CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




কারাকাহিনী




কারাগৃহ ও স্বাধীনতা

মনুষ্যমাত্রেই প্রায় বাহ্য অবস্থার দাস, স্থূলজগতের অনুভূতির মধ্যেই আবদ্ধ ৷ মানসিক ক্রিয়াসকল সেই বাহ্যিক অনুভূতিকেই আশ্রয় করে, বুদ্ধিও স্কুলের সঙ্কীর্ণ সীমা লঙ্ঘন করিতে অক্ষম; প্রাণের সুখদুঃখ বাহ্য ঘটনার প্রতিধ্বনি মাত্র ৷ এই দাসত্ব শরীরের আধিপত্যজনিত ৷ উপনিষদে বলা হইয়াছে, “জগৎস্রষ্টা স্বয়ম্ভু শরীরের দ্বারসকল বহির্মুখীন করিয়া গড়িয়াছেন বলিয়া সকলের দৃষ্টি বহির্জগতে আবদ্ধ, অন্তরাত্মাকে কেহও দেখে না ৷ সেই ধীরপ্রকৃতি মহাত্মা বিরল যিনি অমৃতের বাসনায় ভিতরে চক্ষু ফিরাইয়া আত্মাকে প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন ৷” আমরা সাধারণতঃ যে বহির্মুখীন স্থূলদৃষ্টিতে মনুষ্যজাতির জীবন দেখি, সেই দৃষ্টিতে শরীরই আমাদের মুখ্য সম্বল ৷ য়ুরােপকে যতই না জড়বাদী বলি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যমাত্রই জড়বাদী ৷ শরীর ধর্ম সাধনের উপায়, আমাদের বহু-অশ্বযুক্ত রথ, যে দেহ-রথে আরােহণ করিয়া আমরা সংসার পথে ধাবিত হই ৷ আমরা কিন্তু দেহের অযথার্থ প্রাধান্য স্বীকার করিয়া দেহাত্মকবুদ্ধিকে এমন প্রশ্রয় দিই যে বাহ্যিক কৰ্ম্ম ও বাহ্যিক শুভাশুভ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ হইয়া থাকি ৷ এই অজ্ঞানের ফল জীবনব্যাপী দাসত্ব ও পরাধীনতা ৷ সুখদুঃখ শুভাশুভ সম্পদবিপদ আমাদের মানসিক অবস্থাকে নিজের অনুযায়ী করিতে সচেষ্ট ত হয়ই, আমরাও কামনার ধ্যানে সেই স্রোতে ভাসিয়া যাই ৷ সুখলালসায় দুঃখভয়ে পরের আশ্রিত হই, পরের দত্ত সুখ, পরের দত্ত দুঃখ গ্রহণ করিয়া অশেষ কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভােগ করি ৷ কেন না, প্রকৃতি হৌক বা মনুষ্য হৌক, যে আমাদের শরীরের উপর কিঞ্চিত্র আধিপত্য করিতে পারে কিম্বা নিজ শক্তির অধিকারক্ষেত্রে আনিতে পারে, তাহারই প্রভাবের অধীন হইতে হয় ৷ ইহার চরম দৃষ্টান্ত শত্রুগ্রস্ত বা কারাবদ্ধের অবস্থা ৷ কিন্তু যিনি বন্ধুবান্ধববেষ্টিত হইয়া স্বাধীনভাবে মুক্ত আকাশে বিচরণ করেন, কারাবদ্ধের ন্যায় তাহারও এই দুর্দশা ৷ শরীরই কারাগৃহ, দেহাত্মকবুদ্ধিরূপ অজ্ঞানতা কারারূপ শত্রু ৷

এই কারাবাস মনুষ্যজাতির চিরন্তন অবস্থা ৷ অপরপক্ষে সাহিত্য ও ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় মনুষ্যজাতির স্বাধীনতালাভাৰ্থ অদমনীয় উচ্ছাস ও প্রয়াস দেখিতে পাই ৷ যেমন রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষেত্রে, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে যুগে যুগে এই চেষ্টা ৷ আত্মসংযম, আত্মনিগ্রহ, সুখদুঃখবৰ্জন, Stoicism, Epicu-reanism, Asceticism, বেদান্ত, বৌদ্ধধৰ্ম্ম, অদ্বৈতবাদ, মায়াবাদ, রাজযােগ, হঠযােগ, গীতা, জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, কৰ্ম্মমার্গ, – নানা পন্থা একই গম্যস্থান ৷ উদ্দেশ্য শরীর জয়, স্কুলের আধিপত্য বর্জন, আন্তরিক জীবনের স্বাধীনতা ৷ পাশ্চাত্য বিজ্ঞানবিদগণ এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে স্থলজগৎ ভিন্ন অন্য জগৎ নাই, স্কুলের উপর সূক্ষ্ম প্রতিষ্ঠিত, সূক্ষ্ম অনুভব স্থূল অনুভবের প্রতিকৃতি মাত্র, মনুষ্যের স্বাধীনতা-প্রয়াস ব্যর্থ; ধৰ্ম্মদর্শন বেদান্ত অলীক কল্পনা, সম্পূর্ণ ভূপ্রকৃতি-আবদ্ধ আমাদের সেই বন্ধনমােচনে বা ভূতপ্রকৃতির সীমা উলঙ্ঘনে মিথ্যা চেষ্টা ৷ কিন্তু মানবহৃদয়ের এমন গূঢ়তর স্তরে এই আকাঙ্ক্ষা নিহিত যে সহস্র যুক্তিও তাহা উন্মলন করিতে অসমর্থ ৷ মনুষ্য বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তে কখনও সন্তুষ্ট থাকিতে পারে না ৷ চিরকাল মনুষ্য অস্পষ্ট রূপে অনুভব করিয়া আসিতেছেন যে স্থূলজয়ে সমর্থ সূক্ষ্মবস্তু তাহার অভ্যন্তরে দৃঢ়ভাবে বর্তমান, সূক্ষ্মময় অধিষ্ঠাতা নিত্যমুক্ত আনন্দময় পুরুষ আছেন ৷ সেই নিত্যমুক্তি ও নির্মল আনন্দলাভ করা ধৰ্ম্মের উদ্দেশ্য ৷ এই যে ধর্মের উদ্দেশ্য, সেই বিজ্ঞানকল্পিত evolution-এরও উদ্দেশ্য ৷ বিচারশক্তি ও তাহার অভাব পশু ও মনুষ্যের প্রকৃত ভেদ নহে ৷ পশুর বিচারশক্তি আছে, কিন্তু পশুদেহে তাহার উৎকর্ষ হয় না ৷ পশু মনুষ্যের প্রকৃত ভেদ এই যে শরীরের নিকট সম্পূর্ণ দাসত্ব স্বীকার পাশবিক অবস্থা, শরীর জয় ও আন্তরিক স্বাধীনতার চেষ্টাই মনুষ্যত্ব বিকাশ ৷ এই স্বাধীনতাই ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য, ইহাকেই মুক্তি বলে ৷ এই মুক্ত্যর্থে আমরা অন্তঃকরণস্থ মনােময় প্রাণশরীরনেতাকে জ্ঞানদ্বারা চিনিতে কিম্বা কৰ্ম্মভক্তিদ্বারা প্রাণ মন শরীর অর্পণ করিতে সচেষ্ট হই ৷ “যােগস্থঃ কুরু কৰ্ম্মাণি” বলিয়া গীতার যে প্রধান উপদেশ এই স্বাধীনতাই সেই গীতােক্ত যােগ ৷ আন্তরিক সুখদুঃখ যখন বাহ্যিক শুভাশুভ সম্পদবিপদকে আশ্রয় না করিয়া স্বয়ংজাত, স্বয়ংপ্রেরিত, স্বসীমাবদ্ধ হয়, তখন মনুষ্যের সাধারণ অবস্থার বিপরীত অবস্থা হয়, বাহ্যিক জীবন আন্তরিক জীবনের অনুযায়ী করা যায়, কৰ্ম্মবন্ধন শিথিল হয় ৷ গীতার আদর্শ পুরুষ কৰ্ম্মফলে আসক্তি ত্যাগ করিয়া পুরুষােত্তমে কৰ্ম্মসন্ন্যাস করেন ৷ তিনি “দুঃখেনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ” আন্তরিক স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া আত্মরতি ও আত্মসন্তুষ্ট হইয়া থাকেন ৷ তিনি প্রাকৃত লােকের ন্যায় সুখলালসায় দুঃখভয়ে কাহারও আশ্রিত হন না, পরের দত্ত সুখদুঃখ গ্রহণ করেন না, অথচ কৰ্ম্মভােগ করেন না ৷ বরং মহাসংযমী মহাপ্রতাপান্বিত দেবাসুর যুদ্ধে রাগ ভয় ক্রোধাতীত মহারথী হইয়া ভগবৎপ্রেরিত যে কর্মযােগী রাষ্ট্রবিপ্লব ধৰ্ম্মবিপ্লব অথবা প্রতিষ্ঠিত রাজ্য ধৰ্ম্ম সমাজ রক্ষা করিয়া নিষ্কাম ভাবে ভগবৎকৰ্ম্ম সুসম্পন্ন করেন, তিনি গীতার শ্রেষ্ঠ পুরুষ ৷

আধুনিক যুগে আমরা নূতন পুরাতনের সন্ধিস্থলে উপস্থিত ৷ মানুষ বরাবরই তাহার গন্তব্যস্থানে অগ্রসর হইতেছেন, সময় সময়ে সমতল ভূমি ত্যাগ করিয়া উচ্চে আরােহণ করিতে হয়, এবং সেইরূপ আরােহণ সময়ে রাজ্যে সমাজে ধর্মে জ্ঞানে বিপ্লব হয় ৷ বর্তমানকালে স্থূল হইতে সূঘ্নে আরােহণ করিবার উদ্যোগ চলিতেছে ৷ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতগণ স্থূলজগতের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা ও নিয়ম নির্ধারণ করায় আরােহণমার্গের চতুঃপার্শ্বস্থ সমতল ভূমি পরিষ্কার হইয়াছে ৷ সূক্ষ্মজগত্রে বিশাল রাজ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞানীদিগের প্রথম পদক্ষেপ হইতেছে, অনেকের মন সেই রাজ্য জয়ের আশায় প্রলুব্ধ ৷ ইহা ভিন্ন অন্য অন্য লক্ষণ দেখা যাইতেছে – যেমন অল্প দিনে থিয়সফির বিস্তার, আমেরিকায় বেদান্তের আদর, পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্রে ও চিন্তাপ্রণালীতে ভারতবর্ষের পরােক্ষভাবে কিঞ্চিৎ আধিপত্য ইত্যাদি ৷ কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষণ ভারতের আকস্মিক ও আশাতীত উত্থান ৷ ভারতবাসী জগতের গুরুস্থান অধিকার করিয়া নূতন যুগ প্রবর্তন করিতে উঠিতেছেন ৷ তাঁহার সাহায্যে বঞ্চিত হইলে পাশ্চাত্যগণ উন্নতি-চেষ্টায় সিদ্ধকাম হইতে পারিবেন না ৷ যেমন আন্তরিক জীবনবিকাশের সর্বপ্রধান উপায়স্বরূপ ব্রহ্মজ্ঞান তত্ত্বজ্ঞান ও যােগাভ্যাসে ভারত ভিন্ন অন্য কোন দেশ উৎকর্ষলাভ করে নাই, তেমনই মনুষ্যজাতির প্রয়ােজনীয় চিত্তশুদ্ধি ইন্দ্রিয়সংযম ব্রহ্মতেজ তপঃক্ষমতা ও নিষ্কাম কর্মযােগশিক্ষা ভারতেরই সম্পত্তি ৷ বাহ্য সুখদুঃখকে তাচ্ছিল্য করিয়া আন্তরিক স্বাধীনতা অর্জন ৷ করা ভারতবাসীরই সাধ্য, নিষ্কাম কৰ্ম্মে ভারতবাসীই সমর্থ, অহঙ্কার-বর্জন ও কর্মে নির্লিপ্ততা তঁাহারই শিক্ষা ও সভ্যতার চরম উদ্দেশ্য বলিয়া জাতীয় চরিত্রে বীজরূপে নিহিত ৷

এই কথার যাথার্থ্য প্রথম আলিপুর জেলে অনুভব করিলাম ৷ এই জেলে প্রায়ই চোর ডাকাত হত্যাকারী থাকে ৷ যদিও কয়েদীর সঙ্গে আমাদের কথা কহা নিষিদ্ধ, তথাপি কাৰ্যতঃ এই নিয়ম সম্পূর্ণ পালন করা হইত না, তাহা ছাড়া রাঁধুনী পানিওয়ালা ঝাড়ুদার মেহতর প্রভৃতি, যাহাদের সংস্রবে না আসিলে নয়, তাহাদের সঙ্গে অনেক সময় অবাধে বাক্যালাপ হইত ৷ যাঁহারা আমার এক অপরাধে অপরাধী বলিয়া ধৃত, তাহারাও নৃশংস হত্যাকারীর দল প্রভৃতি দুশ্রাব্য বিশেষণে কলঙ্কিত ও নিন্দিত ৷ যদি কোনও স্থানে ভারতবাসীর চরিত্র ঘৃণার চক্ষে দেখিতে হয়, যদি কোন অবস্থায় তাহার নিকৃষ্ট অধম ও জঘন্য ভাবের পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়, তবে আলিপুর জেলই সেই স্থান, আলিপুরে কারাবাসই সেই নিকৃষ্ট হীন অবস্থা ৷ আমি এই স্থানে এই অবস্থায় বার মাস কাটাইলাম ৷ এই বার মাস অনুভবের ফলে, ভারতবাসীর শ্রেষ্ঠতা সম্বন্ধে দৃঢ় ধারণা, মনুষ্য চরিত্রের উপর দ্বিগুণ ভক্তি এবং স্বদেশের ও মনুষ্যজাতির ভবিষ্যৎ উন্নতি ও কল্যাণের দশগুণ আশা লইয়া কর্মক্ষেত্রে ফিরিয়া আসিয়াছি ৷ ইহা আমার স্বভাবজাত optimism অথবা অতিরিক্ত বিশ্বাসের ফল নহে ৷ শ্রীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পাল বক্সার জেলে ইহা অনুভব করিয়া আসিয়াছিলেন, আলিপুর জেলের ভূতপূর্ব ডাক্তার ডেলি সাহেবও ইহা সমর্থন করিতেন ৷ ডেলি সাহেব মনুষ্যচরিত্রে অভিজ্ঞ সহৃদয় ও বিচক্ষণ লােক, মনুষ্য চরিত্রের নিকৃষ্ট ও জঘন্য বৃত্তি সকল প্রত্যহ তাহার সম্মুখে বিদ্যমান, অথচ তিনি আমাকে বলিতেন, “ভারতের ভদ্রলােক বা ছােটলােক, সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বা জেলের কয়েদী যতই দেখি ও শুনি, আমার এই ধারণা দৃঢ় হয় যে চরিত্রে ও গুণে তােমরা আমাদের চেয়ে ঢের উচু ৷ এই দেশের কয়েদী ও য়ুরােপের কয়েদীতে আকাশ-পাতাল তফাৎ ৷ এই ছেলেদের দেখে আমার এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে ৷ এদের আচরণ চরিত্র ও নানা সদগুণ দেখে কে কল্পনা করতে পারে যে এরা Anarchist বা হত্যাকারী ৷ তাদের মধ্যে ক্রুরতা উদ্দামভাব অধীরতা বা ধৃষ্টতা কিছুমাত্র না দেখে সব উল্টাগুণই দেখি ৷” অবশ্যই জেলে চোর ডাকাত সাধুসন্ন্যাসী হয় না ৷ ইংরাজের জেল চরিত্র শুধরাইবার স্থান নহে, বরং সাধারণ কয়েদীর পক্ষে চরিত্রহানি ও মনুষ্যত্বনাশের উপায়মাত্র ৷ তাহারা যে চোর ডাকাত খুনী ছিল, সেই চোর ডাকাত খুনীই থাকে, জেলে চুরি করে, শক্ত নিয়মের মধ্যেও নেশা করে, জুয়াচুরি করে ৷ তাহা হইলে কি হইবে, ভারতবাসীর মনুষ্যত্ব গিয়াও যায় না ৷ সামাজিক অবনতিতে পতিত, মনুষ্যত্বনাশের ফলে নিষ্পেষিত, বাহিরে কালিমা কদৰ্য্যভাব কলঙ্ক বিকতি, তথাপি ভিতরে সেই লপ্তপ্রায় মনুষ্যত্ব ভারতবাসীর মজ্জাগত সদগুণে লুকাইয়া আত্মরক্ষা করে, পুনঃ পুনঃ কথায় ও আচরণে তাহা প্রকাশ পায় ৷ যাঁহারা উপরের কাদাটুকু দেখিয়া ঘৃণায় মুখ ফিরাইয়া লন, তাহারাই বলিতে পারেন যে ইহাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র দেখিতে পাই নাই ৷ কিন্তু যিনি সাধুতার অহঙ্কার ত্যাগ করিয়া নিজ সহজসাধ্য স্থিরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন, তিনি এই মতে কখনও মত দিবেন না ৷ ছয় মাস কারাবাসের পরে শ্ৰীযুত বিপিনচন্দ্র পাল বক্সার জেলে চোর ডাকাতের মধ্যেই সর্ঘটে নারায়ণকে দর্শন করিয়া উত্তরপাড়ার সভায় মুক্তকণ্ঠে এই কথা স্বীকার করিয়াছিলেন ৷ আমিও আলিপুর জেলেই হিন্দুধৰ্ম্মের এই মূলতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলাম, চোর ডাকাত খুনীর মধ্যে সর্বপ্রথম মনুষ্য দেহে নারায়ণকে উপলব্ধি করিলাম ৷

এই দেশে কত শত নিরপরাধ ব্যক্তি দীর্ঘকাল জেলরূপ নরকবাস ভােগ দ্বারা পূৰ্ব্বজন্মার্জিত দুষ্কৰ্ম্মফল লাঘব করিয়া তাহাদের স্বর্গপথ পরিষ্কার করিতেছেন ৷ কিন্তু সাধারণ পাশ্চাত্যবাসীগণ যাঁহারা ধর্মভাব দ্বারা পূত ও দেবভাবাপন্ন নহেন, তাঁহারা এইরূপ পরীক্ষায় কতদূর উত্তীর্ণ হন, যাঁহারা পাশ্চাত্য দেশে রহিয়াছেন বা পাশ্চাত্য চরিত্র-প্রকাশক সাহিত্য পড়িয়াছেন, তাহারাই সহজে অনুমান করিতে পারেন ৷ এরূপ স্থলে হয়ত তাহাদের নিরাশাপীড়িত, ক্রোধ ও দুঃখের অশ্রুজলপুত হৃদয় পার্থিব নরকের ঘাের অন্ধকারে এবং সহবাসীদের সংস্রবে পড়িয়া তাহাদেরই ক্রতা ও নীচবৃত্তি আশ্রয় করে; – নয়ত দুর্বলতার নিরতিশয় নিষ্পেষণে বল বুদ্ধি হীন হইয়া তাহাতে মনুষ্যের নষ্টাবশেষ মাত্র অবশিষ্ট থাকে ৷

আলিপুরের একজন নিরপরাধীর কথা বলি ৷ এ ব্যক্তি ডাকাতিতে লিপ্ত বলিয়া দশ বৎসর সশ্রম কারাবাসে দণ্ডিত ৷ জাতে গােয়ালা, অশিক্ষিত, লেখাপড়ার ধার ধারে না, ধৰ্ম্মসম্বলের মধ্যে ভগবানে আস্থা ও আৰ্য্যশিক্ষাসুলভ ধৈৰ্য্য ও অন্যান্য সদ্গুণ ইহাতে বিদ্যমান ৷ এই বৃদ্ধের ভাব দেখিয়া আমার বিদ্যা ও সহিষ্ণুতার অহঙ্কার চূর্ণ হইয়া গেল ৷ বৃদ্ধের নয়নে সর্বদা প্রশান্ত সরল মৈত্রীভাব বিরাজিত, মুখে সৰ্ব্বদা অমায়িক প্রীতিপূর্ণ আলাপ ৷ সময় সময় নিরপরাধে কষ্টভােগের কথা পাড়েন, স্ত্রীছেলেদের কথা বলেন, কবে ভগবান কারামুক্তি দিয়া স্ত্রীছেলেদের মুখদর্শন করাইবেন, এই ভাবও প্রকাশ করেন, কিন্তু কখনও তাহাকে নিরাশ বা অধীর দেখি নাই ৷ ভগবানের কৃপাপেক্ষায় ধীরভাবে জেলের কর্ম সম্পন্ন করিয়া দিন যাপন করিতেছেন ৷ বৃদ্ধের যত চেষ্টা ও ভাবনা নিজের জন্যে নহে, পরের সুখসুবিধা সংক্রান্ত ৷ দয়া ও দুঃখীর প্রতি সহানুভূতি তাহার কথায় কথায় প্রকাশ পায়, পরসেবা তাহার স্বভাব-ধৰ্ম্ম ৷ নম্রতায় এই সকল সদ্গুণ আরও ফুটিয়া উঠিয়াছে ৷ আমা হইতে সহস্রগুণ উচ্চ হৃদয় বুঝিয়া এই নম্রতায় আমি সৰ্ব্বদা লজ্জিত হইতাম, বৃদ্ধের সেবা গ্রহণ করিতে সংকোচ হইত, কিন্তু তিনি ছাড়েন না, তিনি সব্বদা আমার সুখ-সােয়াস্তির জন্যে চিন্তিত ৷ যেমন আমার উপর তেমনই সকলের উপর – বিশেষ নিরপরাধ ও দুঃখীজনের প্রতি তাঁহার দয়াদৃষ্টি বিনীত সেবাসম্মান আরাে অধিক ৷ অথচ মুখে ও আচরণে কেমন একটী স্বাভাবিক প্রশান্ত গাম্ভীর্য ও মহিমা প্রকাশিত ৷ দেশের প্রতিও ইহার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল ৷ এই বৃদ্ধ কয়েদীর দয়াদাক্ষিণ্যপূর্ণ শ্বেতশ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্যমূৰ্ত্তি চিরকাল আমার স্মৃতিপটে অঙ্কিত থাকিবে ৷ এই অবনতির দিনেও ভারতবর্ষের চাষার মধ্যে – আমরা যাহাদের অশিক্ষিত ছােটলােক বলি, – তাহাদের মধ্যে এইরূপ হিন্দুসন্তান পাওয়া যায়, ইহাতেই হিন্দুধৰ্ম্মের গৌরব, আৰ্য্যশিক্ষার অতুল গুণপ্রকাশ এবং ইহাতেই ভারতের ভবিষ্যৎ আশাজনক ৷ শিক্ষিত যুবকমণ্ডলী ও অশিক্ষিত কৃষক সম্প্রদায় এই দুইটী শ্রেণীতেই ভারতের ভবিষ্যৎ নিহিত, ইহাদের মিলনেই ভবিষ্যৎ আৰ্যজাতি গঠিত হইবে ৷

উপরে একটী অশিক্ষিত চাষার কথা বলিলাম, এখন দুইজন শিক্ষিত যুবকের কথা বলি ৷ ইহারা হ্যারিসন রােড়ের কবিরাজদ্বয়, নগেন্দ্রনাথ ও ধরণী ৷ ইহারা সাত বৎসর সশ্রম কারাবাস দণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছেন ৷ ইঁহারাও যেরূপ শান্তভাবে, যেরূপ সন্তুষ্টমনে, এই আকস্মিক বিপত্তি, এই অন্যায় রাজদণ্ড সহ্য করিতেন, তাহা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইতে হইত ৷ কখনও তাহাদের মুখে ক্রোধদুষ্ট বা অসহিষ্ণুতা-প্রকাশক একটীও কথা শুনি নাই ৷ যাঁহাদের দোষে জেলরূপ নরকে যৌবনকাল কাটাইতে হইল, তাহাদের প্রতি যে লেশমাত্র ক্রোধ তিরস্কার ভাব বা বিরক্তি পৰ্য্যন্ত আছে, তাহার কোন লক্ষণ কখনও দেখিতে পাই নাই ৷ তাহারা আধুনিক শিক্ষার গৌরবস্থল পাশ্চাত্যভাষায় ও পাশ্চাত্যবিদ্যায় অভিজ্ঞতা-বঞ্চিত, মাতৃভাষাই ইহাদের সম্বল, কিন্তু ইংরাজীশিক্ষালব্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহাদের তুল্য কম লােক দেখিয়াছি ৷ দুইজনেই মানুষের নিকট আক্ষেপ কিম্বা বিধাতার নিকট নালিশ না করিয়া সহাস্য মুখে নতমস্তকে দণ্ড গ্রহণ করিয়াছেন ৷ দুটী ভাইই সাধক কিন্তু প্রকৃতি বিভিন্ন ৷ নগেন্দ্র ধীর প্রকৃতি, গম্ভীর, বুদ্ধিমান ৷ হরিকথা ও ধৰ্ম্মবিষয়ে আলাপ অত্যন্ত ভালবাসিতেন ৷ যখন আমাদিগকে নির্জন কারাবাসে রাখা হইল তখন জেলের কর্তৃপক্ষ জেলের খাটুনি সমাপ্তে আমাদিগকে বই পড়িবার অনুমতি দিলেন ৷ নগেন্দ্র ভগবদ্গীতা পড়িতে চাহিয়া বাইবেল পাইয়াছিলেন ৷ বাইবেল পড়িয়া তাহার মনে কি কি ভাবের উদয় হয়, কাঠগড়ায় বসিয়া আমার নিকট তাহার বর্ণনা করিতেন ৷ নগেন্দ্র গীতা পড়েন নাই, তথাপি আশ্চর্য্যের সহিত দেখিলাম বাইবেলের কথা না বলিয়া গীতার শ্লোকার্থ বলিতেছেন – এমনকি এক একবার মনে হইত যে ভগবদগুণাত্মক মহৎ উক্তিসকল কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ-মুখ-নিঃসৃত উক্তিগুলি সেই বাসুদেব মুখপদ্ম হইতে এই আলিপুরের কাঠগড়ায় আবার নিঃসৃত হইতেছে ৷ গীতা না পড়িয়া বাইবেলে গীতার সমতাবাদ, কৰ্ম্মফলত্যাগ, সর্বত্র ঈশ্বর দর্শন ইত্যাদি ভাব উপলব্ধি করা সামান্য সাধনার লক্ষণ নহে ৷ ধরণী নগেন্দ্রর ন্যায় বুদ্ধিমান নন, কিন্তু বিনীত ও কোমল প্রকৃতি, স্বভাবতঃই ভক্ত ৷ তিনি সর্বদা মাতৃধ্যানে বিভাের, তাঁহার মুখের প্রসন্নতা, সরল হাস্য ও কোমল ভক্তিভাব দেখিয়া জেলের জেলত্ব উপলব্ধি করা কঠিন হইয়া পড়িত ৷ ইহাদের দেখিয়া কে বলিতে পারে বাঙ্গালী হীন অধম? এই শক্তি এই মনুষ্যত্ব এই পবিত্র অগ্নি ভস্মরাশিতে লুক্কায়িত আছে মাত্র ৷

ইহারা উভয়েই নিরপরাধ ৷ বিনা দোষে কারাবদ্ধ হইয়াও নিজগুণে বা শিক্ষাবলে বাহ্য সুখদুঃখের আধিপত্য অস্বীকার করিয়া আন্তরিক জীবনের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে সক্ষম হইয়াছেন ৷ কিন্তু যাঁহারা অপরাধী, তাহাদের মধ্যেও জাতীয় চরিত্রের সদ্গুণ বিকাশ পাইত ৷ বার মাস আলিপুরে ছিলাম, দুয়েকজন ভিন্ন যত কয়েদী, যত চোর ডাকাত খুনীর সঙ্গে আমাদের সংশ্রব ঘটিয়াছিল, সকলের নিকটেই আমরা সদ্ব্যবহার ও অনুকূলতা পাইতাম ৷ আধুনিক-শিক্ষা-দৃষিত আমাদের মধ্যে বরঞ্চ এসকল গুণের অভাব দেখা যায় ৷ আধুনিক শিক্ষার অনেক গুণ থাকিতে পারে কিন্তু সৌজন্য ও নিঃস্বার্থ পরসেবা সেই গুণের মধ্যগত নহে ৷ যে দয়া সহানুভূতি আৰ্য্যশিক্ষার মূল্যবান অঙ্গ, তাহা এই চোর-ডাকাতের মধ্যেও দেখিতাম ৷ মেহত্র ঝাড়দার পানিওয়ালাকে বিনা দোষে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে নির্জন কারাবাসের দুঃখকষ্ট কতকপরিমাণে অনুভব করিতে হইত, কিন্তু তাহাতে একজনও আমাদের উপর অসন্তুষ্টি বা ক্রোধ প্রকাশ করে নাই ৷ দেশী জেলরক্ষকদের নিকট তাহারা মাঝে মাঝে দুঃখ প্রকাশ করিত বটে কিন্তু প্রসন্নমুখে আমাদের কাৰ্য্য করিয়া যাইত, এবং ভগবানের নিকট আমাদের কারামুক্তি প্রার্থনা করিত ৷ একজন মুসলমান কয়েদী অভিযুক্তদিগকে নিজের ছেলেদের ন্যায় ভালবাসিতেন, বিদায় লইবার সময় তিনি অশ্রুজল সম্বরণ করিতে পারেন নাই ৷ দেশের জন্যে এই লাঞ্ছনা ও কষ্টভােগ বলিয়া অন্য সকলকে দেখাইয়া দুঃখ করিতেন, “দেখ, ইহারা ভদ্রলােক, ধনী লােকের সন্তান, গরীবদুঃখীকে পরিত্রাণ করিতে গিয়া ইহাদের এই দুর্দশা ৷” যাঁহারা পাশ্চাত্য সভ্যতার বড়াই করেন, তাহাদের জিজ্ঞাসা করি, ইংলণ্ডের জেলে নিম্নশ্রেণীর কয়েদী চোর ডাকাত খুনীর এইরূপ আত্মসংযম দয়াদাক্ষিণ্য কৃতজ্ঞতা পরার্থে ভগবদ্ভক্তি কি দেখা যায় ৷ প্রকৃতপক্ষে য়ুরােপ ভােক্তৃভূমি, ভারত দাতৃভূমি ৷ দেব ও অসুর বলিয়া গীতায় দুই শ্রেণীর জীব বর্ণিত আছে ৷ ভারতবাসী ৷ স্বভাবতঃ দেবপ্রকৃতি, পাশ্চাত্যগণ স্বভাবতঃ অসুরপ্রকৃতি ৷ কিন্তু এই ঘাের কলিতে পড়িয়া তমােভাবের প্রাধান্যবশতঃ আর্য্যশিক্ষার অবলােপে দেশের অবনতি, সমাজের অবনতি ও ব্যক্তিগত অবনতিতে, আমরা নিকৃষ্ট আসুরিকবৃত্তি সঞ্চয় করিতেছি আর পাশ্চাত্যগণ অন্যদিকে জাতীয় উন্নতি ও মনুষ্যত্বের ক্রমবিকাশের গুণে দেবভাব অর্জন করিতেছেন ৷ ইহা সত্ত্বেও তাহাদের দেবভাবে কতকটা অসুরত্ব এবং আমাদের আসুরিক ভাবের মধ্যেও দেবভাব অস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান ৷ তাহাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ, সেও অসুরত্ব সম্পূর্ণ হারায় না ৷ নিকৃষ্টে নিকৃষ্টে যখন তুলনা করি, ইহার যথার্থতা তখন অতি স্পষ্টরূপে বােঝা যায় ৷

এই সম্বন্ধে অনেক কথা লিখিবার আছে, প্রবন্ধের অতিদীর্ঘতার ভয়ে লিখিলাম না ৷ তবে জেলে যাঁহাদের আচরণে এই আন্তরিক স্বাধীনতা দর্শন করিয়াছি, তঁাহারা এই দেবভাবের চরম দৃষ্টান্ত ৷ এই সম্বন্ধে পরবর্তী প্রবন্ধে লিখিবার ইচ্ছা ৷ রহিল ৷









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates