতি ইন্দ্রপ্রস্থে ৷


“দারুণ যদিও দুঃখ এস মাতা সহি ৷
সহিল শঙ্কর দক্ষনন্দিনী বিহনে
প্রাণহীন দেহ স্কন্ধে ক্ষিপ্ত-মনে বহি ৷”
কিন্তু রতি পুষ্পমাতা রহিল অভাগী
নীরব নিরঞ দীন ভস্ম ধরি কোলে ৷
আইল মধুর বাণী ছিন্ন বীণা করে ৷
“এস দীপ্তিময় ভবে, ফিরে এস রতি ৷
শুষ্ক পদ্ম, মৃত পাখি তােমার বিহনে,
মানব-হৃদয় মরে ৷ প্রাণ কাদে, বাছা,
তমঃ-পূর্ণ দ্বেষগীতি দিনরাত শুনি,
মাধুরী-রহিত ভাষা, কামের অসহ্য
ছন্দ ৷ অবিচারে দুঃখ দিয়াছে বিধাতা,
সহি এস, মহাদেবী, বিশ্বহিত ভাব ৷
নিজদুঃখ বিশ্বসুখে পরিণত করে
কবিগণ, মানব যাহারা ৷ সমুজ্জ্বল
কবিতা বিস্ময়ে হেরি ধন্য বলে লােকে ৷
জানে না অবােধ প্রজা হৃদয়ের রক্তে
উজ্জ্বল কবিতা ৷ যার নিঃস্বার্থ আয়াসে
বিশ্ব-সুখ-আশা বৃদ্ধি, দুঃখই মহিমা
সে জনের, বাছা ৷ এস, পুষ্পমাতা, এস,
কাব্যপ্রাণ জাগাইয়া নিৰ্বাপ দঃখাগ্নি ৷”
কিন্তু রতি পুষ্পমাতা রহিল অভাগী
নীরব নির দীন ভস্ম ধরি কোলে ৷
আইল নারদমুনি জগতের স্নেহী ৷
“এস আলােময় ভবে, ফিরে এস, রতি ৷
শুষ্ক নদী, শুষ্ক তরু ৷ নিরানন্দ এবে
পত্রময় কুহরিত আশ্রম, শীতল
তরুচ্ছায়া, মঞ্জু-সলিলা আশ্রম-নদী ৷
দিশাহারা ঋষিগণ মরুভূমি ভবে ৷
অসহ্য বিরহ-জ্বালা এস মাতা সহি ৷
মহামতি ঋষিগণ তব সুখ-আশে
নব প্রাণ দিবে সৃজি নূতন কন্দর্পে ৷”
কিন্তু রতি পুষ্পমাতা রহিল অভাগী
নীরব নিরঞ দীন ভস্ম ধরি কোলে ৷
চাহিল বৈকুণ্ঠবাসী ধরাপানে বিষ্ণু ৷
মুমূর্ষ সুন্দর ধরা টলিছিল শূন্যে
উচ্চরব চারিধারে, যেন ধূম্র ব্যাপি
তমঃ ঘনীভূত ভবে ৷ ভীমছায়া রূপী
মহাতনু প্রকাশিয়া উঠিছে কৃতান্ত ৷
বাড়ি’ ভীত খমণ্ডলে নীরব ভীষণ
নামিল অনাদি বিষ্ণু হিমস্তব্ধ দেশে ৷
ঘােষিল অনন্ত শন্য দেবের স্মরণে,
হিমাচল পদস্পর্শ টলিল নির্ঘোষি ৷
যােগমগ্ন ব্যোমকেশে সম্বােধিল হরি ৷
“শিব একচারী যােগী, নির্জন পর্বতে
আসীন নিঃশ্বাসে সৃজ, নিঃশ্বাসে সংহর
অগণন বিশ্ব ধ্যানে, সৃষ্টিধ্বংসকারী ৷
মুহূর্তের প্রাণীহিত ভাব না মহত্ত্বে
অন্ধ ৷ হের, মহাদেব, নয়ন উন্মীলি!
যমাধীন প্রাণী যেথা বধিলে মদনে
জগতের মধপ্রাণ ৷ হবে অবিলম্বে
নিশ্চল এ ব্ৰহ্মরথ সারথি-বিহনে ৷
তার তব সৃষ্টি, শম্ভু, বাঁচাও মন্মথে ৷
নাশে পুনর্জন্ম 1 এই অচল নিয়মে
রহে পুরাতন 2 সৃষ্টি চিরকাল নব ৷
অনন্ত-যৌবনধারী ৷ স্থিরতা নিয়মে ৷
অস্থির প্রপঞ্চ মধ্যে বিনা লক্ষ্যে ভ্রমি
নিয়ম ধরি ক্ষুদ্র প্রাণীজাতি ৷”
শিব একচারী যােগী উত্তর করিল ৷
“জানি আমি, দয়াসিন্ধু, অচল নিয়মে
অনন্ত যৌবনে নব পুরাতন সৃষ্টি ৷
জানি আমি বদ্ধমূল নশ্বর মানবে
অনন্ত পরব্রহ্মের এ মহতী লীলা ৷
কামবন্ধ পৃথিবীর মধুলুব্ধ নরে
কামে কাম জিনি লভে নিষ্কামতা শেষে ৷
জানি মধুপ্রাণ এই বিশ্বের কন্দর্প ৷
নিজদোষে, নারায়ণ, মজিল ফুলে
অসময়ে তীর হানি অনুচিত লক্ষ্যে ৷
তথাপি বাঁচিবে পুনঃ ৷ অসুর, রাক্ষস
নিষ্ঠুর অশাম্য ক্রোধ দীর্ঘকাল পুষে ৷
প্রাণে ৷ বৈর-নির্যাতনে, শত্রু-পরিতাপে
সীমা আৰ্য্য-অমর্ষের ৷ ক্ষমিনু মদনে,
বিষ্ণু ৷ অবতরি তুমি যশস্বী দ্বাপরে
জন্মাইও লক্ষ্মীগর্ভে আবার ফুলেশে ৷
ততদিন মুক্ত ভ্রমি অদৃশ্য অনঙ্গ
বিস্তারিবে পুনঃ জগে মধুর মিলন,
বিবাহের মধুকৃতি পুনঃ মর্ত্যধামে ৷
কহিল মহাত্মা ৷ বিশ্বে কাপাইল উক্তি ৷
গেল দয়াসিন্ধু জিষ্ণু অনাদি তিমিরে,
কুপিত বসন্ত মাতা ধূলায় আসীনা
যেথা একাকিনী মৌনী অন্ধকার দেশে ৷
কুন্তলে বুলায়ে হাত উঠাইল বিষ্ণু ৷
মুক্ত হল অরােধ স্পর্শে, কণ্ঠ মুক্ত
করুণ ৷ কাদিল রতি পিতার চরণে ৷
“কেন আসিয়াছ, তাত ৷ বৃথা কি আইলে
সেথা নিতে পুনঃ মােরে, অভাগী অপ্রিয়া
আলােময় ঘৃণ্য ভবে ৷ যাব না এ জন্মে ৷
মরিছে কি বিশ্বতাপে দেবেরা ৷ মরুক,
কৃতঘ্ন নির্দয় তারা, স্বদোষে, ভুলিয়া
কি উচিত দেবতার ৷ যাইব না কভু
উদ্ধার করিতে ৷ আমারেও কি করিল
উদ্ধার উহারা? যাব কি প্রবােধে? কোথা
শুভকৰ্ম্ম-প্রতিফল, কোথা ন্যায্য রীতি ৷
কোথা এবে দৃঢ় বিধি অজেয় অচল?
অবিচার অসম্বাধে সেথায় বিরাজে ৷
যমাধীন প্রাণী যথা বধিল প্রাণেশে ৷
শিব ধ্বংসকারী ৷ দেব-মন তুষিবারে
মরিল করুণ রূপে ৷ করে না তাহারা
উদ্ধার, হেরে না ফিরে একবার চাহি ৷
নিজ প্রাণ লয়ে গেল কাপুরুষ যত
করুণ শরীর ফেলি ৷ অকালে মরিল
একাকী অবিলাপিত দূর হায়! হিমে ৷
আমিও পুরাণ দেবী, কন্যা তব, পিতা,
তথাপি বিধবা ৷” এই অর্থে পুষ্পমাতা
বিলাপিল মুক্তকণ্ঠে পাদযুগ ধরি ৷
নারায়ণ দয়াসিন্ধু উত্তর করিল ৷
“বাছা, অকারণে কষ্ট দিয়াছে বিধাতা ৷
তুমি সুখপ্রাণা দেবী, দুঃখ দেয় তােরে
কৃতঘ্ন জগৎ ৷ লেগেছে কোমল প্রাণে
কঠিন আঘাত, দেবী ৷ কুপিত বসিলি
জগৎ ঘৃণিয়া দুঃখে, কে নিন্দিবে তােরে ৷
বৎস, শ্রেষ্ঠ তবে ক্ষমা, দেবচিহ্ন ক্ষমা ৷
ক্ষমা-কান্তি নয়নে দেখায় বলবান ৷
দেবসম মর্ত্যে ক্ষমি উদ্ধত দুৰ্ব্বলে ৷
অভিমানী মন দম, বসন্তের মাতা
দ্বিগুণে মধুর সুখ গত দুঃখ স্মরি,
সে সুখের আশে প্রাণ জুড়াও ৷ হইবে
কন্দর্প-মিলন পুনঃ প্রত্যক্ষ কন্দর্পে ৷
এস দীপ্তিময় ভবে, ফিরে এস, রতি ৷
বসন্তে জাগাও পুনঃ নিৰ্ব্বসন্ত জগে ৷”
ফিরিল জননী ভবে ৷ সফল হইল
যুগসম্পূরণে উক্তি পরযুগ-শেষে ৷
জন্মিল রুক্মিণী গর্ভে সাক্ষাৎ মদন
কৃষ্ণের ঔরসে যােদ্ধা প্রদ্যুম্ন ৷ জন্মিল
অনিরুদ্ধ রতিগর্ভে বালক সুধন্বী
মধুর মিলন-সুখে কৃষ্ণপৌত্র যােদ্ধা ৷

এই অর্থে ভগিনীর সুচারু চরণে
সুপ্তা, মধুময় ধ্যানে সমুজ্জ্বল আঁখি
উর্বশী গাইল ৷ তার হৃদয় জুড়িল ৷
ভাসাল ভাবের পুরে পুরাণ কাহিনী ৷
কৃষ্ণকেশভার-সেবা করপদ্ম ভুলি ৷
নিষ্কর্মা রহিল ভূমে ৷ হেনকালে অগ্নি
স্বর্গ লিপি-বহ আসে সুগন্ধ প্রসারি ৷
উঠিল সত্বরে দেবী ক্ষুব্ধা ৷ কেশজাল
বন্ধচ্যুত পড়ে কঁাধে, শিথিল বসন
শুভ্র-কুচযুগে যেন অঙ্গুলি জ্যোৎস্নার
বহুল চম্পকে ৷ সন্তান হঠাৎ যদি ডাকে
স্থান কি আত্ম-চিন্তার জননীর প্রাণে ৷
“আয় নামি মােরা দৈত্যনগরে, সহজা ৷
শৈলবালা, প্রিয় হাতের অক্ষর চিনি,
ডাকিতেছে মােরে ৷ প্রাণ অস্থির শঙ্কায়
কি দুঃখে কি ভয়ে মােরে ডাকিল নন্দিনী ৷
উদ্ধত দৈত্যেরা সদা স্বেচ্ছাপ্রিয় গর্বে,
অত্যাচারী দৈত্যরাজা বাণ মহাবাহু ৷”
নামিল আকাশ-পথে দেবীদ্বয় ৷ নভে
জ্বলিল রাতুল আভা বিদ্যুৎ-আকৃতি,
অপ্সরার চারু-অঙ্গ ভাসিল অম্বরে ৷
নবফুল ফুটাইল রাঙা-পদ-স্পর্শে
উল্লাসে ধরণী ৷ রম্য শােণিত-নগরে
অকস্মাৎ আলােকিত সে আঁধার কক্ষ
অপার্থিব রূপে ৷ নিল নন্দিনীরে কোলে
চিত্রলেখা ৷ দিব্য হাসি অমর বদনে
পয়ােধরে ফুলগাল চাপিল জননী ৷
মাতার পবিত্র স্তনে দুগ্ধধারা বহি ৷
তিতিল কপােল ৷ সুরভি কুন্তল চুম্বি
কহিল সমুদ্রকন্যা ৷ “কেন, শৈলবালা,
ডাকিলি আমায় ৷ সুখে তনয়া আমার
প্রতিদিন দেখি দিব্য চক্ষু খুলে ৷ আজি
হঠাৎ কি দুঃখ তাের, কি অভাব প্রাণে,
শৈলবালা? কি ন্যূনতা জননীর স্নেহে
রৈল যে অপূর্ণ আশা কন্যার হৃদয়ে ৷”
মাতৃকণ্ঠ বাঁধি বালা শ্বেতভুজ-পাশে
মনােহর শির তুলি মাতৃ-স্তন হতে
কহিল সুস্মিতা ৷ “সেই অতীতের কথা
বলি আজি ৷ বস খাটে ৷ বাল্যকালে, মাতঃ,
শুইনু যেমতি কোলে, আজিও শুইব ৷
‘চাই পারিজাত-পুষ্প, স্বর্গের সলিল
স্নানে, দেহ মােরে, মাতা, জীবন্ত পুত্তলী,
এইরূপে পীড়ি তােমা শবার দিনে
চাইনু অদেয় যত ৷ আজিও চাহিব ৷
বস হেথা ৷ নাহি দিলে দেখিব প্রভাব,
অপ্সরার গর্ব ৷ বিনা লাভে ঈঙ্গিতের
দিব না উঠিতে তােরে ৷ তুমিও হেথায়
বসিও, উৰ্ব্বশী মাতঃ, সােনার পালঙ্কে ৷”
কহিল সস্নেহে দেবী, “জান, কুহকিনী,
তব আজ্ঞাবহ দাসী মাতা ৷ এক আশা
অপূর্ণ রইলে প্রাণপুত্তলী-হৃদয়ে
নিষিদ্ধ অমরা-ভূমি মাতৃচরণের,
লুপ্ত পারিজাত মালা অভিশপ্ত শিরে ৷”
আরম্ভিল শৈলবালা ৷ “বাল্যকালে আমি
তব স্বর্গসম ক্রোড়ে আশ্রিতা পাইনু
চিত্রসিদ্ধি ৷ সহজে পাইনু, শিশু যথা
মাতৃদুগ্ধ স্তনে ৷ আসে আপনি প্রতিভা,
শিশুর নয়ন খুলে, শিশুর অঙ্গুলি
ধরি যত দৃশ্য জগে আঁকায় মােহিনী ৷
স্বয়ং অল্পই পারে বহুল আয়াসী
মানব, নিস্তেজ গুণ বদ্ধ অন্নকোশে ৷
বিমুক্ত দেবের স্পর্শে কি না পারে প্রাণী ৷
অধীন হইল মাের যত রম্য মূর্তি
মাধুরী রচিয়া ব্রহ্মা সৃজিলা সুক্ষণে ৷
স্মরিলে অঙ্গুলিপথে দাড়াত আসিয়া
পূর্ণমূৰ্ত্ত চিত্রপটে ৷ স্বচ্ছতােয়া নদী,
হংসমালা নাচি স্রোতে, বহিত সম্মুখে ৷
ক্ষণপ্রভা মেঘকোলে হাসিত সহসা
মাের ক্ষুদ্র গৃহে ৷ মহীয়সী গিরিমালা
দাড়াত কল্পনা দ্বারে, নীরব তপস্বী
আসি যেন আশ্রমের দ্বারে – উচ্চশির,
হিমশুক্ল জটাজুট পলিত মস্তকে ৷
ঊৰ্ধ দৃষ্টি মন সদা মানবের ৷ উচ্চে ৷
উঠিলে অতৃপ্ত যদিন না উচ্চতমে
আরােহণ ৷ কোলে তব কাদিনু পড়িয়া ৷
‘অতৃপ্ত হৃদয়, মাতা, তৃষ্ণাতুর নিতি
পিঞ্জরে যেমতি পাখি বাহিরে হেরিয়া
স্বাধীন সঙ্গীরা ভ্রমে সূর্যের আলােকে
কাদে ইতস্ততঃ উড়ি ৷ জুড়াও এখনি
প্রাণ মম, মাতা ৷ সস্নেহে তুলিয়া মােরে
কহিলে ঈষৎ হাসি ৷ চারু শৈলবালা,
চিত্রলেখা নামে ডাকে অবতার ভাবি
লােকে, প্রসারিছে কীর্তি ৷ নহে পরিতৃপ্ত
মানব-হৃদয় তব বুকে ৷ জানি মন,
শৈলবালা ৷ অসীম সিন্ধুর ওই পারে
ছুটি মানবের মন আগুসরে সদা ৷
পৃথিবীর সীমা ত্যজি অনন্তে উজ্জ্বলি
তারা সম ভ্রমে দিগমণ্ডল মাপিয়া
উড়ি মহাবল পক্ষে ৷ শেষে বাহিরায়
মূৰ্ত্ত জগতের ধারে যেথা থামে দৃষ্টি,
যেথা ভীম অন্ধকার বিধিয়া বিধিয়া
মূৰ্ছিত মনের চক্ষু অধেয় তিমিরে ৷
পৃথিবীর অন্ধকার সেথা হয় দীপ্তি,
পারহীন লক্ষ্যহীন তলহীন সিন্ধু ৷
তবে নহে ভীত নর ৷ নিজ তেজে জ্বলি
চলিল অজেয় আত্মা অসীম আধাঁরে ৷
স্বর্গ সার-বিদ্যা-দীক্ষা নিষিদ্ধ মানবে,
বাছা ৷ নহে নিষিদ্ধ সাহস নর-প্রাণে ৷
সিন্ধু-স্বর্গ-ভূমি আছে অগম্য সমুদ্রে,
অদ্ভুত দেবতা নিত্য সে দারুণ স্থলে
নিবাসী মুদিত সদা ৷ মাথার উপর
ঘােষে অবিশ্রান্ত নাদে ধাবমান সিন্ধু,
কোটি তরঙ্গের ভারে চেপেছে জলধি ৷
সেথা ক্রুদ্ধ মহােৰ্ম্মির ভীম কোলাহলে
হরষি নিবাসে একা ভীষণ সমুদ্রে ৷
উগ্রচণ্ডা জলদেবী সিন্ধুতলে3 ধরি
কুবের ঐশ্বর্য দর্পে গহ্বরে রমিয়া
সেই ভয়ঙ্কর গর্ভে সন্তান কিন্নরে
জন্মাইল পুরা যুগে মহাবলী ৷
ছিল না তখন মাতা শ্যামলা পৃথিবী,
ছিল না নীলিমা নভে ৷ ধাবিত চৌদিকে
অসীম জলধি ঘােষি নিরাকার শূন্যে ৷
সপ্তসিন্ধু সপ্তদ্বীপে ত্রিদিবে পাতালে
আছে যাহা না জানে কিন্নর শলভী ৷
কিন্তু শতবিদ্যা মধ্যে ভালবাসে একা
চিত্রবিদ্যা ৷ জগতের যত রম্য মূর্তি
নিসর্গ-মাধুরী জিনি মনের মাধুর্য্যে
কল্পনা আরােপি সত্যে প্রতিভা-ক্রীড়ায়
রঞ্জে ৷ তার বর বিনা নাই চিত্রে সিদ্ধি,
তার বরলাভে হয় মৰ্ত্ত ইন্দ্রপুরী ৷
উগ্র অনারাধ্য কিন্তু লুক্কায় সে ভূমি,
উচ্ছলে অগম্য নাদে ভয়ঙ্কর সিন্ধু
শত-ফেনা তুলি নভে ৷ গগন সমুদ্রে
ভয়পূর্ণ সেই পথ অস্পৃশ্য দুর্বল ৷
মানব চরণে ৷ স্থলে ধরিয়া, নন্দিনী,
অমরের হস্তসিদ্ধি চাহিবে আলেখ্যে,
ভুলিবে না শত স্তুতি – না অন্য দানে
মুক্তি-মূল্য তার ৷ যখন মধ্যাহ্নে
নীলিমায় মিলাইয়া অবিরাম ঊর্মি ৷
বায়ুহীন নিদ্রা লভে বিশাল সাগরে,
সুন্দর উজ্জ্বল দেবত্বদর্পে উঠিয়া
অতল সমুদ্র হতে আসীন একাকী
মহাসিন্ধু পানে চাহে সুরম্য সিংহলে ৷
প্রস্তরে তরঙ্গলীলা চড়ে পড়ে, ডাকি
উঠিছে, পড়িবে ডাকি ৷ সুগম্ভীর নাদে
মহৎ সমুদ্র বহে, – দেবতার গতি,
পদধ্বনি ঘােষাইয়া শিলাতে শিলাতে ৷
সেথা বসি চিত্র রঞ্জে, অন্তে মহাবেগী
সৌন্দৰ্য্য ছড়ায়ে ডােবে অতল সলিলে ৷
গাঁথিয়া মৃণাল-রঙ্কু গঙ্গাতেজ পূরি –
নাই অন্য সূত্রজালে বাঁধিবার শক্তি
বলবান দেবে – সিন্ধুশিলা-অন্তরালে,
মৃগয়ার যথা রীতি উত্তর পর্বতে
সিন্ধুসিংহ-পথ যবে বসেছে রুধিয়া
শূলধর হিমানীর দেশে; উচ্ছ্বসিয়া
মহারােলে উঠে সিংহ, হঠাৎ সবেগে
শূল ফেলি বিঁধে তারে – লুক্কাও আড়ালে
পাশপাণি ৷ উঠি যবে কিন্নর শলভী
জলধি ত্যজিয়া দীপ্ত জল-ফোয়ারা যেমতি
শৈলে, পাশ অস্ত্র ফেল, জটিল বন্ধন
স্পৃহনীয় প্রতি-অঙ্গে পাকাও, নন্দিনী,
অভিভত গঙ্গাতেজে দিবে মহামতি ৷
সৰ্বস্ব বিদ্যার ৷ দিব্য বলাইয়া শেষে
ছাড় ৷ সাবধান, বালা, বাক্যচ্ছলে ভুলি
বিপদে যেন না পড় কিন্নরের বশে ৷
দাসী তার রবে হৃতা অতল সমুদ্রে ৷
অশেষ শঠতা জানে কিন্নর শলভী ৷ ”
ঘিরিল মহতী আশা হৃদয় উত্থালি
এ কথায় ৷ মন্ত্রগীতি শুনিনু অম্বরে ৷
আপনি না বুঝিলাম মধুর গুঞ্জরি ৷
কেন সুখস্বপ্নসম আসিয়াই যায়
অস্পষ্ট কল্পনা ভাসি প্রাণের তিমিরে ৷
স্বর্গের দুকূলে দেহ আচ্ছাদিয়া মােরে
সনাতন গঙ্গাতীরে আনিলে, জননী ৷
গাঁথিনু মৃণাল-তন্তু মন্ত্রবল পূরি
মাতৃ-শিষ্যা তীরে ৷ সূক্ষ্ম অতিশয় রঞ্জু,
দেবের অদৃশ্য যার অমর নয়নে
ভেদ্য তলহীন সিন্ধু যেন ক্ষুদ্র নদী ৷
শৈলে এ কৌশল পাতি সমুদ্রের তীরে
আড়ালে লুক্কায়ে দেহ রহিনু বসিয়া
শিহরি আশায় ভয়ে ৷ যে বেলা পড়িল
অনন্ত সাগরে শ্রান্ত অবিরাম উৰ্ম্মি,
উজ্জ্বল সহসা জল-ফোয়ারা যেমতি
নিদ্রিত জলধি ত্যজি কিন্নর উঠিল
প্রকাশি সৌন্দৰ্য্যরশ্মি যেন তারা নভে
খসিয়া আলােকটানে আকাশ উজ্জ্বলি ৷
সৌন্দৰ্য হেরিয়া প্রীতি উথলিল মনে ৷
প্রজাপতি গ্রীষ্মে অগণন-বর্ণ-কান্তি
উড়ন্ত কুসুম যথা ধাঁধায় নয়ন
বালক আকৃষ্ট লােভে ধরিতে তাহারে
যায় ধেয়ে সেই ভাবে ধাইল হৃদয় ৷
সে কান্তির পানে ৷ লােভ দমিলাম লােভে ৷
বসেছে কিন্নর সিন্ধুশিলায় ৷ বিলীন ৷
দৃশ্যে সে মহৎ বুদ্ধি, জলধির নাদে
বিলীন ৷ হেরিনু তার বিশাল দীপিত
অপার্থিব আঁখি অসহনীয় মাধুর্য্যে
পূর্ণ ৷ শিহরিনু ভয়ে, শিহরিনু প্রেমে ৷
হৃদয়ে ভরিল আসি সাহস দেবতা ৷
হঠাৎ আনন্দে হাসি কৌশল-গৰ্বিণী
মন্ত্রপূর্ণ গঙ্গাতেজে মহাজাল-রাশি
ফেলিয়া সুচারু অঙ্গে হর্ষে প্রেমে মাতি
পাকাইন বারবার ৷ ভীত, হাসি’ ক্রোধে
টানিল দুর্দম্য হস্তে উদ্ধার-উদ্যোগী
যক্ষ ৷ জোরে যদি টানে বলীয়ান বৃথা,
আরও জড়ানু ভয়ে অলংঘ্য বন্ধনে ৷
অবশেষে মধুহাসী কিন্নর পরাস্ত
কহিল, “কে তুই ধন্য, মহামতি বালা,
কোথা হতে বা যশস্বী সাহস শিখিলি
অবলা রমণী হয়ে? কোন জন্মভূমি
গর্বিতা বীৰ্যপীড়িতা প্রসবি সুক্ষণে
এই রূপ জন্মাইল, এ উদার বুদ্ধি ৷
উচ্চলােভী তব মন জানি, আবালা ৷
অদেয় স্বর্গের বিদ্যা, তবে দিনু তােরে ৷
পালায় সৰ্ব্ব নিষেধ সাহস-দর্শনে ৷
শূরত্ব শেখর ৷ যায় স্বর্গে সেই পথে ৷
সাহসে লভয়ে ভক্ত বাঞ্ছিত চরণ,
সাহসে নির্বাণ জ্ঞানী ৷ বিক্রয়-নিয়মে
চিত্রবিদ্যা দিব তােরে, পণ্য যেইরূপ
তত মূল্যে ৷ তুমি মূল্য, স্পৃহণীয় বালা ৷
এই সুললিত শির, যৌবনের মদ্যে
ভরা দুই পয়ােধর, এই শুভ্র দেহ ৷
যেন বহ্নি বস্ত্রে, এই রাতুল চরণ ৷
চাহি, শৈলবালে ৷ ওহে পূর্ণ কর বাঞ্ছা
মহাসুখ লয়ে তােরে ভুঞ্জি, স্পৃহণীয়া
ললিতা রূপসী বালা, ভুঞ্জি লয়ে তােরে
প্রেমস্বর্গভােগ কোলে প্রেমধন-পতি ৷
দে তুই দুর্লভ প্রেম, চিত্রবিদ্যা দিব ৷”
গঙ্গাতেজে অতিশয় যাতনা ভুগিল
কিন্নর, ছাড়ে না তবে শাঠ্য শঠহৃদি ৷
বাক্যচ্ছলে ভুলি, অন্ধ কামনায় সাধে
অবােধ! খুলিনু রঞ্জু আদেশ বিস্মরি ৷
তৎক্ষণাৎ ধরে উঠি অনিবাৰ্য ভুজে
হর্ষে মােরে সিন্ধুবাসী কিন্নর হরিল
অতল সমুদ্রে ডুবি ৷ কম্পমান অঙ্গে...


দ্বিতীয় কাণ্ড

(সভানাম অষ্টম সর্গ)

কৃষ্ণের উচ্চভবন প্রমােদ উদ্যানে
যেন পূৰ্বদিক মুখে শ্বেতমেঘরাজী,
ছাইয়া সুনীল নভঃ ভাতে সূৰ্য্যকরে ৷
চারিদিকে বৃক্ষ উচ্চ সৌধ চারিদিকে
মহাকায় পুত্রগণ সেই উচ্চ সৌধে,
নিবাসে উল্লাসী পার্শ্বে পিতার, নিবাসে
প্রবল জামাতৃবৃন্দ সদনে সদনে,
অতিথী ভ্রাতাগণ, আনকদুন্দুভি
পিতা চারিধারে মাধবের ৷ মধ্যভাগে
উন্নত কৃষ্ণভবন ৷ সেথায় প্রবেশি
হেরিল বালক রথী কৰ্ম্মান্তে মিলিত
মাধবের ভাৰ্য্যাগণ চারুবধূবর্গে ৷
আমােদ করিছে বসি ৷ মাঝারে কথক
প্রাচীন যুদ্ধকাহিনী গাইতেছে সুরে
দ্রুত বাজাইছে বীণা যাদব যুবতী ৷
ভ্রমি তারে গৌরকর-রাতুল অঙ্গুলি
গােলাপী বিদ্যুৎ যেন ত্বরিত ঝলসি
গােলাপী বিদ্যুৎ যেন যূথীদল মেঘে ৷
ঝলসিছে দ্বারদেশে বর্মদ্যুতি, অসি
ঝনঝনে পদক্ষেপে ৷ থামিল কথক ৷
পিতামহী-পাদযুগে প্রণমিল বলী ৷
“যাব দূরদেশে, পিতামহী, এ আদেশ
করেছে জননী ৷ দাও আশীৰ্বাদ, শিরে
দাও পূজ্য কর, অম্ব, সাধি বীরকর্ম ৷
আসিব যাদবপুরী – যশস্বী স্যন্দনে ৷”
সবিস্ময়ে দেবীরা চাহিল পরষ্পরে
অবরােধে ৷ সত্যভামা প্রথম কুপিতা
তেজস্বিনী বীরকন্যা আরম্ভিল উক্তি
“অন্ধকার করি বধূ কৃষ্ণের ভবন
কেন পাঠাইবে তােরে ৷ কোন্ দূরদেশে
যাইবি ৷ গৃহের আলাে, অনিরুদ্ধ, তুই ৷
আমারে না বলি কোথা পাঠাইল রতি
কিবা কাৰ্য্যে দূরদেশে ৷ সম্মতি কি লয়ে
কৃষ্ণের পাঠাল তবে, মত কি পিতার ৷
ধৰ্ম্মজ্ঞানহীনা বন্ধু আনিলে রুক্মিণী
গৃহে ৷” অনিরুদ্ধ তারে উত্তর করিল ৷
“মাতার পবিত্র আজ্ঞা ৷ পুত্র কি জিজ্ঞাসে
কেন পাঠাইবি মােরে, পাঠাইবি কোথা ৷
পিত্রালয়ে বাল্যবন্ধু শক্তিধর কেহ
পৰ্বতে পুরাণ স্নেহী আইল নগরে ৷
সহায় যাইব তার ৷ কোন্ দূরদেশে ৷
কি বা কাৰ্য্যে নাহি জানি ৷ তবে এই জানি
মহৎ সে কাৰ্য্য, অম্ব ৷ আর কি জিজ্ঞাসে
ক্ষত্রিয় ৷” বিস্মিতা পুনঃ কহিল উঠিয়া
সত্যভামা ৷ “পিত্রালয় তব জননীর
কে শুনেছে কভু পূৰ্ব্বে ৷ আজই শুনিনু ৷
কোন্ গূঢ় অর্থ তবে প্রলাপে ঢাকিয়া
সাধাইব বলি নারীসুলভ পৈশুন্যে
আশ্রয় লইল বধূ ৷” ভীষ্মসূতা তারে
মৃদুলভাষিণী বামা উত্তর করিল ৷
“অসম্ভব, সত্যভামা, জ্ঞানহীন কাৰ্য্যে
প্রবৃত্তি বধূর ৷ ক্ষত্ৰধৰ্ম্ম-চতুষ্কোণে ৷
আচরে সুন্দরী মম প্রজ্ঞায় অতুলা
অতিক্রমি নরে ৷ হিতমন্ত্রী প্রাণেশের
আলাে যেন পথে নিত্য পতিপ্রাণা নারী ৷
জিজ্ঞাসে স্বয়ং কৃষ্ণ সুমহৎ কর্মে ৷
আমরা স্নেহের বশে প্রিয় অনিরুদ্ধে
ছাড়িতে না চাহি ৷ কিন্তু জননী যখন
দেয় নিজ পুত্রে, গভীর সে মাতৃপ্রাণে
রুধিয়া বাৎসল্যধারা সৌন্দর্য্যের ডালি
নিধান স্নেহের ফেলে, সৰ্বস্ব-আহুতি,
দেব্যজ্ঞ যুদ্ধানলে, কে তবে, ভগিনী,
লালিয়া সামান্য স্নেহে নিষেধ করিবে
অবিবেকী ৷ যাও তবে, অনিরুদ্ধ যােদ্ধা,
উরুযশঃ এস লভি সুদূর বিদেশে ৷
আশীৰ্বাদ দিনু ভ্রষ্ট হবে না কখন
অনিরুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের ঋজুপথ হতে ৷
তার পরে জীবন বা মরণ, বিধাতা
যা লিখেছে ভালে ৷ সাধে না তারে রুক্মিণী
ভীষ্মসূতা কৃষ্ণপত্নী অনুগ্রহ আশে ৷
মরণ সমরে যদি, ক্ষত্রিয়-বাঞ্ছিত
পরিণাম ৷ গৰ্বরুদ্ধ-অশ্রুজল নেত্রে
চারু এই দেহ, বাছা, অর্পিব অনলে ৷
ভিজাব হর্ষসলিলে অক্ষত লভিয়া ৷
তেজস্বী ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্ম আচর বিদেশে
অনিরুদ্ধ ৷ হবি না পশ্চাৎপদ যুদ্ধে ৷
এক পদ যদি তােরে হঠায় অরাতি,
দশ পদ আগুসর, নিশ্চিত মরণ,
আজ যদি বাঁচ, কাল মরিবে আবার,
সহস্র মরণতুল্য উরু অপকীর্তি ৷
সহিবে না অপমান, অনিরুদ্ধ, কভু ৷
সহ্য করে অপমান ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক, –
ইন্দ্রিয়-দমন ধৰ্ম্ম – ক্ষত্রিয় না সহে ৷
ঘুচায় কলঙ্ক রক্তে ৷ ধৰ্ম্মযুদ্ধে জয়ী
হও সদা ৷ লভে উচ্চ প্রতিষ্ঠা মানব
ধৰ্ম্মে ৷ অল্পদিন লভি অন্যায় সমরে
রাজ্য বা বৈভব হেথা কাপুরুষ দম্ভী
জঘন্য উল্লসে, সেথা চিরায়ু নরক
গ্রাসে তারে ৷ আৰ্য্যবীর একেশ্বর যুঝি
পরাক্রান্ত বহুশত্রু বিমুখে সমরে ৷
আৰ্য্যবীর তুমি, বৎস, মাধবের কুলে ৷
দুর্বলের অশ্রুজল মুছাবি সতত 4
বধি অত্যাচারী নরে, যাদব কেশরী ৷
দুর্বলের অশ্রুজলে সিক্ত হলে ভূমি
ক্ষত্রিয়ের পুণ্যরাশি ঘুচায় সে নীরে ৷
কভু না করিবি ব্যর্থ ব্রাহ্মণের আশা,
বৎস ৷ শ্রেষ্ঠ সেই জাতি, পূত স্বার্থত্যাগে ৷
ধৰ্ম্ম যে আচরে শুদ্ধ শান্ত ব্রহ্মজ্ঞানী,
পূজ্য সে ব্রাহ্মণ তব, আপন জীবনে ৷
রক্ষণীয় ৷ মূর্খ নহে ব্রাহ্মণ কদাপি ৷
গর্বিত পরােপকারী – বৃথা তার জাতি ৷
লুণ্ঠিবি না বৈশ্য ধন – অনস্ত্রী বণিক
ধনজীবী ৷ যে বৈশ্যজ দরিদ্রে না পীড়ি
উপাৰ্জ্জে সম্পদ সদা ত্যজিতে পরার্থে,
মহাজন বটে সেই অস্ত্রে ক্ষত্রিয়ের
রক্ষণীয় ৷ ব্যথিবি না শূদ্রের হৃদয়
অপমানে গৰ্ব্ব বাক্যে ৷ যে শূদ্র বিনয়ী
সুমনা, ব্রাহ্মণ যথা পালনীয়, ধন্বী ৷
পিতাসম দয়াবান পালিবি সবারে ৷
মৃদুভাষী হয়ে প্রিয় কথায় চেষ্টিবি
বলিতে অপ্রিয় অর্থ ৷ ব্যথিস না হৃদি
ভ্রাতার ৷ আত্মীয় মােরা এ বিশাল ভবে
দেবতা মানব পশু একীভূত ব্রহ্মে ৷
ক্রোধে না জ্বলিবি কভু, রূক্ষ কথা মুখে
না আনিবি ৷ পশু গর্জে পদে পদে রুষি
সংযম মানব চিহ্ন দিয়াছেন বিধি ৷
অনৃত না বলিবি লােভে বা ভয়ে কভু,
কেশরী আৰ্যসন্তান ৷ পরভয়ে কাপি
কাপুরুষ মিথ্যা কহে, মিথ্যা কহে লােভে
শ্লেচ্ছ ৷ সত্যবাদী আৰ্য্য সম্পদে বিপদে ৷
সিংহসম রণক্ষেত্রে হইবি উদার ৷
প্রহর না পলায়িতে, হান না পতিতে ৷
চির অপকারী শত্রু সরল মানসে
চাহে যদি ক্ষমা, বৎস, লম্ফোদ্যত অসি
নিবার মুহূর্তে ৷ স্লেচ্ছােচিত নিষ্ঠুরতা
আৰ্যজাতি শিরােমণি ক্ষত্রিয়ে না শােভে ৷
যাচিল প্রণয় যদি অনূঢ়া কুমারী,
নিরাশ কর না তারে ৷ পাল ক্ষত্ররীতি ৷
একবার ফুল ফুটে অগরুর শিরে,
একবার কথা কহে প্রতিজ্ঞায় রথী,
একবার চিরতরে হৃদয় সমর্পে ৷
সাধ্বী নারী ৷ প্রত্যাখ্যানে বৃথা সমর্পণে
অখিল জীবন ব্যর্থ সাধ্বী রমণীর,
অনিরুদ্ধ ৷ অষ্ট প্রথা বিবাহের মর্ত্যে,
রাক্ষস গান্ধৰ্ব্ব দুই তেজস্বী ক্ষত্রিয় ৷
ভজে ৷ মধুর কথায় মধুর ঈক্ষণে ৷
ভুলায়ে অন্যোন্যে যবে সুন্দর সুন্দরী
পূৰ্ব্বজন্মপ্রেম স্মরি সহজে মিশায় ৷
দেহপ্রাণ দেহপ্রাণে, চিত্ত পুরােহিত
কহে মহীয়ান মন্ত্র, মনসিজ সাক্ষী,
গান্ধর্ব বিবাহ তাহা প্রশস্ত ক্ষত্রিয়ে ৷
অভিশপ্ত অশ্রুজলে ভ্রষ্ট রমণীর
উদ্ধত ইন্দ্রিয়তৃপ্তি ক্ষণিক আবেশে
নহে খ্যাত সেই নামে ৷ কুলধৰ্ম্মহানি,
কলঙ্ক উদার বংশে, দেশে অবনতি
ফলে সেই বিষ বীজে ৷ সতত বৰ্জিবি
তারে, অনিরুদ্ধ ৷ পূত গান্ধর্ব বিবাহে
সৌন্দর্য্যে বীরত্বে বাড়ে বংশের সন্ততি ৷
ভয়প্লতা চেষ্টমানা সভয়ে সপ্রেমে
বীরত্বদ্যোতিত কান্তি হর্তার কুমারী
যবে হেরে, – রথে তুলি উদ্ধত ঔজসে
ক্রুদ্ধ জাতিকুল রুদ্ধ সিংহ পরাক্রমী
নিঃসরে যখন বীর রক্তাক্ত স্যন্দনে,
রাক্ষস বিবাহ তাহা, মহাফলা রীতি
ক্ষত্রে ৷ বীর সূত জন্মে, সুবংশ বিস্তারে ৷
অবনত-নেত্র সদা নারীর সম্মুখে
পরদারা-কান্তি, বৎস, হেরিবি না কভু ৷
হের যদি, মাতৃনামে পূজিবি তাহারে ৷
রমণীপ্রার্থিত কান্ত বিনয়ী উদার
জিতেন্দ্রিয় মহালােভী সিংহসত্ত্ব যুদ্ধে,
কোন্ পথে আক্রমিবে বিপদ তােমায়,
অনিরুদ্ধ ৷ প্রাণাধিক, যাবি ম্লেচ্ছদেশে,
উদ্ধত কপটী জাতি, অমিত্র আৰ্য্যের ৷
যাও দূর শত্রুদেশে অনিরুদ্ধ যােদ্ধা ৷
আশীৰ্বাদ দিনু তােরে, আস যদি ফিরে
বিজয়ে আসিবি ঘােষি যশস্বী স্যন্দনে ৷
যাও ধীরে, যাও নির্ভয়ে ৷ কে তবে তােরে
রুধিবে, কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ বলী ৷”
আপ্লুত গভীর আঁখি স্নেহজলে পৌত্রে
আশিসিল কৃষ্ণজায়া ৷ ঈষদ হাসিয়া
সত্যভামা অনিরুদ্ধে কহিল আলিঙ্গি ৷
“সহজে ছাড়িল তােরে ভগিনী আমার,
অনিরুদ্ধ, অনিশ্চিত ভয়পূর্ণ কার্য্যে
অনির্দিষ্ট দূরদেশে ৷ আয় তবে, বাছা,
প্রাণধন অনিরুদ্ধ, আয় মম কাছে ৷
আশীৰ্বাদ দিব তােরে আমিও, মাণিক,
স্নেহনিধি ৷ দূরদেশে যাইবি, যেথায়
হেরিবে সতত তােরে স্নেহহীন আঁখি,
কর্কশ বিদেশী ভাষা সতত শুনিবি
স্নেহহীন স্বরে ৷ আশীৰ্বাদ দিনু, বাছা,
সকলের ভালবাসা কুড়ায়ে যাইবি
সে অজ্ঞাত দেশে যেন ভ্রমিয়া বালক
সন্ধ্যায় তটিনী কূলে বাতাসে উল্লসি
ফুলগুলি যায় তুলি মার্গস্থ বিটপে ৷
বীরােচিত মহাবল সুকুমার দেহে
বৃদ্ধগণ হেরিয়া মােহিত পিতৃভাবে
নিকটে ডাকিবে, যাদু ৷ যুবারা মােহিত
‘এস আগন্তুক প্রিয়দর্শন’ বলিয়া
হাত ধরি বসাইয়া বন্ধুত্ব-প্রণয়ী
হবে তব কাছে ৷ বালাগণ অনায়াসে
সহজে কৌমুদীপৃষ্ট কুমুদ যেমতি
দেহ প্রাণ দিবে ঢালি বাঞ্ছিত চরণে ৷
হাসিয়া তুলিবি, যেন দেবতা কুড়ায় ৷
প্রীতমনাঃ শান্তভাবে ভক্তের আহুতি ৷
ক্ষতহীন দেহে ফিরি উজ্জ্বলিবি পুনঃ
এ গৃহ, একই আলাে দ্বারিকার তুই,
অনিরুদ্ধ ৷” পিতামহীযুগল বালকে
এইরূপে আশিসিল অশ্রুজল নেত্রে ৷
নতশির পাদযুগে গ্রহি আশীর্বাদ
বিশাল উদ্যান ত্যজি সিংহদ্বার পথে
যাইল ঝটিতি যােদ্ধা ৷ ঝলঝল বৰ্ম্ম,
ঝনঝনে অসি কটিদেশে ৷ না থামিল
মার্গস্থ সভায়, নগরদ্বারে থামিয়া
প্রণমিল পিতৃপাদে যাদবকেশরী ৷
“যাব দূরস্থানে আজি মাতার আদেশে
পিতঃ ৷ অনুমতি-প্রার্থী আসিনু চরণে ৷”
কহিল প্রদ্যুম্ন ধন্বী ৷ “প্রীত আমি, বৎস,
মাতা তব পুত্রপ্রাণা না সঞ্চিলে কোলে
প্রাণধন, পাঠাইল দূরে মহাকার্য্যে ৷
মহৎ কাহারাে সঙ্গী যাবে, অনুমানি ৷
সম্মান করিবে তারে, অনুরুদ্ধ যােদ্ধা,
সম্মানাহঁ তৎসদৃশ প্রাণী ৷ জান তবে
সম্মানের সীমা, বৎস ৷ সৌরসেন রথী
দাস নহি কারাে মােরা অখিল ভুবনে ৷
মানি না নৃপতি পুরে দেখি বৃথা বংশ
বৃথা সিংহাসন গৌরব ৷ শৃগাল ভীরু
সিংহচর্মে আচ্ছাদিত বিরাজে অরণ্যে,
অখিল কানন পূজে নীচাশয় ধূৰ্ত্তে
কেশরী না পূজে ৷ গুণে অদ্বিতীয়, বংশে
সমান, মন্ত্রণে শৌর্য্যে অগ্রগণ্য হেরি
কাৰ্যসিদ্ধি হেতু মানি শ্রেষ্ঠ জনে ৷
স্বাধীনতা কুলধৰ্ম্ম যাদবের ৷ নমে
উচ্চশির তার এক গুরুজনপদে
নরের, না দেবের ৷ পালি কুলধৰ্ম্ম
আচর বিদেশে, পুত্র, উচ্চশির নিতি ৷”
বাহিরিয়া অনিরুদ্ধ সপ্তদ্বার লংঘে
লঘুগতি ৷ রৈবতক প্রকাণ্ড শিখর
উঠিল সম্মুখে উচ্চ গগন আক্রমি
বহুস্বর নদরােলে ৷ ঝরণা নিনাদ ৷
ধ্বনিল রথীর কর্ণে ৷ পৰ্বত কসম
সৌরভ লভিল ৷ গিরিবাসী শুনিল
রহস্যগীতি বিহগের ৷ হৃদয় মুদিত
বাহিরিল যেন গানে ৷ গাহিতে গাহিতে
ধরিল পৰ্ব্বত মার্গ বালক সুধন্বী ৷

ইতি – রুক্মিণী-সত্যভামা আশীৰ্বাদ ও বহির্গমন সমাপ্ত

তৎপরে ইন্দ্ৰবাসদেব সংবাদ ও সভাবর্ণন ও সভায় বাদবিবাদ আরম্ভ

সৌরসেন সভাস্থলে সমাসীন আজি
সৌরসেন বৃদ্ধগণ অদৃষ্টের দিনে ৷
বার্ধক্যে মহিমান্বিত, অন্ধক বিপৃথু
দেবভাগ দেবশর্মা বৎসাবান শিনি
উদ্ধব সুতনু অনমিত্র মহাবলী, –
যত বৃদ্ধ ভগ্নবল সৰ্বহর কালে
আর না আস্ফালে ধনু দারুণ সংগ্রামে,
লৌহবক্ষ হতে না বেরােয় সিংহনাদ
শত্রুহৃদি বিদারিতে, ভীম অসিভার
অল্পক্ষণ বহিতে সমর্থ বাহু – তবে
মানসে সবল যেন চতুষ্কোণা দুর্গে
চারিদিক হেরে তীক্ষ্ণ মৃত্যুঞ্জয় বুদ্ধি,
অতীত প্রদীপ শিখা ঘুরায়ে দর্শায় ৷
পরিণাম আশাভীতি নবযুগ পথে ৷
প্রাচীন নৃপতি সেথা উগ্রসেন রাজা
পার্শ্বে বসুদেব শৌরি বৃদ্ধ মহাকায়
আনক দুন্দুভি যােদ্ধা বিখ্যাত জগতে ৷
মহাভাগ পুত্রদ্বয় বসুদেব পাশে
আসীন রেবতীকান্ত হলধর বলী
অরিসেনা-ক্ষেত্রে চাষী, কৃষ্ণ মহাযশা
উরকীৰ্ত্তি নারায়ণ মানব শরীরে ৷
আসিয়া কহিল কৃষ্ণে ধীবল দুয়ারী ৷
“মহাকায় কেহ দ্বারে, বাসুদেব শৌরি,
কি গুপ্ত বারতা, কৃষ্ণ, কহিবে তােমারে ৷”
উত্তর করিল তারে কৃষ্ণ মহাযশা
“সভাগৃহ সমাসীন বৃদ্ধেরা যেথায়
কে গুপ্ত বারতা কহে কনীয়ান কর্ণে ৷
সভাগৃহে দৌবারিক, আন বার্তাবহে ৷
বৃদ্ধ রাষ্ট্রপিলবৃন্দে রাষ্ট্রের বারতা
নিবেদে সুমতি দূত ৷ মহীয়ান বৃদ্ধ,
শান্ত তার বুদ্ধি ৷ ধীর অটল মানসে
গুঢ় রহে মন্ত্রণা ৷” কহিল দৌবারিক
“নহে দূত এই যােদ্ধা ৷ ধন্বী মহেষাস
দেবাকৃতি ৷ দেবসম মহৎ কপালে
ভাতে কি নিগুঢ় আভা ৷ দেবসম গতি
যেন পর্বতচারী সিংহের ৷” সভাদ্বারে
উঠিয়া হেরিল শার্জী মহাকায় কেহ
দাড়ায়েছে বর্মী ভীম শরাসন করে ৷
প্লাবে দ্বারদেশ জ্যোতিঃ, উচ্চশির ঠেকে
তুঙ্গ তােরণাগ্রে, - অদিতিনন্দন বর্জী
মানবশরীরে ছন্ন মহৎ দেবতা ৷
যেন বহ্নি অল্প ধূমে ৷ কহিল মাধব ৷
“কে তুমি যাদবপুরে বার্তাবহ ৷ রথে
উঠিয়া না পদব্রজে লংঘি গিরিমালা
তপ্ত মরুদেশধূলি উড়াইয়া ধাবে
কোন জন্মভূমি ছাড়ি কি বা বার্তা মুখে
বাহিলে সুদূর পন্থা সমুদ্র-উদ্দেশী ৷”
আখণ্ডল বক্রী কৃষ্ণে উত্তর করিল ৷
“প্রথম কি এ আলাপ হইল মােদের,
কৃষ্ণ ৷ বৃথা কেন এ শুধাও গূঢ়জ্ঞানী
বৃন্দাবন কথা ভুলেছ, কি তবে,
তুমি যেথা মনােহারী দুরন্ত বালক ৷
খেলিতে মধুরহাসি গােপবধূ মাঝে ৷
গােবর্ধন বাল্যকালে হেরিল দুজনে,
নিবিড় খাণ্ডবারণ্যে আলাপ করিনু ৷
রণের গম্ভীর মৌনে ধন্বী সহ ধন্বী ৷”
বাসুদেব মহাযশা উত্তর করিল ৷
“আখণ্ডল ধনুর্ধারী, দেবত্ব আবরি 5
ছদ্মবেশী যে আইল আত্মগােপনার্থে
চিনেও না চিনে তারে আৰ্য্যমনা জ্ঞানী ৷
ছদ্মবেশে পরব্রহ্ম বিরাজে জগতে
বহুভাবে বহুরূপে ৷ সুজ্ঞানী মানব
চিনেও না চিনে তারে ৷ ঈশ্বরের খেলা
ভাঙ্গিতে না চাহে ৷ মৃদু চাপা হাসি মুখে
খেলে, সঙ্গে ৷ ভবনদী পুলিনবিহারী
রাখে ক্রীড়া নিয়ম অক্ষুন্ন
বাজে বংশী ভবনদী পুলিন সৈকতে
নাচে বামাগণ জ্যোৎস্নাপ্লুত মধুরাত্রী
মৰ্ত্ত পৃথিবীতে এলে, আখণ্ডল বজী ৷”
আখণ্ডল ধনুর্ধারী উত্তর করিল ৷
“ধৰ্ম্ম রক্ষা-অর্থে, কৃষ্ণ, মহাত্মা জন্মায়
কর্মক্ষেত্র জগে ৷ পাপভার ক্লিষ্টা যবে
দেবী বসুন্ধরা, বাড়ে অধৰ্ম্ম সর্বত্র,
ধৰ্ম্ম-অঙ্গে আসে গ্লানি, নারায়ণ জিষ্ণু
অবতরি নরদেহে দুর্জনে বধিয়া
দূর করে মহেশ্বাস ভারতের ভীতি ৷
উগ্র দৈত্যগণ মধুর দানবদ্বীপে ৷
বহু পরাভবে ভগ্ন পুনৰ্ব্বার শক্তি
জমাইছে ৷ রাজধানী সে সুদূর দেশে ৷
কিন্তু প্রাগজ্যোতিষ, কিন্তু হুনা চীনভূমি
মানে ভীম শাসন, তুরুষ্ক করাধীন,
টলিছে যবনেশ্বর মহাহ্রদতীরে ৷
অর্ধভাগ পৃথিবীর ছাইল সে শক্তি ৷
সহায় শঙ্কর নিত্য দানবপতির,
যােগ দিবে বরবেশে স্কন্দ তারকারি
দানব সম্বন্ধ-লােভে ৷ মহান অনর্থ
আৰ্য্যের দেবের সে বিবাহে ৷ পাঠাইবে
দৈত্যভূমি প্রদ্যুম্ন-দয়িতা অনিরুদ্ধে
চারুস্মিতা দেবী ৷ সহায় বিরিঞ্চি যবে,
হরিবে দৈত্যকুমারী ভাঙ্গিবে বালক
উগ্রফল এ বিবাহ, নিঃসন্দেহে জানি ৷
কিন্তু মহাবলী দৈত্য প্রসাদে শম্ভুর
কুমার দানবজিৎ রহে পাশে সদা
পরন্তপ ধনুর্ধারী ৷ সাধি বিশ্বহিত
যেন না বিপদে পড়ে চারু অনিরুদ্ধ
অকাল মরণে ৷ উঠ, মহাবলী যােদ্ধা
বাড়ে হের, সদা যেন কৃষ্ণমেঘরাজী
সন্ধ্যার গগনে দৈত্য ৷ ভীমবাহু তার
উচ্চ হিমাচল মাপে প্রকাণ্ড দুদিকে ৷
শমিলে পারস্য তেজঃ – কদিন বা টিকে
ধৰ্ম্মচ্যুত – হিমাদ্রির পশ্চিম তােরণে
ঘিরিবে অক্ষয় শত্রু ৷ শুন আসে কর্ণে
ভীম সিন্ধুনাদ ৷ কাল-সমুদ্র যেমতি
ঘােষিছে ম্লেচ্ছজগৎ আৰ্য্যাবর্ত্য পানে ৷
গর্জিছে পূরবে দৈত্য ঝটিকার ধ্বনি ৷
ঘূর্ণবায়ু যেন আসি, যাদব কেশরী,
চূর্ণ কর মেঘবল, উড়াও সে ঝড়ে ৷
আসন্ন ভয়ের রাত্রী দেবপ্রিয় দেশে,
সর্বহর সব্বঘাতী কৃতান্ত আসিছে ৷
ক্ষত্রহীন করিতে ভারত ৷ অখণ্ডিত
রৈলে এ ভীষণ শত্ৰু আৰ্য্যের দুয়ারে,
কে রক্ষা করিবে তবে, শূন্য আৰ্যভূমি ৷”
উত্তর করিল তারে বাসুদেব শৌরি
“কালের করাল গ্রাসে কে বাঁচে, সুরেশ ৷
তুরীরবে জয়নাদে আরাব করিয়া
সুমহৎ রাষ্ট্রবৃন্দ মত্ত রকৰ্ম্মী
নির্দয় নয়নে অগ্নি গৰ্ব্বকথা মুখে
অহর্নিশি চলিতেছে ধ্বংসপথে বেগী
অন্ধবৎ ৷ আসে কত, যায় কত ভবে ৷
প্রাচীন অসুর কোথা, বাঁধি মহাপুরী
প্রস্তরে লিখিল যারা, লিখি মৃৎপাত্রে
নিজ ইতিহাস, মূঢ়! ভাবিল চিরায়ু
মােরা ৷ বসুন্ধরা ঢাকে সে বিপুল কীর্তি ৷
সত্যযুগ মানবের পশ্চিম সাগরে
ডুবিয়াছে মহাদ্বীপ ৷ নির্দয় তরঙ্গে
মজিল সভাৰ্য্যাপুত্র সুকরুণ রূপে
দেবসম সেই জাতি ৷ লুপ্ত মহাযশ ৷
বিস্মৃতির সর্বগ্রাসী ভীম অন্ধকারে ৷
কত মহাজাতি উঠে গ্রাসিতে পৃথিবী;
কত মহাজাতি গেল অনন্ত তিমিরে ৷
শেখে না অল্পায়ু জেতা ৷ ভাবে আমারেই
বরিয়াছে জগদেব, আমিই অমর,
সমস্ত পৃথিবী ছেয়ে রহিব চিরায়ু ৷
কাল জিজ্ঞাসিবে সূৰ্য্য কোথা সেই বলী ৷
এক সে পবিত্র জাতি যে চিনেছে লীলা,
জানে ঈশ্বরের ক্রীড়া সুখদুঃখ মম,
হইয়াছে চিরজীবী ৷ রৌরব-তিমিরে
যদি ফেলে বিশ্বজেতা, দলি লৌহপদে
যদি ভাঙ্গে, যদি পেষে, নির্ধন করিয়া
মনুষ্যত্ব লয় শুষি নিধৃর্ণ মানসে,
পাপের অগাধ পঙ্কে ডুবায় গােলামে,
মরিবে না বু ৷ অন্ধতম সে নরকে
যাইব নামিয়া আমি উদ্ধার করিতে,
যুগে যুগে আৰ্যত্রাতা নারায়ণ জিষ্ণু ৷
নিশ্চিন্ত চালাও রথ শােণিত-নগরে
বাসব ৷ আসিব কৃষ্ণ যদুকুল নেতা,
ঘূর্ণবায়ু যেন ঘােষি দৈত্যবিভীষিকা
চূর্ণ করি উড়াইব পূরব গগনে ৷”
ফিরিল সভায় শৌরি ৷ দ্বারিকা ত্যজিয়া
ধরিল পৰ্ব্বতের মার্গ আখণ্ডল বর্জী,
কুয়াশা মহৎ শৈলে ৷ কুয়াশায় গৃঢ়
ধরিল প্রদ্যুম্নপুত্রে মহৎ দেবতা ৷
অর্ধপথে ৷ সুগন্ধিত দেবদারু বনে,
অগাধ করে ভাসি উঠে দেবরাট
ধাবমান কুয়াশায়, যেন ছায়াশৃঙ্গে,
প্রকাণ্ড, মায়াবী, হেরি পথিক যাহারে
“অনুসরে মােরে ভাবে রাক্ষস ক্ৰব্যাশী
কাপি নিজছায়াভীত আলেমান-দেশে ৷

দালানে সভাগৃহের ধরিয়া সে শঙ্খ
ভীমনাদী পাঞ্চজন্য বাসুদেব যােদ্ধা
উরুঘােষী মহানাদে পূরিল নগরী ৷
শত সিন্ধুধ্বনি যথা ধ্বনিল আহ্বান
পৰ্ব্বতে প্রান্তরে জ্বলে ৷ চমকি উঠিল
মহতী যাদবপুরী ভবনে দুয়ারে
প্রমােদ-উদ্যানে ৷ উগ্র আয়ুধ সাপটি
অগণন চক্রঘােষে হুঙ্কারিল ভীমা,
লক্ষ পদধ্বনি পথে, লক্ষমহাস্বরা
উরুস্বনা কোটিশিরা, সমুদ্র যেমতি
অযুততরঙ্গস্বর গর্জি যবে আসে
বেলাপানে, – সভাপানে ধাইল নগরী
অসীম আরাবে ৷ উচ্চশৈলে প্রতিধ্বনি
ঘােষিল অরণ্য যথা বায়ু পরিরম্ভে ৷
অযুত বৃহৎ কায়ে সিংহসম নেত্রে
পূরিল বিস্তৃত দীর্ঘ সভাগৃহ ভূমি ৷
এক প্রান্তে সমাসীন সভার সম্মুখে
বয়ােবৃদ্ধ জ্ঞানবৃদ্ধ সমরে বা যারা
অগ্রগামী ৷ উগ্রসেন প্রাচীন নৃপতি
সবার মাঝারে শােভে বৃদ্ধ মহাকায় ৷
নরশস্যক্রম চারি কৃতান্ত বপিল
কর্মক্ষেত্রে ৷ চারিবার উঠিল হিল্লোলি
পবনে ধরার ধন, হাসিল জননী ৷
তীক্ষ্ণ অসি ঘুরাইয়া ভীষণ কৃষক
চারিবার কাটে ৷ হেরিয়াছে উগ্রসেন ৷
উঠিছে পঞ্চমশস্য শ্রান্তিহীন ক্ষেত্রে ৷
যুগসুখদুঃখ নেত্রে দীর্ঘজীবী রাজা
রহে, যেমতি পারস্যে পুরাতন শিলা
শত মহালিপি বক্ষে, নূতন যুগের
বিস্ময় ৷ দেবের হস্তলিপি অনুমানে ৷
মহিমা-স্তম্ভিত প্রজা, পূজে সেই গিরি ৷
সমাসীন নৃপপাশে বসুদেব শৌরি
আনকদুন্দুভি যােদ্ধা বিখ্যাত জগতে ৷
পুত্রপৌত্র চারিধারে, পৌত্রের তনয়
ঘেরে মহীয়ান বৃদ্ধে, কৃষ্ণ বলরাম
গদ চারুদেষ্ণ সাম্ব প্রদ্যুম্ন সারণ, –
যেন শৃঙ্গ অভ্রগামী ঘেরা শত শৃঙ্গে ৷
ভগ্নবল বৃদ্ধদেহ সহর কালে,
অক্ষত বিরাজে তবু মহিমা সে দেহে, –
প্রাচীন প্রাসাদ যথা উচ্চ যুগজয়ী
পূর্ব-সাম্রাজ্যের চিহ্ন জনহীন পুরে
ভগ্নশির কালে ভগ্নপ্রাচীর ৷ তথাপি
বিস্ময়ে এ কাল হেরি ভাবে ‘দেবসম
সে কালের মানবেরা এ পাষাণরাশি
তুলিল গগনে যারা কৃতান্ত না মানি ৷
পূজিয়া মহৎ বৃদ্ধে ভক্তিপূর্ণ নেত্রে
প্রতীক্ষা করিল সভা বাসুদেব-উক্তি
উঠি সভামাঝে ধীরে কৃষ্ণ মহাযশা ৷
তুরীধ্বনি যেন ঘােষি আয়সের কণ্ঠে
ছাড়িল সিংহবচন সিংহবক্ষ হতে ৷
“উঠ ওহে সিংহজাতি, সাজ রণবেশে ৷
আনন্দের বার্তা আজি যাদব-নগরে,
পুনঃ মহাকৰ্ম্ম এল, দেখায়েছে পুরে
চারুমুখ তার ৷ যদুর সন্ততি মােরা
কত কাল বিনা লক্ষ্যে পচিয়া থাকিব
নিষ্কর্মা আলস্যে ৷ নাহি বাসি’ এই অর্থে
রুক্ষোপলা গিরি-ভূমি, পৰ্বতের কোলে
নাই স্থাপি এই অর্থে তরঙ্গ-রক্ষিতা
দুর্ধর্ষা মহতী পুরী মহােদধি তীরে ৷
অগম্য গিরিগহ্বরে শাবক শাবিকা
রাখি সিংহ বাহিরায় উরুচারী মৃত্যু
বধার্থে ভ্রমিতে ৷ যদু শাবক শাবিকা,
বৃক্ষাগ্রে মধুর নীড়ে মধুর সন্ততি
নিরাপদে রাখিয়া বিশ্ববিচারী পক্ষে ৷
পরহিতে ভ্রমি মােরা ৷ স্বার্থপর শান্তি
ভজিতে নাহি জন্মিনু, ওহে সিংহজাতি ৷
পরার্থে দ্বারিকাপুরী, পরার্থে আমরা
যদুকুল, পরার্থে জন্মেছি বাসুদেব
দুঃখপূর্ণ ধরাতলে উচ্চ যদুবংশে ৷
কি হেতু সিংহ-বিক্রম দিয়াছে বিধাতা,
কি ফলে বা অল্পসংখ্য যাদব প্রতাপে
পৃথিবীর সমকক্ষ যদি না পরার্থে
খাটাই সেই বিক্রম ৷ পরার্থেই সৃষ্ট
বাহুবল বুদ্ধিবল প্রতিভা জগতে ৷
দুৰ্বল-উদ্ধার, দমন অত্যাচারীর
জন্মভূমি রক্ষা, এ আমােদ এ বিলাস
নহে গান, নহে নৃত্য, যােগ্য যদুকুলে ৷
বিশ্রামার্থে গান নৃত্য প্রীতি সৃষ্ট বিশ্রামার্থে
কিন্তু চিরদিন কি বিশ্রাম ৷
করিব যাদব হয়ে নিষ্কৰ্ম্মা আলস্যে ৷
কি নীরস সে দিন যেদিন না করিনু
কোন পরহিত মােরা ক্ষত্রোচিত তেজে ৷
স্বর্গের দেবতা আজি যাদব নগরে
কহিল এ বার্তা নামি ৷ শুন, রথিগণ
মধুর দানবদ্বীপে দানব-ঈশ্বর
বাণ মহাবাহু, বাড়ে নিত্য তার কীর্তি ৷
শাসিছে প্রতাপে ধরা ৷ যত উগ্র জাতি
হিরণ্যকশিপু ভয়ে মিলিত হইল,
বন্ধচ্যুত পরে, পুণ্য বাণাসুর ভয়ে
পূৰ্ব্ব বসুন্ধরা ভজে একচ্ছত্রচ্ছায়া ৷
প্রাগজ্যোতিষ চীনভূমি আচ্ছাদিল বাণ
মঙ্গল তুরুষ্ক হ্ন মানে সে অধিপে ৷
সহায় শঙ্কর নিত্য দানবপতির,
যােগ দিবে বরবেশে স্কন্দ তারকারি
আসুর সম্বন্ধপ্রার্থী ৷ কহিতে এ বার্তা
স্বর্গের দেবতা আজি নামিল নগরে ৷
উগ্রফল এ বিবাহ ত্রিদিবে মরতে ৷
অতএব পাঠাইল দানবের ভূমি
তনয়ে প্রদ্যুম্নজায়া ৷ চারু অনিরুদ্ধ
রূপে ভুলাইয়া আনি দৈত্যকন্যারত্নে
গ্রহিবে বালক; বায়ু-অতিগ স্যন্দনে
উগ্রবলে বা হরিয়া যােদ্ধা মহাবলী ৷
কিন্তু পরাক্রান্ত দৈত্য, সহায় শঙ্কর
কুমার দানবজিৎ রহে সদা কাছে ৷
পরন্তপ ধনুর্ধারী ৷ যেন না বিপদে
পড়ে অনিরুদ্ধ যােদ্ধা সুদূর বিদেশে ৷
অতিশয় অপকীৰ্ত্তি হইবে মােদের
মরিলে যাদব রথী বিদেশীয় ভুজে
হত, যেন অসহায়, যেন হেয় কুলে
তার জন্ম ৷ না সহিব দুর্বল ধর্ষিত,
সবলে কি ডরাইব, কাপুরুষ যথা
বলান্বিত দৈবদোষে অশক্তে আস্ফালে
ঘৃণ্য শক্তি ৷ কে মানিবে আর যদুবংশে
অখিল বসুন্ধরায় ৷ বিশেষতঃ দৈত্য
চিরশত্ৰু আৰ্য্যের ঘিরেছে এবে ভূমি
আৰ্য্যাবর্তপানে যেন কৃষ্ণমেঘরাজী
বাড়ে দৈত্য বিভীষিকা উত্তরে পূরবে ৷
হিমাচল দুইদিকে মাপে ভীমবাহু ৷
বাড়ে বহু ম্লেচ্ছজাতি পশ্চিমে ৷ যেদিন
অল্পায়ু পারস্য তেজঃ নিবারে যবনে,
নিরাপদ এ দেশের ৷ পরে চারিদিকে
আক্রমণ, চারিদিকে সমুদ্র যেমতি ৷
ঘােষিবে ম্লেচ্ছ জগৎ বিপন্ন ভারতে ৷
অতএব উঠ সাজ, ওহে সিংহজাতি ৷
সন্নাহে আবরি দেহ তুরীরব ছাড়ি
বাহিরি যাদব মােরা যুদ্ধ-অগ্নি নেত্রে
চক্রঘােষে সিংহনাদে পূরব-উদ্দেশী ৷
স্বদেশ-রক্ষার্থে ধৰ্ম্মরক্ষার্থে বিধাতা
সৃজিয়াছে যুদ্ধ মর্ত্যে ৷ পুনঃ ধৰ্ম্মযুদ্ধে
মাতি, ওহে যদুগণ ৷ খুল্ল স্বর্গদ্বার,
ডাকিছে অপ্সরাকণ্ঠ বৈজয়ন্ত-ধামে ৷”
কহিল মহাত্মা ৷ উরুচারী সিংহনাদে
উত্তর করিল জাতি ৷ এই দিকে কিন্তু
উচ্চস্তম্ভ যেন উঠি ভ্রকুটি ললাটে ৷
কহিল নিন্দিয়া কৃষ্ণে হার্দিক সুধন্বী
কৃতবর্মা ৷ “কৃষ্ণ কৃষ্ণ মহত্ত্ব পিপাসু
কতদিন ভীমশ্রমে খাটাবি মােদের
নির্মম সমরে ফেলি ৷ আয়সের পুত্র
নিৰ্ম্মম আয়স তুমি ৷ পুরাকালে সুখী
সুপ্রিয় মথুরাপুরী ভজিতাম মােরা
নদীতীরে ৷ ঝিল্লিকা-নাদিত বনরাজি
মধুর জীবন ঘেরে, বৃন্দাবন-বায়ু ৷
বিতরি মৃদু সৌরভ ভ্রমে মথুরায়, –
যমুনার কলস্বর বিলাসী শ্রবণে
সৌরসেন বহুগ্রামে বাসিতাম সুখী ৷
কে সম্রাট কে বিক্রান্ত বিশাল ভারতে
নাই রাখিনু সে বার্তা, সন্তুষ্ট রহিনু
ক্ষুদ্র সুরক্ষিত জাতি স্বাধীন স্ববলে ৷ 6


উত্তর না করে জ্ঞানী উদ্ধত শৈনেয়ে ৷
কৃতবর্মা ৷ কিন্তু ক্রোধে সভায় উঠিল
উরুজিৎ রূক্ষভাষী, প্রসেন-তনয়,
উরুজিৎ ধনুর্ধর, দুঃসাহসী যুবা
জ্ঞানহীন, অগ্রগামী সমরে কলহে ৷
সিংহসম গর্জি যুবা ভৎসিল শৈনেয়ে ৷
“বীরজাতি যদুগণ অথবা কি বীর
তারা সহ্য যারা করে ততদিন মৌনী
শৃগাল-চিৎকার সদা সাত্যকির মুখে ৷
গুণ্ডারূপে কি নিযুক্ত করেছ, মাধব,
এ গর্জন-সার জন্তু যাদব-সভাতে
বিভীষিকা দেখাতে মােদের ৷ যে বলিলে
কেহ কিছু সভামাঝে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে,
অমনি কৃষ্ণের এই কুকুর, সাত্যকি,
ঘেউ ঘেউ করি ছুটে দংশিতে 7 তাহারে ৷
যাহা নাই করে কভু এই আৰ্য্যদেশে
নীচ হতে নীচ, তাহাও করিল আজি
মহিলার অপমান সভার সম্মুখে
ম্লেচ্ছ ৷ কি হে থামিবি না তবে, যযধান,
যদিন না ধরে কাটি তীক্ষ্ণ অসিধারে
অপবিত্র জিহ্বা তাের টাঙ্গাই, শৃগাল,
সভাদ্বারে ৷” না থামিতে উরুজিৎ বাণী
উঠিল ভীষণ ক্রোধে বাষ্ণেয় সাত্যকি,
তীক্ষ্ণ অসি উল্লঙ্গিয়া উরুজিৎ পানে
গেল ধাবি বধিতে ৷ ঘােষিল যদুসভা
ক্ষুব্ধ মহার্ণব যথা উত্তাল তরঙ্গে
বিলােড়িত ৷ কিন্তু সাম্ব ধরিল শৈনেয়ে
ধরিল প্রদ্যুম্ন বসাইতে ৷ কোশে পুনঃ
আবরিয়া ভীম অসি কহিল সাত্যকি
আবেগ দমিয়া কষ্টে ৷ “নিবারিল মােরে
কৃষ্ণপুত্রগণ ৷ ন্যায্য সে বারণ মানি ৷
মাতাল, উন্মত্ত, শিশু, তাদের বচন ৷
নাহি গণে লােকে ৷ যদি দুরন্ত বালক
ভসে গুরুজনে ধৃষ্ট এক চড় গালে
বসাইয়া শাসি থামে ৷ উন্মাদ-প্রলাপে
গঞ্জিত করুণাপূর্ণ মৌনে যায় চলি ৷
মাতাল অশ্লীলভাষী ধাক্কা দিয়া গলে
গৃহপথে ফিরায় হাসিয়া ৷ ক্ষিপ্তমনা
শিশু তুমি, উরুজিৎ, ক্ষমিনু তােমারে ৷
সভার গৌরব ভঙ্গ করিয়াছ, শাস্তি
যদুগুরুজন তার বিধান করিবে,
বিশেষতঃ বাসুদেব নেতা এ পুরীর ৷”
হাসিয়া কহিল পুনঃ উরুজিৎ বলী
“অতি মনােহর ক্ষমা এ তাের, সাত্যকি ৷
শরীর-রক্ষক ক্ষমা ভয়পূর্ণ ভবে ৷
মহারথী যদুগণ, স্বাধীন আমরা
ছিলাম যেদিন হতে মহাকায় যদু
অভিশপ্ত বহিষ্কৃত যযাতির ক্রোধে
স্থাপিল মথুরাপুরী সৌরসেন দেশে ৷
অভিমানে প্রচারিল আদেশ সেথায়
মহাত্মা অন্তিম কালে পুত্রপৌত্রগণে
ডাকি আছে ৷ শুন মােরে, যদুর সন্ততি,
যদিন এ জাতি থাকে, যদিন এ পুরী,
মানিবি না নৃপে কভু যাদব নগরে ৷
জ্যেষ্ঠ মম বংশধর কেন্দ্র নৃপনামে
হবে এ বংশের কিন্তু না পিতারে যেন
পূজিবি, ভারতে যথা নিয়ম আৰ্য্যের ৷
নিজের অধিপ নিজে সমুদায় জাতি ৷
কুলধৰ্ম্ম ইহা জান যদুর সন্তানে ৷
মহাত্মাবচন পূজি সে অবধি মােরা
স্বাধীন রহিনু ৷ শেষে কি দাসত্ব প্রিয়
যাদবের মনে ৷ পুষি বসুদেব বংশে
ঐশ্বর্য্যে নেতৃত্বে যশে হীনবল জাতি
এক গৃহ বলবান যাদব-নগরে ৷
ছায়াসম সিংহাসনে বসে উগ্রসেন
ক্ষীণ হল ভােজ বৃষ্ণি, নিস্তেজ অন্ধক ৷
পুত্তলির মত নাচে সমুদায় জাতি
এক সূত্রধর-হস্তে ৷ কৃষ্ণের বচনে
যুদ্ধ সন্ধি, শুই উঠি কৃষ্ণের বচনে
করিতে যুবতী-চুরি কৃষ্ণপৌত্র যােদ্ধা
গেল দৈত্যদেশে ৷ না হয় বসন্ত প্রাণে
জাগিল, না হয় শুনি কোকিলের কুহু
অধীর কৃষ্ণের রেতঃ গােপীনাথ পৌত্রে ৷
তাই বলি কি রে বধ্য সংগ্রামে8 দানব,
তাই বলি রণক্ষেত্রে নামিবে এ জাতি ৷
পিতামহ পিতা ভ্রাতা পিতৃব্য রয়েছে ৷
অসংখ্য অনিরুদ্ধের ৷ রাতদিন শুনি ৷
তাহাদেরি মন্ত্রণায় তাদেরই শৌর্য্যে
রক্ষিতা দ্বারিকাপুরী ৷ যাক তবে তারা
উদ্ধার করুক রত্নে মন্ত্রণায় শৌর্য্যে ৷
বৃথা কেন বলক্ষয় সমস্ত জাতির ৷
তবে কি দাসত্ব স্থির যাদবের ভাগ্যে ৷
কে এই অদ্ভুত কৃষ্ণ যে তাহারি পদে
প্রণত যুবক বৃদ্ধ পুরুষ রমণী ৷
বলবান যদি, মহেষাস, আরাে আছে ৷
বীর এই পুরে ৷ যদি মন্ত্রণা-কুশল,
উদ্ধব বিপৃথু কঙ্ক মূখ কি তাহারা ৷
কে এই অদ্ভুত কৃষ্ণ আরাধ্য বিশ্বের?
ঊরেছে কি নারায়ণ আৰ্যত্রাতা জিষ্ণু
মানব শরীরে তবে ৷ গৃঢ় কি বাসব ৷
এই দেহে, আর যত দেবতা ত্রিদিবে ৷
নীচ গােপগৃহে জন্ম ৷ বাসুদেব শৌরি
বলি তারে, কিন্তু সত্য কে ভাবে নগরে
জন্মিয়াছে হেন মূর্তি দেবকীর গর্ভে ৷
গৌরবর্ণা অগ্রগণ্যা রূপসী-সমাজে
দেবকী, গৌরবদন বসুদেব যােদ্ধা,
গৌরবর্ণ বলরাম সারণ, শ্বেতাভ
গদ ৷ নীলমেঘ যেন শ্যাম কৃষ্ণমূৰ্ত্তি ৷
কে বা হেরিয়াছে জন্য বিখ্যাত শার্জীর ৷
বৃন্দাবন-লীলা জানে ভূমণ্ডল ৷ শিশু
দুরন্ত অবাধ্য ধূর্ত, বালক মায়াবী,
পরদারা সহ ক্রীড়া করিল মাধব
মধুরাত্রে – জিতেন্দ্রিয় অদ্ভুত-বিলাসী ৷
রমণী বসন-চোর নগ্ন চারু অঙ্গ
শত ললনার বশী হেরিল বলিয়া
সৰ্বপূজ্য কৃষ্ণ ৷ কংশে অপূৰ্ব্ব উপায়ে
বধিল নিজ-আলয়ে নহে রণক্ষেত্রে ৷
অধীশ্বর জরাসন্ধে ভীমসেন-ভুজে
রাজগৃহে ছদ্মবেশী পশিয়া বধিল
চক্রী ৷ ব্যহবিদ্যাপটু অগ্রগামী রণে
মানি বাসুদেব ৷ মােরা কি সহজে হঠি ৷
নাই কোন অন্তর আমাতে বাসুদেবে ৷
যাহা কৃষ্ণে তাহা আমি ৷ দেহে সকলের
বিরাজে একই আত্মা নিগূঢ় হৃদয়ে ৷
তবে কেন প্রণমিব অসংখ্য তেজস্বী
একের চরণে, যদুগণ ৷” বহিতেছে ৷
তেজস্বী ধাবিতবাণী উরুজিৎ মুখে
যেন বন্যা গঙ্গা-পানে ৷ কিন্তু ক্রমে উঠে
উগ্র কোলাহল যদুসভায় ৷ মাতিল
ভীম ক্রোধে কৃষ্ণ-বন্ধুগণ, হুঙ্কারিল
বিপক্ষ ঈর্ষায় হর্ষে ৷ গঞ্জি উরুজিতে
হুঙ্কারিল যদুজাতি ভীষণ আরাবে
কৃষ্ণ-নিন্দা অমর্ষণ, লক্ষ উগ্রকণ্ঠে
নিনাদিল ৷ ভীমশব্দে শিহরে নগরী ৷
শােভে কোলাহল মধ্যে উরুজিৎ বলী
বধির সমুদ্রনাদে উপল যেমতি
অটল, অচল ৷ শত সিংহকণ্ঠনাদে,
কোশ নিঃসরণপ্রার্থী-অসি-ঝনাটে,
ধ্বনিল মহতী সভা সমুদ্র যেমতি ৷
মিলে যবে বায়ুকুল উন্মত্ত আহবে ৷
উঠিল উদ্ধব জ্ঞানী ৷ থামিল হঠাৎ
কোলাহল সে গম্ভীর বদন-দর্শনে ৷
কহিল উদ্ধব ৷ “ঘনাইছে, বুঝিলাম,
যদুবংশনাশকাল যখন সভায়
উঠিয়া উদ্ধত যুবা নিন্দে গুরুজনে ৷
উরুজিৎ পাদযুগে শিখিতে বসিব
রাজনীতি? এস উঠ ত্যজি বাসুদেবে
লভিব শােভন নেতা, – প্রসেন তনয় ৷
অবিবেকী যুবগণ, যৌবন-উন্মাদে ৷
সৰ্বজ্ঞ আমরা ভাব ৷ অবহেলি বৃদ্ধে,
প্রাচীন রাজ্যশৃঙ্খলা ভাঙ্গি ছিড় তােরা
উল্লাসে নব্যতা প্রার্থী ৷ বানরও বৃক্ষে
তত পারে, মূখ ৷ যদি পরাক্রম দেহে,
যদি গূঢ়জ্ঞান মনে, গভীর হইবি ৷
নহে দেবতেজঃ এই আসুর-প্রবৃত্তি,
এই চঞ্চলতা, এই প্রীতি কোলাহলে ৷
উরুজিৎ দুঃসাহসী, জিজ্ঞাস মােদের
নত কেন কৃষ্ণপাদে সমুদায় জাতি ৷
বিরাজে একই আত্মা দেহে সকলের,
জানি ৷ কিন্তু গূঢ়বাসে সে তেজস ৷ মােহ
আবরে, আবরে রজঃ ৷ নাহি সকলেতে
অভেদে সমপ্রকাশ, নাহি সকলেতে ৷
পূর্ণমাত্রা পঞ্চকোশ প্লাবে দেবজ্যোতি ৷
আছে আরাে বীর পূরে, জানি উরুজিৎ ৷
আছে নীতিবিদ ৷ নাহি উষর জমিতে
জন্মে উচ্চশির বৃক্ষ শােভা পৃথিবীর ৷
যেথা মালতী যুথী, মল্লিকা যেথায়
চম্পক কিংশুক ফোটে সেথায় গােলাপ –
তাহারি সৌরভে কিন্তু উপবন রুচি ৷
কৃষ্ণ ভিন্ন কোথা কেহ নর ইতিহাসে
সৰ্বগুণ মানবের একদেহে মিলি
পূর্ণ বিকসিত ৷ মধুর গার্হস্থ্য ধর্মে
কে তুল্য কৃষ্ণের ৷ রমণীরমণ স্বামী
পিতা পিতামহ ভ্রাতা তনয় শ্বশুর ৷
আদর্শ গার্হস্থ্য ধৰ্ম্মে অদ্বিতীয় শৌরি ৷
রাজকাৰ্য প্রতিভায় কে বা অতিক্রমে
বৃষ্ণি গােপ্তা বাসুদেবে ৷ কে আঁটিবে তারে
ভীম রণে ৷ শুই উঠি কৃষ্ণের বচনে?
সমস্ত পৃথিবী, মুখ, তঁাহারি ইচ্ছায়
চালিত, চক্র যেমতি কুলালের হাতে ৷
ধৰ্ম্মগুরু ভারতের বাসুদেব শৌরি ৷
মহারথী যদুগণ কি ফল বিবাদে ৷
যুদ্ধার্থে আদেশে শার্জী ৷ যাহা বলে কৃষ্ণ,
তাহা ধৰ্ম্ম তাহা নীতি ৷ উঠ তবে সাজ
ভীমধনু সাপটিয়া সিংহনাদ করি মুখে
নিঃসর স্যন্দন-রােলে পূরব-উদ্দেশী ৷”
উত্তর করিল বৃদ্ধ হৃদীক উদ্ধবে ৷
“নাহি প্রশংসিব কভু যুবা উরুজিতে,
উদ্ধব ৷ নিন্দিল কৃষ্ণে মূখ রূক্ষভাষী ৷
জাতির রক্ষার্থে কিন্তু মন্ত্রণা সভায় ৷
নাই মঙ্গল সে রাজ্যে মন্ত্রণা-অভ্যাসে
বিরত যেথায় প্রজা, এক মহাস্কন্ধে ৷
অর্পে রাজ্যভার ৷ স্বতােজাত গুণ দেহে
বাড়ায় অভ্যাস-জাল, মরে অনভ্যাসে ৷
সরিলে সে স্কন্ধ আর নাই তুলিবার
ধূৰ্য্য দেশে ৷ অতএব দূরদর্শী রাজা
সতত সুগুণ খুঁজে প্রজার শরীরে ৷
লভিয়া বাড়ায় যত্নে মহাকাৰ্য্য সদা
পুষে যেন পটু মালী নবজাত তরু ৷
অপিয়া ঢাকে আপন কর্তৃত্ব নীতিজ্ঞ নৃপতি ৷ সতত
পুরস্কারে সিঞ্চে, কাটে অপগুণ ৷9
মহাসৃষ্টি অন্তরালে লুক্কায়েছে সম্ভ ৷
ভাবে জীব, আমি কৰ্ত্তা, সে ভ্রমে তেজস্বী
অগ্রসরে কর্মপথে, – সােপান মুক্তির ৷
‘কোথায় ঈশ্বর তব?’ জিজ্ঞাসে নাস্তিক
বিমূঢ় ৷ “নরকর্তৃত্ব মানব জীবনে,
নিয়মের কর্তৃত্ব চেষ্টায় প্রকৃতির,
কোথা স্থান সে স্থাণুর?” চিত্তে নাস্তিকের
নিগুঢ় হাসিছে ব্ৰহ্ম প্রত্যাখ্যানি ব্রহ্মে ৷
নহে জাতিহিত, কৃষ্ণ, দানব সমরে ৷
অতিদূরে সেই ভূমি ৷ বৎসরের পন্থা
যাইতে, ফিরিতে তত ৷ তারপরে মাঝে
বিশাল সে চীনভূমি বিস্তৃত, অধীন
দানবপতির ৷ রােধে যদি সেথা গতি
অগণন চীন প্রজা, কে বলিবে শৌরি
পছিব কবে মধুর দানবভূমি ৷
পহুছিব কি কভু ৷ নির্দয় উরুনাদী ৷
উত্তাল তরঙ্গে মাতি ফেনাময় সিন্ধু
ঘিরে দৈত্যদেশ, মধুবনের চৌদিকে
ভ্রমে শত সিংহ যথা ৷ কোথায় তরণী
পৰ্বত গুহার পথে উগ্রচণ্ডা দেবী ৷
কোথায় নাবিক যাতে দানব দ্বীপের
মলয় চুম্বিত তীরে নামে অনীকিনী ৷
মরিবে বালক কিন্তু সুদূর বিদেশে ৷
বহুদিন দূরদেশে বদ্ধ হবে সেনা ৷
ক্ষমিবে কি শত্রু অন্তহীন এই পুরী ৷
সহনীয় একজনের মরণ, শৌরি
নহে ধ্বংস জাতির ৷ সুভগ অনিরুদ্ধ,
সাধি লােকহিত, সাধি জন্মভূমি-রক্ষা
মরিবি দৈত্যাস্ত্রে, ক্ষত্রিয়ের স্পৃহনীয়
মুক্তিসম পরিণাম ৷ খুল্ল স্বর্গদ্বার
পাবি, ধাইবে অপ্সরা অনিন্দ্য রূপসী
শত শত তাের পানে হাসিয়া কহিবে
“মােরে মােরে ৷ বর মােরে স্বার্থত্যাগী যােদ্ধা
জন্মভূমি গৰ্ব এস, আমারি উরসে
রাখ রণক্লান্ত শির ৷” মধুর অধরে
চুম্বিবে টানিয়া বুকে মনােহরা চক্ষু
দিব্য করে আলিঙ্গিয়া দেবরাট নিজে
বসাবেন সিংহাসনে অনিরুদ্ধ বলী ৷
কহিল হৃদীক ৷ শব্দ মহতী সভায়
হৈল, যেন অরণ্যের মর্মর প্রভাতে
ভীমপক্ষ বিস্তারিয়া ধেয়ে যবে বায়ু ৷
উড়ানের বাতাসে কাপায় বনস্থলী ৷
উগ্রসেন সভামাঝে উঠিল নৃপতি ৷
কালভগ্ন মহাকায় কনীয়ান স্কন্ধে ৷
ভর দিয়া উঠিল সে বৃদ্ধ ৷ কষ্টে বাণী
শুনিল মহতী জাতি উরু সভাস্থলে ৷
হা লজ্জা হা অপকীৰ্ত্তি ৷ যাদব সভায়
কৃষ্ণনিন্দা হা ধিক! শুনিনু এ কুদিনে ৷
হায় কৃতঘ্নতা মানবের ৷ যে মাধব
ত্রাতা এ জাতির যে মাধবে সুখারূঢ়
যাদব-মহিমা যেন পৃথিবী অনন্তে,
তারি নিন্দা করে যাদব ৷ রে লজ্জা কোথা
প্রভাত রাতুল কান্তি লুক্কাও ত্রিদিবে ৷
ভুমণ্ডলে লুপ্ত মনােহারী তব পূজা,
দেবী ৷ ওহে স্বাধীন স্বাধীন ছিনু মােরা
যে গৰ্জ্জ কালে অকালে, বল তবে মােরে
হে স্বাধীন ভােজ জাতি, কি ছিলে তােমরা
বহুগত পুরাকালে ৷ বহুগত সদা
মর্ত্তে পুরাকাল ৷ স্তুতিপাঠক স্বভাবে
বৃদ্ধগণ প্রাচীনের, স্মৃতিরাগে তারা
রঞ্জে চিত্র ৷ পড়ে মনে যৌবন ওজস্বী
মধুর সে বাল্যকাল, ঘৃণায় সন্তাপে
হেরে পরে পলিত মূর্ধজ ভগ্নতনু ৷
জীর্ণ হৃদি অসমর্থ রভস-আস্বাদে ৷
সৰ্ব্বদোষ অতি স্নেহে আদ্রচিত্ত মুছে
সেকালের ৷ যারা নাহি হেরে প্রাচীনের
আরাে পক্ষপাতী তারা ৷ জানে দুঃখরাশি
একালে, সেকালে ভাবে ছিলই না, দুঃখ ৷
সােণার সময় ছিল পুরাতন যুগে ৷
স্বাধীনতা আছে মনে, সদা দলাদলি,
মনের অমিল সদা যাদব নগরে,
তাহা কি ভুলেছ ৷ শূরতায় বুদ্ধিতেজে
যদুকুলে কে আঁটিল বসুধায় কভু ৷
বৃথা কিন্তু মহাগুণ খ্যাতিহীন পাত্রে
সেই মহারথী মােরা, সেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি
কি নগণ্য ছিনু হায় বিশাল জীবনে ৷
ভারতের ৷ সুখী কিন্তু স্বাধীন স্ববলে
সদা ছিনু কৃতবর্মা ৷ হায় মন্দবুদ্ধি!
মহাবল বংশ যবে ভীষণ ওজসে
দমিল যাদব তেজঃ, ভীত মথুরায়
ভীম রুদ্রতেজে দিন দিন মথুরায়
পড়িল জল্লাদ হস্তে উচ্চশির যত,
পড়ে যেন ধান্য ক্ষেত্রে কাটে যবে চাষী,
ভাসিল নগর রক্তে, স্বাধীন তােমরা
নিবারিল কি তাহারে ৷ কৃষ্ণ নিবারিল
যারে নিন্দ আজি লঘুবক্তা সভাধামে ৷
যেই জাতি নেতৃভক্ত সম্পদে বিপদে
অটল গভীর দৃঢ় স্বাধীনতা তারে
আপনি আসিয়া ভজে, নমি রাজলক্ষ্মী
পৃথিবীর রাজদণ্ড সমর্পে চরণে ৷
বিজয় করিবে তারা অখিল পৃথিবী ৷
ভীমবলী সিন্ধু-উর্মি আদেশে ইন্দুর,
আগুসরে, হঠে পিছে ইন্দুর আদেশে
সিন্ধুগুণে সিন্ধুসম বিস্তার জাতির ৷
নিন্দাপ্রিয় স্বার্থপ্রিয় অবাধ্য উদ্ধত
কিন্তু মােরা ৷ অসহ্য হৃদয়ে পরযশ,
আদেশ বহন শিরে অসহ্য ৷ সকলি
নেতা, উচ্চস্থান প্রার্থী সকলি যাদবে ৷
উঠিতে যে অক্ষম পাড়িবে কিন্তু অন্যে ৷
কদিন রহিবে হায় দেবী স্বাধীনতা
হেন দেশে ৷ ঘৃণা করে অস্থিরে ভৈরবী ৷
ঘৃণা করে নীচাশয়ে ৷ সৰ্বোচ্চ গগনে
বিস্তারিতে মহাপক্ষ ভালবাসে দেবী ৷
বরং এই প্রার্থনা দেবতা-চরণে
করি সদা, যেন ধরে দৃঢ় করে জাতি
কৃষ্ণসম নিত্য কোন নৃরূপী দেবতা,
জাতি-দোষ রাখে ছাপি, পুষে জাতিগুণ,
চিরস্থায়ী হব মােরা মহান্ ভূতলে ৷
প্রশংস্য নহে কখন হৃদীকের উক্তি
তেজস্বী ক্ষত্রিয়ের কর্ণে অশ্রাব্য ৷ মরিবে
একাকী যাদব শত্ৰুপুরে? আশাসিত
হাসিয়া বাঁচিবে হন্তা? ধিক সে বদন
যাহা হতে ঘৃণ্য হেন বেরুল মন্ত্রণা ৷
হৃদীক! উন্মত্ত হলে বৃদ্ধকালে তুমি
ধ্বংসই জাতির শ্রেয়ঃ, নহে অপকীর্তি ৷
পৌঁছিব না কিন্তু ৷ কিন্তু উত্তাল তরঙ্গ
কিন্তু অগণন প্রজা পৃথু চীনদেশে
রুধিবে যাদবগতি ৷ বাপধন, মােরা
নহি মূখ সকলই নিয়ন্তা পুরীর ৷
মুরারির গুপ্তদূত ফেরে দেশে দেশে
অতন্দ্ৰিত, যেন সূৰ্য্য, – সৰ্বসাক্ষী-অগ্নি, –
হেরে’ কৰ্ম্ম অপকৰ্ম্ম নরের ভূতলে ৷
পৃথিবীর দূর কোণে আসীন মাধব,
কিন্তু নাই সে রহস্য, নাই সে মন্ত্রণা
গুপ্তদূতে কৃষ্ণ চক্ষু যাহা নাই হেরে,
গুপ্তদুতে কৃষ্ণ কর্ণ যাহা নাই শুনে –
অতন্দ্ৰিত গােপ্তা শৌরি ৷ জানিয়াছি, প্রজা
অসন্তুষ্ট চীনদেশে, ঘােরে সদা মনে
বিদ্রোহ বাসনা, গুপ্ত সমিতি সহস্র
জাগে অন্ধকারে যেন হিংস্র পশু বনে ৷
ছাড়িবে চীনেরা পন্থা, খাদ্য বাসভূমি
দিবে পুরে পুরে ৷ মহােদধি-তীরবাসী
মঙ্গল তরণী দিবে তরিতে জলধি,
যাইবে নাবিক তারা দানববিদ্বেষে ৷
তাহা ছাড়া জানিয়াছি দৃপ্ত চিরজয়ে ৷
দানব ৷ অতি বৈভবে, অতল বিলাসে
ডুবিয়াছে বুদ্ধি ৷ লুটে রাজ্যধন মন্ত্রী ৷
স্বার্থে অর্থলােভে পচে হৃদয় জাতির,
আত্ম-অভিমান ফেলেছে চিতায় ৷ সৈন্যে
নাই যােগ্য সেনাপতি ৷ জীর্ণ-দেহ-বুদ্ধি
অক্ষম পলিতকেশা বহুরণে যারা
দৈত্য, প্রতিদ্বন্দ্বী-শূন্যা করিল ধরারে ৷
নবীন সেনানী যত কেনে বেচে তারা
দানব-গৌরব, পটু উৎকোচ-বিদ্যায়,
নহে ব্যুহরচনায়, নহে সৈন্যযানে ৷
অতএব উঠি মােরা ভীম অভিযানে
ভাঙ্গি দৈত্যবল ৷ তিন ভাগে বিরাজিবে
বিভক্ত যাদব শক্তি ৷ তিন লক্ষ সৈন্য
মােরা ৷ এক-লক্ষ-নেতা বিক্রান্ত সারণ
রক্ষিবে এ পুরী নিত্য ৷ এক লক্ষ সেনা
আস্ফালিবে বলরাম যেন নগ্ন অসি
শত্রুমুখে আৰ্য্যাবৰ্ত্তে, সঙ্গে মহারথী
সমীক, সুধন্বা, সাম্ব, কঙ্ক, মহেশ্বাস,
অনাবৃষ্টি ৷ দৈত্যভূমি যাবে এক লক্ষ
কৃষ্ণনীতা মহাচমূ, প্রদ্যুম্ন, সাত্যকি,
অন্ধক, সমিতিঞ্জয়, চারুদেষ্ণ যােদ্ধা
কৃতবর্মা উরুজিৎ সারণ সুমনা
অক্রুর, সুসেন, গদ ৷ অর্ধ-মাস-খাদ্য
নিবে সৈন্য তৃর্ণচক্রে পথবাহী ৷ আছে
মিত্ররাজ্য পথে, আছে ইন্দ্রপ্রস্থ, আছে
পাঞ্চাল ৷ তিব্বত-রাজা খােরাক ও অশ্ব
দিবে যথা সাধ্যে ৷ পরে পৃথু চীনদেশে
স্বচ্ছন্দে স্বগৃহে যথা এক কক্ষ হতে
যায় আর এক কক্ষে ধনবান গৃহী ৷
মধুর দানবদ্বীপে উতরিবে শেষে
বাহি অবিপন্ন পােতে শান্ত মহােদধি ৷”
উত্তর করিল বৃদ্ধ হৃদীক ভূপালে ৷
“উগ্রসেন সৰ্ব্বপূজ্য, নহে অসাধ্যে
মহারম্ভ শ্রেয়ঃ, ভাবি হিতার্থে জাতির
যুদ্ধ নিষেধিনু ৷ তবে যদি জানে শৌরি
গূঢ় কথা অলক্ষ্যে বৃদ্ধজনের, সাধ্য
যদি এ দুষ্কর লক্ষ্য, রুধিব না তারে ৷
গােপ্তা যদু সন্ততির এক বাসুদেব শৌরি ৷”
উত্তর করিল উঠি কৃষ্ণ মহাযশা ৷
“মহাজ্ঞানী কৃতবর্মা, মনীষী হৃদীক
হেরি চারিদিক জ্ঞানী সাহস আচরে ৷
প্রার্থনীয় মানবের শান্তি, কৃতবর্মা,
মানি, কিন্তু নাই শান্তি মানবের ভাগ্যে ৷
ইচ্ছা করে কি কঙ্ক ভজিল অশান্তি
হৃদয়ে মানব? একান্ত সে ভজে শান্তি ৷
প্রবলা নিয়তি কিন্তু, কিন্তু হৃদি মাঝে
কি নিগুঢ়া মহাশক্তি ঠেলে মহাবলে
কৰ্ম্ম ৷ প্রাণী মাত্র যে অলস ভীরু
অবহেলে, সে প্রেরণা নাই মুক্তি তার
ইহলােকে পরলােকে দুর্বলের শ্রেয়ঃ
কোথা জগে ৷ ঘূণে জড় সৃষ্টি, দলে জীব
ইহকালে, পরকালে প্রত্যাখ্যানে সম্ভ ৷
নাই আরােহণ যােগ সােপানে ভীরুর,
বিনা যােগে অবিধেয় সন্ন্যাস মানবে,
মিথ্যাচার মাত্র ৷ দুই মার্গ মানবের
প্রচারে ব্রাহ্মণ ভ্রান্তলক্ষ্য করি লােকে ৷
শান্তি শান্তি বলে কেহ, শান্তি ভূমণ্ডলে,
একই আশ্রয় কৰ্ম্ম ঘােষায় অপরে ৷
কিন্তু যে প্রশংসে শান্তি শুনিবে না তারে,
মিথ্যা উক্তি, বলহীন করে প্রজাগণে ৷
কোথা শান্তি এই ভবে? ঈশ্বরেই শান্তি ৷
যতদিন ভবক্ষেত্রে বিচর, মানব,
কৰ্ম্ম কর সদা, খাট অতন্দ্রিত মনে
নিষ্কাম উদ্যোগে ৷ সূৰ্য্য গগনে উদিয়া
কৰ্ম্ম করি অতন্দ্রিত ভুবন আলােকে,
কৰ্ম্মবলে অহােরাত্রী বিধান করিয়া
চরাচর বন্ধু দিনকর মহাতেজী ৷
অতন্দ্ৰিত উদে চন্দ্র শীতল কিরণে,
অতন্দ্রিত ভাতে তারা অন্ধ নভস্তলে ৷
অতন্দ্রিত ছুটে বায়ু স্বেচ্ছায় ভ্রমিয়া
ঘােষমাণ মাতরিশ্বা অসীম আকাশে ৷
কৰ্ম্মবলে ভাতে স্বর্গে অসংখ্য দেবতা
কৰ্ম্মবলে সপ্ত ঋষি ভাতে অন্তরীক্ষে ৷
কৰ্ম্মবলে বহে পূতা তুষিতে মানবে
স্বাদু সুশীতল নীরে তরঙ্গিনী নদী ৷
ঘুরিয়া পৃথিবী দেবী অনাশ্রয় শূন্যে
কৰ্ম্মবলে নহে ক্লিষ্ট এ মহৎ ভারে ৷
কৰ্ম্মবলে সৰ্ব্বসুখ ত্যজিয়া বাসব
সমতা তিতিক্ষা ধর্ম আচরিয়া তেজে
সুরেশ্বর আখণ্ডল দম্ভোলী নিক্ষেপী
দিগ্মণ্ডল নাদাইয়া গগন আলােকে,
বর্ষায় মেদিনীবক্ষে শস্যার্থে হিতৈষী ৷
কৰ্ম্মবলে ক্ষত্ৰধৰ্ম্ম ক্ষত্রিয় আচরে ৷
নিষ্কর্মা বসিয়া গৃহে যে মানব ভাবে
শান্ত রব কোণে পড়ি, ক্ষমিবে অরাতি,
অতিভ্রান্ত সেই ৷ বাঁচে যে বিধিল আগে
অরিবক্ষঃ ৷ না আক্রমি মজিবে আক্রান্ত
প্রকৃতি নিয়ম জান তারে কে লংঘে ৷
কিন্তু কোথা স্থায়িত্ব মৰ্ত্ত ভূমণ্ডলে ৷
বাড়ে কেহ, কমে কেহ, নাহি রহে স্থায়ী ৷
অতএব যে না বাড়ে, কমিবে নিশ্চয়,
কৃতবর্মা ৷ ক্রুর শত্রু দাস তারে করি
খাটাবে বধিয়া শক্তি, ডুবাবে নিষ্ঠুর ৷
সৰ্বসুখ ক্রমে ৷ প্রিয় ভাৰ্য্যাপুত্র সঙ্গে
তুলিবে সলিল কুণ্ডে পরের সুখার্থে
বহিবে অভাগা ভাররাশি প্রভু অর্থে
চষিবে প্রিয় স্বক্ষেত্র ৷ এর চেয়ে কহ
কি অসহ্য কি নিষ্ঠুর ভাগ্য ভূমণ্ডলে ৷
হত হবে পুত্রগণ রাজমার্গে, খড়ঙ্গ
না তুলিলে দাস ৷ ভােগ্যা হবে ভগিনী ভাৰ্য্যা
জেতার ৷ হেরিবে সে স্বচক্ষে, না আক্রমিবে গােলাম ধর্ষকে ৷
কিন্তু বলে কেহ যার দয়াপূর্ণ উক্তি
পজে অর্থ এই নরজাতি “পাপী অরিহন্তা অধীরে
পাপী যার হাত রক্তে কলুষিত রণে,
মারে যদি শত্ৰু, হেঁট মাথা কহ তারে
পুনঃ মার মােরে, বন্ধু ৷ ইহা ধৰ্ম্ম ইহা
প্রিয় ঈশ্বরের ৷” হায় দয়াবান মনু,
মুখে বলে ইহা সত্য, কে আচরে কার্য্যে ৷
হে বিমূঢ় নরগণ, অভীপ্সিত যদি
নিরীহতা ঈশ্বরের, সর্বজ্ঞ নিয়ন্তা
দাস হতে যদি সৃজে তেজস্বী মানবে
বাড়িত সুগুণ দাস্যে ৷ বিপরীত ফল
ভবে কিন্তু হেরি ৷ একদিনের দাসত্বে
মনুষ্যত্ব যায় চলি নিশ্চেষ্ট দাসের ৷
নিন্দাপ্রিয় মিথ্যাবাদী কাপুরুষ ধূৰ্ত্ত
সৰ্ব্বদোষ জন্মে ক্রমে ৷ বিষ্ঠার কৃমি
বিষ্ঠা ভালবাসে ৷ ইষ্টদেব করি দেহে
সুখস্বার্থ খুঁজে সদা ৷ একতা, সর্বোচ্চ
মনুষ্যত্ব যাহা মর্ত্তে, মজে সেই পঙ্কে ৷
বিরল প্রতিভা জন্মে দাসীভূত দেশে
নিরীহ না ভুঞ্জে কভু মহত্ত্ব ৷ সুপ্রিয়
নহে ঈশ্বরের কভু দাসত্বে নিবৃতি ৷
কৰ্ম্মলােভী উচ্চমনা মহত্ত্ব প্রয়াসী ৷
সৃজিল নিয়ন্তা নরে ৷ উঠ, কৃতবর্মা,
আর একবার যুদ্ধে পশি পেঁাহে, রণসখা,
সহায় বিজয়ে তীব্র তেজস্বিতা যুদ্ধে
দর্শাও, সাহসী যােদ্ধা কে নেতা জাতির
বৃথা কেন সে বিবাদে ৷ মহাযশ নেতা
যাদবের, ধৰ্ম্ম নেতা মন্ত্রণে আহবে ৷
বহুদিন শান্তি পুরে বিরাজিল ৷ পুনঃ
সুমহৎ দেবকৰ্ম্ম ডাকিল সমরে
বহুল-আয়াসী জাতি ৷ নিরস আলস্যে
নিষ্কর্মা পচিতে আৰ্য জনমে না কভু
যতক্ষণ আলাে নেত্রে, কৰ্ম্ম করি মােরা ৷
রজনী আসিছে শীঘ্র, প্রগাঢ় নিদ্রায় ৷
বিশ্রাম লভিব পড়ি জননীর কোলে ৷”
কহিল মাধব ৷ পৃথুচারী মহানাদে
বাখানিল কৃষ্ণ উক্তি সৌরসেন সভা
সমর উল্লাসে ৷ উঠে আনকদুন্দুভি
শূরপুত্র মহারথী যদুসভাগৃহে ৷
“উগ্রসেন যদুরাজা, গ্রহিয়াছে উক্তি
সৌরসেন রথীগণ সম্পূর্ণ সভায় ৷
দাও অনুমতি, নৃপ, যুদ্ধার্থে রথীরা
প্রণমি বিদায় নিবে পিতৃগণপাদে ৷
যাও, যুবা; উচ্চশির মাতার চরণে
কহ রাখি আশিস, জননী যাব যুদ্ধে
হাসি মুখে অনুজ্ঞাপ, স্বদেশ কল্যাণ
সাধিতে স্বরক্তে ৷ যাও প্রৌঢ় মহারথী,
বাল্যের সঙ্গিনী, যৌবনের সখী গৃহে
অমাত্য প্রৌঢ়াবস্থায়, কহ হাত ধরি
‘যাইব, জীবিত মম, দূরদেশ যুদ্ধে ৷
লভ যদি রণে গতি; প্রশান্ত মানসে
রহ গৃহে, পুত্রগণে পাল, আমাদের
সে প্রণয় অনশ্বর, সান্ত্বন বৃদ্ধ মাতারে;
পিতৃমুখ স্মরি সদা; পিতৃপদ চিহ্ন
শিখাও অনুসরিতে যাদব সন্ততি ৷
ইন্দ্ৰসিংহাসন রশ্মি-দ্যোতিত নন্দনে
হইবে সাক্ষাৎ পুনঃ, বীরজায়া দেবী ৷
আনন্দের দিন আজি দ্বারিকা নগরে
ধৰ্ম্মযুদ্ধে যাইবে রথীরা ৷ উঠ, নৃপ
প্রতীক্ষা করিছে আজ্ঞা সৌরসেন-জাতি ৷”
উঠিল স্থবির যেন পৰ্বত সভাতে
উগ্রসেন মহাকায় ৷ শত-যুদ্ধ-সঙ্গী
ভীম অসি উলঙ্গিয়া ফেলিল ভূতলে ৷
ঝনঝনিল বিখ্যাত অস্ত্র যেন হর্ষে ৷ ঘােষি
উঠিল যাদব সভা উরু সিংহনাদে
যুদ্ধ যুদ্ধ হুংকারিল যাদব মাতিয়া,
বাজাইয়া অসি কোশে ৷ অস্ত্র ঝঋনাটে
হর ববম্বম-রােলে পূরিল নগরী,
শিহরিল আকাশ আৰ্য্যের সিংহনাদে ৷
উঠিছে উদ্ধব মন্ত্রী, উঠিছে হৃদীক,
কৃষ্ণ বলরাম গদ, উঠিছে সাত্যকি ৷
ভাঙ্গিল মহতী সভা দ্বারিকা নগরে ৷

ইতি উষাহরণকাব্যে সভানাম অষ্টম সর্গ সমাপ্ত ৷









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates