CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




কারাকাহিনী




কারাকাহিনী

১৯০৮ সনের শুক্রবার ১লা মে আমি “বন্দেমাতরম্” অফিসে বসিয়াছিলাম, তখন শ্রীযুক্ত শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী আমার হাতে মজঃফরপুরের একটী টেলিগ্রাম দিলেন ৷ পড়িয়া দেখিলাম মজঃফরপুরে বােমা ফাটিয়াছে, দুটী য়ুরােপীয়ান স্ত্রীলােক হত ৷ সেদিনের “এম্পায়ার” কাগজে আরও পড়িলাম, পুলিস কমিশনার বলিয়াছেন আমরা জানি কে কে এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত এবং তাহারা শীঘ্র গ্রেপ্তার হইবে ৷ জানিতাম না তখনও যে আমি এই সন্দেহের মুখ্য লক্ষ্যস্থল, আমিই পুলিসের বিবেচনায় প্রধান হত্যাকারী, রাষ্ট্রবিপ্লবপ্রয়াসী যুবকদলের মন্ত্রদাতা ও গুপ্ত নেতা ৷ জানিতাম না যে এই দিনই আমার জীবনের একটা অঙ্কের শেষ পাতা, আমার সম্মুখে এক বৎসরের কারাবাস, এই সময়ের জন্য মানুষের জীবনের সঙ্গে যতই বন্ধন ছিল, সবই ছিন্ন হইবে, এক বৎসর কাল মানবসমাজের বাহিরে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মত থাকিতে হইবে ৷ আবার যখন কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিব, তথায় সেই পুরাতন পরিচিত অরবিন্দ ঘােষ প্রবেশ করিবে না, কিন্ত‍‍ু একটী নূতন মানুষ, নূতন চরিত্র, নূতন বুদ্ধি, নূতন প্রাণ, নূতন মন লইয়া নূতন কৰ্ম্মভার গ্রহণ করিয়া আলিপুরস্থ আশ্রম হইতে বাহির হইবে ৷ বলিয়াছি এক বৎসর কারাবাস, বলা উচিত ছিল এক বৎসর বনবাস, এক বৎসর আশ্রমবাস ৷ অনেক দিন হৃদয়স্থ নারায়ণের সাক্ষাৎ দর্শনের জন্য প্রবল চেষ্টা করিয়াছিলাম, উৎকট আশা পােষণ করিয়াছিলাম জগদ্ধাতা পুরুষােত্তমকে বন্ধুভাবে, প্রভুভাবে লাভ করি ৷ কিন্ত‍‍ু সহস্র সাংসারিক বাসনার টান, নানা কর্ম্মে আসক্তি, অজ্ঞানের প্রগাঢ় অন্ধকারে তাহা পারি নাই ৷ শেষে পরম দয়ালু সর্ব্বমঙ্গলময় শ্রীহরি সেই সকল শত্রুকে এক কোপে নিহত করিয়া তাহার সুবিধা করিলেন, যােগাশ্রম দেখাইলেন, স্বয়ং গুরুরূপে সখারূপে সেই ক্ষুদ্র সাধন কুটীরে অবস্থান করিলেন৷ সেই আশ্রম ইংরাজের কারাগার ৷ আমার জীবনে এই আশ্চর্য্য বৈপরীত্য বরাবর দেখিয়া আসিতেছি যে আমার হিতৈষী বন্ধুগণ আমার যতই না উপকার করুন, অনিষ্টকারীগণ – শত্রু কাহাকে বলিব, শত্রু আমার আর নাই – শত্রুই অধিক উপকার করিয়াছেন ৷ তাঁহারা অনিষ্ট করিতে গেলেন, ইষ্টই হইল ৷ বৃটিশ গবর্ণমেন্টের কোপ-দৃষ্টির একমাত্র ফল, আমি ভগবানকে পাইলাম ৷ কারাগৃহবাসে আন্তরিক জীবনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, কয়েকটী বাহ্যিক ঘটনা মাত্র বর্ণনা করিতে ইচ্ছা করি, কিন্ত‍‍ু যাহা কারাবাসের মুখ্য ভাব তাহা

Page 7

প্রবন্ধের প্রারম্ভে একবার উল্লেখ করা ভাল বিবেচনা করিলাম ৷ নতুবা পাঠকগণ মনে করিবেন যে, কষ্টই কারাবাসের সার ৷ কষ্ট যে ছিল না তাহা বলা যায় না, কিন্ত‍‍ু অধিকাংশকাল আনন্দেই কাটিয়া গিয়াছে ৷

শুক্রবার রাত্রিতে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইয়াছিলাম, ভােরে প্রায় ৫টার সময় আমার ভগিনী সন্ত্রস্ত হইয়া ঘরে ঢুকিয়া আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিল, জাগিয়া উঠিলাম ৷ পরমুহূর্ত্তে ক্ষুদ্র ঘরটী সশস্ত্র পুলিসে ভরিয়া উঠিল; সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ক্রেগান, ২৪ পরগণার ক্লার্ক সাহেব, সুপরিচিত শ্রীমান বিনােদকুমার গুপ্তের লাবণ্যময় ও আনন্দদায়ক মূৰ্ত্তি, আর কয়েকজন ইন‍্স‍্পেক্টার, লালপাগড়ি, গােয়েন্দা, খানাতল্লাসীর সাক্ষী ৷ হাতে পিস্তল লইয়া তাহারা বীরদর্পে দৌড়াইয়া আসিল, যেন বন্দুক-কামানসহ একটী সুরক্ষিত কেল্লা দখল করিতে আসিল ৷ শুনিলাম, একটী শ্বেতাঙ্গ বীরপুরুষ আমার ভগিনীর বুকের উপর পিস্তল ধরে, তাহা স্বচক্ষে দেখি নাই ৷ বিছানায় বসিয়া আছি, তখনও অর্দ্ধনিদ্রিত অবস্থা, ক্রেগান জিজ্ঞাসা করিলেন, “অরবিন্দ ঘােষ কে, আপনিই কি?” আমি বলিলাম, “আমিই অরবিন্দ ঘােষ” ৷ অমনি একজন পুলিসকে আমাকে গ্রেপ্তার করিতে বলেন ৷ তাহার পর ক্রেগানের একটী অতিশয় অভদ্র কথায় দুজনের অল্পক্ষণ বাক‍্‍‍বিতণ্ডা হইল ৷ আমি খানাতল্লাসীর ওয়ারেণ্ট চাহিলাম, পড়িয়া তাহাতে সহি করিলাম ৷ ওয়ারেণ্টে বােমার কথা দেখিয়া বুঝিলাম, এই পুলিস সৈন্যের আবির্ভাব মজঃফরপুরের খুনের সহিত সংশ্লিষ্ট ৷ কেবল বুঝিলাম না আমার বাড়িতে বােমা বা অন্য কোন স্ফোটক পদার্থ পাইবার আগেই body warrant-এর অভাবে কেন আমাকে গ্রেপ্তার করে ৷ তবে সেই সম্বন্ধে বৃথা আপত্তি করিলাম না ৷ তাহার পরেই ক্রেগানের হুকুমে আমার হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি দেওয়া হইল ৷ একজন হিন্দুস্থানী কনষ্টেবল সেই দড়ি ধরিয়া পিছনে দাঁড়াইয়া রহিল ৷ সেই সময়েই শ্রীযুক্ত অবিনাশ ভট্টাচাৰ্য্য ও শ্রীযুক্ত শৈলেন্দ্র বসুকে পুলিস উপরে আনে, তাহাদেরও হাতে হাতকড়ি, কোমরে দড়ি ৷ প্রায় আধঘণ্টার পর কাহার কথায় জানি না, তাহারা হাতকড়ি ও দড়ি খুলিয়া লয় ৷ ক্রেগানের কথার ভাবে প্রকাশ পাইল যে, তিনি যেন হিংস্র পশুর গর্ত্তে ঢুকিয়াছেন, যেন আমরা অশিক্ষিত হিংস্র স্বভাববিশিষ্ট আইনভঙ্গকারী, আমাদের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করা বা ভদ্র কথা বলা নিষ্প্রয়ােজন ৷ তবে ঝগড়ার পর সাহেব একটু নরম হইয়া পড়িলেন ৷ বিনােদ বাবু তাঁহাকে আমার সম্বন্ধে কি বুঝাইতে চেষ্টা করেন ৷ তাহার পর ক্রেগান আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি নাকি বি-এ পাশ করিয়াছেন? এইরূপ বাসায় এমন সজ্জাবিহীন কামরায় মাটীতে

Page 8

শুইয়াছিলেন, এই অবস্থায় থাকা কি আপনার মত শিক্ষিত লােকের পক্ষে লজ্জাজনক নহে?” আমি বলিলাম, “আমি দরিদ্র, দরিদ্রের মতই থাকি ৷” সাহেব অমনি সজোরে উত্তর করিলেন, “তবে কি আপনি ধনী লােক হইবেন বলিয়া এই সকল কাণ্ড ঘটাইয়াছেন?” দেশহিতৈষিতা, স্বার্থত্যাগ বা দারিদ্র্যব্রতের মাহাত্ম্য এই স্থূলবুদ্ধি ইংরাজকে বােঝান দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া আমি সে চেষ্টা করিলাম না ৷

এতক্ষণ খানাতল্লাসী চলিতেছে ৷ ইহা সাড়ে পাঁচটার সময় আরম্ভ হয় এবং প্রায় সাড়ে এগারটায় শেষ হয় ৷ বাক্সের ভিতর বা বাহিরে যত খাতা, চিঠি, কাগজ, কাগজের টুকরা, কবিতা, নাটক, পদ্য, গদ্য, প্রবন্ধ, অনুবাদ যাহা পাওয়া যায়, কিছুই এই সৰ্ব্বগ্রাসী খানাতল্লাসীর কবল হইতে মুক্তি পায় না ৷ খানাতল্লাসীর সাক্ষীদের মধ্যে রক্ষিত মহাশয় যেন একটু মনঃক্ষুণ্ণ; পরে অনেক বিলাপ করিয়া তিনি আমাকে জানাইলেন, পুলিস তাঁহাকে কিছু না বলিয়া হঠাৎ ধরিয়া লইয়া আসে, তিনি আদবে খবর পান নাই যে, তাঁহাকে এমন ঘৃণিত কাৰ্য্যে যােগদান করিতে হইবে ৷ রক্ষিত মহাশয় অতি করুণভাবে এই হরণকাণ্ড বর্ণনা করেন ৷ অপর সাক্ষী সমরনাথের ভাব অন্যরূপ, তিনি বেশ স্ফূর্ত্তির সহিত প্রকৃত রাজভক্তের ন্যায় এই খানাতল্লাসীর কাৰ্য্য সুসম্পন্ন করেন, যেন to the manner born ৷ খানাতল্লাসীতে বিশেষ কোন উল্লেখযােগ্য ঘটনা হয় নাই ৷ তবে মনে পড়ে ক্ষুদ্র কার্ডবাের্ডের বাক্সে দক্ষিণেশ্বরের যে মাটী রক্ষিত ছিল, ক্লার্ক সাহেব তাহা বড় সন্দিগ্ধচিত্তে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করেন, যেন তাঁহার মনে সন্দেহ হয় যে, এটা কি নূতন ভয়ঙ্কর তেজবিশিষ্ট স্ফোটক পদার্থ ৷ এক হিসাবে ক্লার্ক সাহেবের সন্দেহ ভিত্তিহীন বলা যায় না ৷ শেষে ইহা যে মাটী ভিন্ন আর কিছু নয়, এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণকারীর নিকট পাঠান অনাবশ্যক, এই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় ৷ আমি খানাতল্লাসীতে বাক্স খােলা ভিন্ন আর কোন কার্য্যে যােগদান করি নাই ৷ আমাকে কোন কাগজ বা চিঠি দেখান বা পড়িয়া শােনান হয় নাই, মাত্র অলকধারীর একখানা চিঠি ক্রেগান সাহেব নিজের মনােরঞ্জনার্থ উচ্চৈঃস্বরে পড়েন ৷ বন্ধুবর বিনােদ গুপ্ত তাঁহার স্বাভাবিক ললিত পদবিন্যাসে ঘর কম্পিত করিয়া ঘুরিয়া বেড়ান, শেল‍্ফ হইতে বা আর কোথা হইতে কাগজ বা চিঠি বাহির করেন, মাঝে মাঝে “অতি প্রয়ােজনীয়, অতি প্রয়ােজনীয়” বলিয়া তাহা ক্রেগানকে সমর্পণ করেন ৷ এই প্রয়ােজনীয় কাগজগুলি কি তাহা আমি জানিতে পারি নাই ৷ সেই বিষয়ে কৌতূহলও ছিল না, কারণ আমি জানিতাম যে, আমার বাড়ীতে বিস্ফোরক পদার্থের প্রস্ত‍‍ু‍তপ্রণালী বা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার কোনও কাগজ থাকা অসম্ভব ৷

Page 9

আমার ঘর তন্ন তন্ন করিয়া দেখিবার পর পুলিস পাশের ঘরে আমাদের লইয়া যায় ৷ ক্রেগান আমার ছােট মাসীর বাক্স খুলেন, একবার দুইবার চিঠিতে দৃষ্টিপাত করেন মাত্র, তৎপরে মেয়েদের চিঠি নিয়ে দরকার নাই, এই বলিয়া তাহা ছাড়িয়া যান ৷ তারপর একতলায় পুলিস মহাত্মাদের আবির্ভাব ৷ একতলায় বসিয়া ক্রেগান চা পান করেন, আমি এক পেয়ালা কোকো ও রুটী খাই, সেই সুযােগে সাহেব তাঁহার রাজনৈতিক মতগুলি যুক্তিতর্ক দেখাইয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করেন - আমি অবিচলিতচিত্তে এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করিলাম ৷ তবে জিজ্ঞাসা করি, না হয় শরীরের উপর অত্যাচার করা পুলিসের সনাতন প্রথা, মনের উপরও এইরূপ অমানুষিক অত্যাচার করা কি unwritten law-এর চতুঃসীমার মধ্যে আসে? আশা করি আমাদের পরম মান্য দেশহিতৈষী শ্রীযুক্ত যােগেন্দ্রচন্দ্র ঘােষ এই সম্বন্ধে ব্যবস্থাপক সভায় প্রশ্ন উত্থাপন করিবেন ৷

নীচের ঘরগুলি ও “নবশক্তি” আফিসের খানাতল্লাসীর পর পলিস “নবশক্তি”র একটী লােহার সিন্দুক খুলিতে আবার দোতালায় যায় ৷ আধঘণ্টা চেষ্টা করিয়া যখন অকৃতকার্য্য হইল তখন তাহা থানায় লইয়া যাওয়াই ঠিক হইল ৷ এইবার একজন পুলিস সাহেব একটী দ্বিচক্রযান আবিষ্কার করেন, তাহার উপর রেলের লেবেলে কুষ্ঠিয়ার নাম ছিল ৷ অমনি কুষ্ঠিয়ায় সাহেবকে যে গুলি করে তাহারই বাহন বলিয়া এই গুরুতর প্রমাণ সানন্দে লইয়া যান ৷

প্রায় সাড়ে এগারটার সময় আমরা বাটী হইতে যাত্রা করিলাম ৷ ফটকের বাহিরে আমার মেসাে মহাশয় এবং শ্রীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ বসু গাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন ৷ মেসাে মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন্ অপরাধে গ্রেপ্তার হইলে?” আমি বলিলাম, “আমি কিছুই জানি না, ইহারা ঘরে প্রবেশ করিয়াই গ্রেপ্তার করেন, আমার হাতে হাতকড়ি দেন, বডি ওয়ারেণ্ট দেখান নাই ৷” মেসাে মহাশয় হাতকড়ি হাতে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করায় বিনােদ বাবু বলিলেন, “মহাশয়, আমার অপরাধ নাই, অরবিন্দ বাবুকে জিজ্ঞাসা করুন, আমিই সাহেবকে বলিয়া হাতকড়ি খুলাইয়া নিলাম ৷” ভূপেন বাবু অপরাধ জিজ্ঞাসা করায় গুপ্ত মহাশয় নরহত্যার ধারা দেখাইলেন; ইহা শুনিয়া ভূপেন বাবু স্তম্ভিত হইলেন, আর কোনও কথা বলিলেন না ৷ পরে শুনিলাম, আমার সলিসিটর শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত গ্রে স্ট্রীটে আসিয়া খানাতল্লাসীতে আমার পক্ষে উপস্থিত থাকিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, পুলিস তাঁহাকে ফিরাইয়া দেয় ৷

আমাদের তিনজনকে থানায় লইয়া যাওয়া বিনােদ বাবুর ভার ৷ থানায় তিনি

Page 10

আমাদের সঙ্গে বিশেষ ভদ্র ব্যবহার করিলেন ৷ সেইখানেই স্নান ও আহার করিয়া লালবাজারে রওনা হইলাম ৷ লালবাজারে কয়েক ঘণ্টা বসাইয়া রয়ড্ স্ট্রীটে লইয়া যায়, সেই শুভ স্থানে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত কাটাইলাম ৷ রয়ড্ স্ট্রীটে ডিটেক‍্টিভ পুঙ্গব মৌলবী শাম‍্স-উল-আলমের সহিত আমার প্রথম আলাপ ও প্রীতি স্থাপন হয় ৷ মৌলবী সাহেবের তখন তত প্রভাব ও উৎসাহােদ্যম হয় নাই, বােমার মামলার প্রধান অন্বেষণকারী কিম্বা নর্টন সাহেবের prompter বা জীবন্ত স্মরণশক্তিরূপে তিনি তখন বিরাজ করেন নাই, রামসদয় বাবুই তখন এই মামলার প্রধান পাণ্ডা ৷ মৌলবী সাহেব আমাকে ধর্ম্ম সম্বন্ধে অতিশয় সরস বক্তৃতা শুনাইলেন ৷ হিন্দুধর্ম্ম ও ইস‍্লাম ধর্ম্মের একই মূলমন্ত্র, হিন্দুদের ওঙ্কারের ত্রিমাত্রা অ উ ম, কোরাণের প্রথম তিন অক্ষর অ ল ম, ভাষাতত্ত্বের নিয়মে ‘ল’-এর বদলে ‘উ’ ব্যবহার হয়, অতএব হিন্দু ও মুসলমানের একই মন্ত্র ৷ তথাপি নিজের ধৰ্ম্মের পার্থক্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে হয়, মুসলমানের সঙ্গে আহার করা হিন্দুর পক্ষে নিন্দনীয় ৷ সত্যবাদী হওয়াও ধৰ্ম্মের একটী প্রধান অঙ্গ ৷ সাহেবরা বলেন অরবিন্দ ঘােষ হত্যাকারী দলের নেতা, ভারতবর্ষের পক্ষে ইহা বড় দুঃখ ও লজ্জার কথা, তবে সত্যবাদিতা রক্ষা করিতে পারিলে situation saved হয় ৷ মৌলবীর দৃঢ় বিশ্বাস, বিপিন পাল ও অরবিন্দ ঘােষের ন্যায় উচ্চচরিত্রবিশিষ্ট ব্যক্তিগণ যাহাই করিয়া থাকুন, তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিবেন ৷ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী তথায় উপস্থিত ছিলেন, তিনি এই সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিলেন, কিন্ত‍‍ু মৌলবী সাহেব নিজের মত ছাড়িলেন না ৷ তাঁহার বিদ্যা-বুদ্ধি ও প্রবল ধর্ম্মভাব দেখিয়া আমি অতিশয় চমৎকৃত ও প্রীত হইলাম ৷ নিজে বেশী কথা বলা ধৃষ্টতা মাত্র বিবেচনা করিয়া নম্রভাবে তাঁহার অমূল্য উপদেশ শুনিয়া লইলাম এবং তাহা সযত্নে হৃদয়ে অঙ্কিত করিলাম ৷ এত ধৰ্ম্মভাবে মাতােয়ারা হইয়াও মৌলবী সাহেব ডিটেক‍্টিভগিরি ছাড়েন নাই ৷ একবার বলিলেন, “আপনি যে আপনার ছােট ভাইকে বােমা তৈয়ার করিবার জন্য বাগানটী ছাড়িয়া দিলেন, বড় ভুল করিলেন, ইহা বুদ্ধিমানের কাজ হয় নাই ৷” তাঁহার কথার অর্থ বুঝিয়া আমি একটু হাসিলাম; বলিলাম, “মহাশয়, বাগান যেমন আমার, তেমনি আমার ভাইয়ের, আমি যে তাহাকে ছাড়িয়া দিলাম, বা ছাড়িয়া দিলেও বােমা তৈয়ারী করিবার জন্য ছাড়িলাম, এ খবর কোথায় পাইলেন?” মৌলবী সাহেব অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না না, আমি বলিতেছি যদি তাহা করিয়া থাকেন ৷” এই মহাত্মা নিজের জীবনচরিতের একটী পাতা আমাকে খুলিয়া দেখাইয়া বলিলেন, “আমার জীবনে যত নৈতিক বা আর্থিক উন্নতি হইয়াছে,

Page 11

আমার বাপের একটী অতিশয় মূল্যবান উপদেশই তাহার মূল কারণ ৷ তিনি সর্ব্বদা বলিতেন, সম্মুখের অন্ন কখনও ছাড়িতে নাই ৷ এই মহাবাক্য আমার জীবনের মূলমন্ত্র, ইহা সর্ব্বদা স্মরণ করিয়াছি বলিয়া আমার এই উন্নতি ৷” ইহা বলিবার সময় মৌলবী সাহেব যে তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিলেন, তাহাতে আমার বােধ হইল যেন আমিই তাঁহার সম্মুখের অন্ন ৷ সন্ধ্যাবেলায় স্বনামখ্যাত শ্ৰীযুক্ত রামসদয় মুখােপাধ্যায়ের আবির্ভাব ৷ তিনি আমার উপর অত্যন্ত দয়া ও সহানুভূতি প্রকাশ করিলেন, সকলকে আমার আহার ও শয্যা সম্বন্ধে যত্ন করিতে বলিলেন ৷ পর মুহূর্ত্তে কয়েকজন আসিয়া আমাকে ও শৈলেন্দ্রকে লইয়া ঝড়বৃষ্টির মধ্যে লালবাজার হাজতে লইয়া যায় ৷ রামসদয়ের সহিত এই একবার মাত্র আমার আলাপ হয় ৷ বুঝিতে পারিলাম লােকটী বুদ্ধিমান ও উদ্যমশীল কিন্ত‍‍ু তাঁহার কথাবার্ত্তা, ভাবভঙ্গী, স্বর, চলন সবই কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক, সৰ্ব্বদা যেন তিনি রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করিতেছেন ৷ এইরূপ এক একজন আছে যাহাদের শরীর, বাক্য, চেষ্টা যেন অনৃতের অবতার ৷ তাহারা কাঁচা মনকে ভুলাইতে মজবুত, কিন্ত‍‍ু যাহারা মনুষ্য চরিত্রে অভিজ্ঞ বা অনেক দিন লােকের সঙ্গে মিশিয়াছে, তাহাদের নিকট প্রথম পরিচয়েই তাহারা ধরা পড়ে ৷

লালবাজারে দোতালায় একটী বড় ঘরে আমাদের দু'জনকে একসঙ্গে রাখা হইল ৷ আহার হইল অল্পমাত্র জলখাবার ৷ অল্পক্ষণ পরে দুইজন ইংরাজ ঘরে প্রবেশ করেন, পরে শুনিলাম একজন স্বয়ং পুলিস কমিশনার হ্যালিডে সাহেব ৷ দুইজনে একসঙ্গে আছি দেখিয়া হ্যালিডে সার্জ্জেণ্টের উপর চটিয়া উঠিলেন, আমাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, খবরদার এই লােকটীর সঙ্গে যেন কেহই না থাকে বা কথা বলে ৷ সেই মুহূর্ত্তেই শৈলেনকে অন্য ঘরে সরাইয়া বন্ধ করে ৷ আর সকলে যখন চলিয়া যায়, হ্যালিডে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “এই কাপুরুষােচিত দুষ্কর্ম্মে লিপ্ত ছিলেন বলিয়া আপানার কি লজ্জা করে না?” আমি বলিলাম, “আমি লিপ্ত ছিলাম, ইহা ধরিয়া লইবার আপনার কি অধিকার?” উহার উত্তরে হ্যালিডে বলিলেন, “আমি ধরিয়া লই নাই, আমি সবই জানি ৷” আমি বলিলাম, “কি জানেন বা না জানেন আপনারাই অবগত, এই হত্যাকাণ্ডের সহিত সকল সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করি ৷” হ্যালিডে আর কোন কথা বলিলেন না ৷

সেই রাত্রে আমার আর কয়েকজন দর্শক আসে, ইহারাও পুলিস ৷ ইহাদের আসার মধ্যে এক রহস্য নিহিত ছিল, সে রহস্য আমি আজ পৰ্য্যন্ত তলাইতে

Page 12

পারি নাই ৷ গ্রেপ্তারের দেড় মাস আগে একটী অপরিচিত ভদ্রলােক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তিনি বলেন, “মহাশয় আপনার সঙ্গে আমার আলাপ নাই, তবে আপনার উপর ভক্তি আছে বলিয়া আপনাকে সতর্ক করিতে আসিলাম, আর জানিতে চাই আপনার কোন্নগরের কোনও লােকের সঙ্গে কি আলাপ আছে, সেইখানে কখন কি গিয়াছিলেন বা সেখানে বাড়ী আছে কি?” আমি বলিলাম, “বাড়ী নাই, কোন্নগরে একবার গিয়াছিলাম, কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও আছে ৷” তিনি বলিলেন, “আর কিছু বলিব না তবে ইহার পর কোন্নগরের কাহারও সহিত দেখা করিবেন না, আপনার ও আপনার ভাই বারীন্দ্রের বিরুদ্ধে দুষ্টেরা ষড়যন্ত্র করিতেছে, শীঘ্রই আপনাদিগকে তাহারা বিপদে ফেলিবে ৷ আর আমাকে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না ৷” আমি বলিলাম, “মহাশয় এই অসম্পূর্ণ সংবাদে আমার কি উপকার হইল আমি বুঝিতে পারিলাম না, তবে উপকার করিতে আসিয়াছেন তাহার জন্য ধন্যবাদ ৷ আমি আর কিছু জানিতে চাই না ৷ ভগবানের উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস, তিনিই সর্ব্বদা আমাকে রক্ষা করিবেন, সেই বিষয়ে নিজে চেষ্টা করা বা সতর্ক হওয়া নিষ্প্রয়ােজন ৷” তাহার পরে এই সম্বন্ধে আর কোনও খবর পাই নাই ৷ এই আমার অপরিচিত হিতৈষী যে মিথ্যা কল্পনা করেন নাই, এই রাত্রে তাহার প্রমাণ পাইলাম ৷ একজন ইন‍্‍‍স্পেক্টার আর কয়েকজন পুলিস কর্ম্মচারী আসিয়া কোন্নগরের সমস্ত কথা জানিয়া লইলেন ৷ তঁহারা বলিলেন, “কোন্নগরে কি আপনার আদি স্থান? সেখানে বাড়ী আছে কি? সেইখানে কখনও গিয়াছিলেন? কবে গিয়াছিলেন? কেন গিয়াছিলেন? বারীন্দ্রের কোন্নগরে সম্পত্তি আছে কি?” – এইরূপ অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন ৷ ব্যাপারটা কি ইহা বুঝিবার জন্য আমি এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিলাম ৷ এই চেষ্টায় কৃতকাৰ্য্য হইলাম না, তবে প্রশ্নগুলির ও পুলিসের কথার ধরণে বােঝা গেল যে পুলিসে কি খবর পাইয়াছে তাহা সত্য কি মিথ্যা এই অনুসন্ধান চলিতেছে ৷ অনুমান করিলাম যেমন তাই-মহারাজের মােকদ্দমায় তিলককে ভণ্ড, মিথ্যাবাদী, প্রবঞ্চক ও অত্যাচারী প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা হইয়াছিল এবং সেই চেষ্টায় বােম্বে গবর্ণমেণ্ট যােগদান করিয়া প্রজার অর্থের অপব্যয় করিয়াছিলেন, – তেমনই এস্থলেও কয়েকজন আমাকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিতেছিল ৷

রবিবার সমস্তদিন হাজতে কাটিয়া গেল ৷ আমার ঘরের সম্মুখে সিঁড়ি ছিল ৷ সকালে দেখিলাম কয়েকজন অল্পবয়স্ক বালক সিঁড়িতে নামিতেছে ৷ মুখ চিনি না কিন্ত‍‍ু আন্দাজে বুঝিলাম ইহারাও এই মােকদ্দমায় ধৃত, পরে জানিতে পারিলাম

Page 13

ইহারা মানিকতলার বাগানের ছেলে ৷ এক মাস পরে জেলে তাহাদের সঙ্গে আলাপ হয় ৷ অল্পক্ষণ পরে হাত-মুখ ধুইতে আমাকেও নীচে লইয়া যায় – স্নানের বন্দোবস্ত নাই, কাজেই স্নান করিলাম না ৷ সেই দিন সকালে আহারের মধ্যে ডাল ভাত সিদ্ধ, কয়েক গ্রাস জোর করিয়া উদরস্থ করিলাম, তাহার পর তাহা ত্যাগ করিতে হইল ৷ বিকাল বেলা মুড়ি ৷ তিন দিন ইহাই আমাদের আহার ছিল ৷ কিন্ত‍‍ু ইহাও বলিতে হয় যে সােমবারে সার্জ্জেণ্ট আমাকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া চা ও রুটী খাইতে দিলেন ৷

পরে শুনিলাম আমার উকিল কমিশনারের নিকট বাড়ী হইতে আহার দিবার অনুমতি চাহিয়াছিলেন, হ্যালিডে সাহেব তাহাতে সম্মত হন নাই ৷ ইহাও শুনিলাম যে, আসামীদের সঙ্গে উকিল বা এটর্ণীর দেখা করা নিষিদ্ধ ৷ জানি না এই নিষেধ আইনসঙ্গত কিনা? উকিলের পরামর্শ পাইলে আমার যদিও সুবিধা হইত, তবে নিতান্ত প্রয়ােজন ছিল না বটে, কিন্ত‍‍ু তাহাতে অনেকের মােকদ্দমার ক্ষতি হইয়াছে ৷ সােমবারে কমিশনারদের নিকট আমাদের হাজির করে ৷ আমার সঙ্গে অবিনাশ ও শৈলেন ছিল ৷ সকলকে ভিন্ন ভিন্ন দল করিয়া লইয়া যায় ৷ আমরা তিনজনই পূর্ব্বজন্মের পুণ্যফলে পূৰ্ব্বে গ্রেপ্তার হইয়াছিলাম এবং আইনের জটিলতা কতকটা অনুভব করিয়াছিলাম বলিয়া তিনজনই কমিশনারের নিকট কোনও কথা বলিতে অস্বীকৃত হই ৷ পরদিন ম্যাজিষ্ট্রেট থর্ণহিলের কোর্টে আমাদের লইয়া যায় ৷ এই সময় শ্রীযুক্ত কুমারকৃষ্ণ দত্ত, ম্যানুয়েল সাহেব আর আমার একজন আত্মীয়ের সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ৷ ম্যানুয়েল সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুলিসে বলে আপনার বাড়ীতে অনেক সন্দেহজনক লেখা পাওয়া গিয়াছে ৷ এইরূপ চিঠি বা কাগজ কি ছিল?” আমি বলিলাম, “নিঃসন্দেহে বলিতে পারি, ছিল না, থাকা সম্পূর্ণ অসম্ভব ৷” অবশ্য তখন মিষ্টান্ন পত্র (‘sweets letter') বা ‘scribbling'এর কথা জানিতাম না ৷ আমার আত্মীয়কে বলিলাম, “বাড়ীতে ব’ল কোন ভয় যেন করে না, আমার নির্দ্দোষিতা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হইবে ৷” আমার মনে তখন হইতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে ইহা হইবেই ৷ প্রথম নির্জ্জন কারাবাসে মন একটু বিচলিত হয় কিন্ত‍‍ু তিন দিন প্রার্থনা ও ধ্যানে কাটানর ফলে নিশ্চলা শান্তি ও অবিচলিত বিশ্বাস পুনঃ প্রাণকে অভিভূত করে ৷

থর্ণহিল সাহেবের এজলাস হইতে আমাদের আলিপুরে গাড়ী করিয়া লইয়া যায় ৷ এই দলে ছিল নিরাপদ, দীনদয়াল, হেমচন্দ্র দাস প্রভৃতি ৷ ইহাদের মধ্যে হেমচন্দ্র দাসকে চিনিতাম, একবার মেদিনীপুরে তাঁহার বাড়ীতে উঠি ৷ কে তখন

Page 14

জানিত যে এইরূপ বন্দীভাবে জেলের পথে তাঁহার সহিত দেখা হইবে ৷ আলিপুরে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে কতক্ষণ থাকিতে হইল, কিন্ত‍‍ু ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আমাদের হাজির করা হয় নাই, কেবল ভিতর হইতে তাহার হুকুম লিখাইয়া আনে ৷ আমরা আবার গাড়ীতে উঠিলাম, তখন একটী ভদ্রলােক আমার নিকট আসিয়া বলিলেন, “শুনিতেছি ইহারা আপনার নির্জ্জন কারাবাসের ব্যবস্থা করিয়াছেন, হুকুম লেখা হইতেছে ৷ হয়ত কাহারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করিতে দিবে না ৷ এইবার যদি বাড়ীর লােককে কিছু বলিতে চান, আমি সংবাদ পৌঁছাইয়া দিব ৷” আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ দিলাম, কিন্ত‍‍ু যাহা বলিবার ছিল, তাহা আমার আত্মীয়ের দ্বারা জানান হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে আর কিছু বলিলাম না ৷ আমার উপর দেশের লােকের সহানুভূতি ও অযাচিত অনুগ্রহের দৃষ্টান্তরূপে এই ঘটনার উল্লেখ করিলাম ৷ তৎপরে কোর্ট হইতে আমরা জেলে গিয়া জেলের কর্ম্মচারীগণের হাতে সমর্পিত হই ৷ জেলে ঢুকিবার আগে আমাদের স্নান করায়, জেলের পােষাক পরাইয়া পিরাণ, ধুতি, জামা সংশােধিত করিবার জন্য লইয়া যায় ৷ চারি দিন পরে আমরা স্নান করিয়া স্বর্গসুখ অনুভব করিলাম ৷ স্নানের পর তাহারা সকলকে নিজ নিজ নির্দ্দিষ্ট ঘরে পৌঁছাইয়া দেয়, আমিও আমার নির্জ্জন কারাগারে ঢুকিলাম, ক্ষুদ্র ঘরের গরাদ বন্ধ হইল ৷ ৫ই মে আলিপুরে কারাবাস আরম্ভ ৷ পরবৎসর ৬ই মে নিষ্কৃতি পাই ৷

আমার নির্জ্জন কারাগৃহটী নয় ফুট দীর্ঘ, পাঁচ ছয় ফুট প্রস্থ ছিল ৷ ইহার জানালা নাই, সম্মুখভাগে বৃহৎ লােহার গরাদ, এই পিঞ্জরই আমার নির্দ্দিষ্ট বাসস্থান হইল ৷ ঘরের বাহিরে একটী ক্ষুদ্র উঠান, পাথরের জমি, ইটের উচ্চ দেওয়াল, সামনে কাঠের দরজা ৷ সেই দরজার উপরিভাগে মানুষের চক্ষুর সমান উচ্চতায় ক্ষুদ্র গােলাকার রন্ধ্রে, দরজা বন্ধ হইলে শান্ত্রী এই রন্ধ্রে চক্ষু লাগাইয়া সময় সময় দেখে, কয়েদী কি করিতেছে ৷ কিন্ত‍‍ু আমার উঠানের দরজা প্রায়ই খােলা ৷ থাকিত ৷ এইরূপ ছয়টী ঘর পাশাপাশি, সেইগুলিকে ছয় ডিক্রী বলে ৷ ডিক্রীর অর্থ বিশেষ সাজার ঘর – বিচারপতি বা জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের হুকুমে যাহাদের নির্জ্জন কারাবাসের দণ্ড নির্দ্ধারিত হয় তাহাদেরই এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গহ্বরে থাকিতে হয় ৷ এই নির্জ্জন কারাবাসেরও কম বেশী আছে ৷ যাহাদের বিশেষ সাজা হয়, তাহাদের উঠানের দরজা বন্ধ থাকে; মনুষ্য সংসার হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হইয়া শান্ত্রীর চক্ষু ও পরিবেশনকারী কয়েদীর দুবেলায় আগমন তাহাদের

Page 15

জগতের সঙ্গে একমাত্র সম্বন্ধ ৷ আমা হইতেও হেমচন্দ্র দাস সি. আই. ডি.-র আতঙ্কস্থল বলিয়া তাহার জন্য এই ব্যবস্থা হইল ৷ এই সাজার উপরও সাজা আছে, – হাতে-পায়ে হাতকড়া ও বেড়ী পরিয়া নির্জ্জন কারাবাসে থাকা ৷ এই চরম শাস্তি কেবল জেলের শান্তিভঙ্গ করা বা মারামারির জন্য নয়, বার বার খাটুনিতে ত্রুটী হইলেও এই শাস্তি হয় ৷ নির্জ্জন কারাবাসের মােকদ্দমার আসামীকে শাস্তিস্বরূপ এইরূপ কষ্ট দেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ, তবে স্বদেশী বা ‘বন্দে-মাতরম্'-কয়েদী নিয়মের বাহিরে, পুলিসের ইচ্ছায় তাহাদের জন্যও সুবন্দোবস্ত হয় ৷

আমাদের বাসস্থান ত এইরূপ ছিল, সাজ-সরঞ্জামের সম্বন্ধেও আমাদের সহৃদয় কর্ত্তৃপক্ষ আতিথ্য সৎকারের ত্রুটী করেন নাই ৷ একখানা থালা ও একটী বাটী উঠানকে সুশােভিত করিত ৷ উত্তমরূপে মাজা হইলে এই আমার সর্ব্বস্বস্বরূপ থালা-বাটীর এমন রূপার ন্যায় চাক‍্‍‍চিক্য হইত যে, প্রাণ জুড়াইয়া যাইত এবং সেই নির্দ্দোষ কিরণময় উজ্জ্বলতার মধ্যে ‘স্বর্গজাত’ নিখুঁত ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের উপমা পাইয়া রাজভক্তির নির্ম্মল আনন্দ অনুভব করিতাম ৷ দোষের মধ্যে থালাও তাহা বুঝিয়া আনন্দে এত উৎফুল্ল হইত যে, একটু জোরে আঙ্গুল দিলেই তাহা আরবীস্থানের ঘূর্ণ্যমান দরবেশের ন্যায় মণ্ডলাকারে নৃত্য করিতে থাকিত, তখন এক হাতে আহার করা, এক হাতে থালা ধরিয়া থাকা ভিন্ন উপায় ছিল না ৷ নচেৎ ঘুরপাক খাইতে খাইতে জেলের অতুলনীয় মুষ্ট্যন্ন লইয়া তাহা পলাইয়া যাইবার উপক্রম করিত ৷ থালা হইতে বাটীটীই আরও প্রিয় ও উপকারী জিনিষ ছিল ৷ ইহা জড় পদার্থের মধ্যে যেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ান ৷ সিভিলিয়ানের যেমন সর্ব্বকাৰ্য্যে স্বভাবজাত নৈপুণ্য ও যােগ্যতা আছে, জজ, শাসনকর্ত্তা, পুলিস, শুল্কবিভাগের কর্ত্তা, মিউনিসিপ্যালিটির অধ্যক্ষ, শিক্ষক, ধর্ম্মোপদেষ্টা, যাহা বল, তাহাই বলিবামাত্র হইতে পারে, – যেমন তাঁহার পক্ষে তদন্তকারী, অভিযােগকর্ত্তা, পুলিস বিচারক, এমন কি সময় সময় বাদীর পক্ষে কৌন‍্‍‍সিলীরও এক শরীরে এক সময়ে প্রীতিসম্মিলন হওয়া সুখসাধ্য, আমার আদরের বাটীরও তদ্রূপ ৷ বাটীর জাত নাই, বিচার নাই, কারাগৃহে যাইয়া সেই বাটীতে জল নিয়া শৌচক্রিয়া করিলাম, সেই বাটীতেই মুখ ধুইলাম, স্নান করিলাম, অল্পক্ষণ পরে আহার করিতে হইল, সেই বাটীতেই ডাল বা তরকারী দেওয়া হইল, সেই বাটীতেই জলপান করিলাম এবং আচমন করিলাম ৷ এমন সৰ্ব্বকাৰ্য্যক্ষম মূল্যবান বস্ত‍‍ু ইংরাজের জেলেই পাওয়া সম্ভব ৷ বাটী আমার এই সকল সাংসারিক উপকার করিয়া যােগসাধনের উপায় স্বরূপও হইয়া দাঁড়াইল ৷ ঘৃণা পরিত্যাগের এমন সহায় ও

Page 16

উপদেষ্টা কোথায় পাইব? নির্জ্জন কারাবাসের প্রথম পালার পরে যখন আমাদের এক সঙ্গে রাখা হয়, তখন আমার সিভিলিয়ানের অধিকার পৃথকীকরণ হয়, – কর্ত্তৃপক্ষেরা শৌচক্রিয়ার জন্য স্বতন্ত্র উপকরণের বন্দোবস্ত করেন ৷ কিন্ত‍‍ু একমাসকালে এতদ্বারা এই অযাচিত ঘৃণা সংযম শিক্ষালাভ হইল ৷ শৌচক্রিয়ার সমস্ত ব্যবস্থাই যেন এই সংযম শিক্ষার দিকে লক্ষ্য করিয়া বিহিত ৷ বলা হইয়াছে, নির্জ্জন কারাবাস বিশেষ শাস্তির মধ্যে গণ্য এবং সেই শাস্তির মূলতত্ত্ব যথাসাধ্য মনুষ্য সংসর্গ ও মুক্ত আকাশ সেবা বর্জ্জন ৷ বাহিরে শৌচের ব্যবস্থা হইলে এই তত্ত্ব ভঙ্গ হয় বলিয়া ঘরের ভিতরেই দুইখানা আল‍্কাতরা মাখান টুকরী দেওয়া হইত ৷ সকালে ও বিকাল বেলায় মেথর আসিয়া তাহা পরিষ্কার করিত, তীব্র আন্দোলন ও মর্ম্মস্পর্শী বক্তৃতা করিলে অন্য সময়েও পরিষ্কার করা হইত, কিন্ত‍‍ু অসময়ে পায়খানায় গেলে প্রায়ই প্রায়শ্চিত্তরূপে কয়েক ঘণ্টা দুর্গন্ধ ভােগ করিতে হইত ৷ নির্জ্জন কারাবাসের দ্বিতীয় পালায় এই সম্বন্ধে কতকটা রিফরম্ হয়, কিন্ত‍‍ু ইংরাজের রিফরম্ হইতেছে পুরাতন আমলের মূলতত্ত্ব সম্পূর্ণ বজায় রাখিয়া শাসনপ্রণালী সংশােধন ৷ বলা বাহুল্য, এই ক্ষুদ্র ঘরে এমন ব্যবস্থা থাকায় সর্ব্বদা, বিশেষতঃ আহারের সময় এবং রাত্রিতে বিশেষ অসােয়াস্তি ভােগ করিতে হইত ৷ জানি, শােবার ঘরের পার্শ্বে পায়খানা রাখা, স্থানে স্থানে বিলাতী সভ্যতার অঙ্গবিশেষ, কিন্ত‍‍ু একটী ক্ষুদ্র ঘরে শােবার ঘর, খাবার ঘর ও পায়খানা – ইহাকেই too much of a good thing বলে ৷ আমরা কু-অভ্যাসগ্রস্ত ভারতবাসী, সভ্যতার এত উচ্চ সােপানে পৌঁছা আমাদের পক্ষে কষ্টকর ৷

গৃহসামগ্রীর মধ্যে আরও ছিল একটী স্নানের বাল‍্তী, জল রাখিবার একটী টিনের নলাকার বাল‍্তী এবং দুটী জেলের কম্বল ৷ স্নানের বাল‍্তী উঠানে রাখা হইত, সেইখানে স্নান করিতাম ৷ আমার ভাগ্যে প্রথমতঃ জলকষ্ট ছিল না কিন্ত‍‍ু তাহা পরে ঘটিয়াছিল ৷ প্রথমতঃ পার্শ্বের গােয়াল ঘরের কয়েদী স্নানের সময় আমার ইচ্ছামত বাল‍্তীতে জল ভরিয়া দিত, সেইজন্য স্নানের সময়ই জেলের তপস্যার মধ্যে প্রত্যহ গৃহস্থের বিলাসবৃত্তি ও সুখপ্রিয়তাকে তৃপ্ত করিবার অবসর ৷ অপর আসামীদের ভাগ্যে ইহাও ঘটে নাই, এক বাল‍্তীর জলেই তাহাদিগকে শৌচক্রিয়া, বাসন মাজা ও স্নান সম্পন্ন করিতে হইত ৷ মােকদ্দমার আসামী বলিয়া এই অতিমাত্র বিলাস করিতে দেওয়া হইত, কয়েদীদের দুই-চারি বাটী জলে স্নান হইত ৷ ইংরাজেরা বলে ভগবৎ প্রেম ও শরীরের স্বচ্ছন্দতা প্রায়ই সমান ও দুর্লভ সদ‍্‍গুণ, তাহাদের জেলে এই জাতীয় প্রবাদের যাথার্থ্য রক্ষণার্থ

Page 17

অথবা অতিরিক্ত স্নানসুখে কয়েদীর অনিচ্ছাজনিত তপস্যায় রসভঙ্গ ভয়ে এই ব্যবস্থা প্রচলিত, তাহা নির্ণয় করা কঠিন ৷ আসামীরা কর্ত্তৃপক্ষদের এই দয়াকে কাকের স্নান বলিয়া তাচ্ছিল্য করিত ৷ মানুষমাত্রই অসন্তোষপ্রিয় ৷ স্নানের ব্যবস্থা হইতে পানীয় জলের ব্যবস্থা আরও চমৎকার ৷ তখন গ্রীষ্মকাল, আমার ক্ষুদ্র ঘরে বাতাসের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল ৷ কিন্ত‍‍ু মে মাসের উগ্র ও প্রখর রৌদ্র অবাধে প্রবেশ করিত ৷ ঘরটী উত্তপ্ত উনুনের মত হইয়া উঠিত ৷ এই উনুনে সিদ্ধ হইতে হইতে অদম্য জলতৃষ্ণা লাঘব করিবার উপায় ওই টিনের বাল‍্তীর অর্দ্ধ-উষ্ণ জল ৷ বার বার তাহা পান করিতাম, তৃষ্ণা ত যাইতই না বরং স্বেদ নির্গমন এবং অল্পক্ষণে নবীভূত তৃষ্ণাই লাভ হইত ৷ তবে এক একজনের উঠানে মাটীর কলসী রাখা ছিল, তাঁহারা পূর্ব্বজন্মকৃত তপস্যা স্মরণ করিয়া নিজেকে ধন্য মানিতেন ৷ ইহাতে ঘাের পুরুষার্থবাদীকেও অদৃষ্ট মানিতে বাধ্য হইতে হয়, কাহারও ভাগ্যে ঠাণ্ডা জল জুটিত, কাহারও ভাগ্যে তৃষ্ণা লাগিয়াই থাকিত, সব কপালের জোর ৷ কর্ত্তৃপক্ষেরা কিন্ত‍‍ু সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য হইয়া কলসী বা টিন বিতরণ করিতেন ৷ এই যদৃচ্ছা লাভে আমি সন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইলে বা না হইলেও আমার জলকষ্ট জেলের সহৃদয় ডাক্তারবাবুর অসহ্য হয় ৷ তিনি কলসী যােগাড় করিতে উদ্যোগী হন, কিন্ত‍‍ু এই সব বন্দোবস্তে তাঁহার হাত নাই বলিয়া তিনি অনেক দিন তাহাতে কৃতকার্য্য হন নাই, শেষে তাঁহারই কথায় মুখ্য জমাদার কোথা হইতে কলসী আবিষ্কার করিল ৷ তাহার আগেই আমি তৃষ্ণার সঙ্গে অনেক দিনের ঘাের সংগ্রামে পিপাসামুক্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম ৷ এই তপ্ত গৃহে আবার জেলে তৈয়ারী করা দুইটী মােটা কম্বলই আমাদের বিছানা ৷ বালিস নাই, কাজেই একটী কম্বল পাতিয়া আর একটী কম্বল পাট করিয়া বালিস বানাইয়া শুইতাম ৷ যখন গরমের ক্লেশ অসহ্য হইয়া আর থাকা যাইত না, তখন মাটীতে গড়াইয়া শরীর শীতল করিয়া আরাম লাভ করিতাম ৷ মাতা বসুন্ধরার শীতল উৎসঙ্গ স্পর্শের কি সুখ, তাহা তখন বুঝিতাম ৷ তবে জেলে সেই উৎসঙ্গ স্পর্শ বড় কোমল নয়, তদ্দ্বারা নিদ্রার আগমন বাধা-প্রাপ্ত হইত বলিয়া কম্বলের শরণ লইতে হইত ৷ যে দিন বৃষ্টি হইত ৷ সেদিন বড় আনন্দের দিন হইত ৷ ইহাতেও একটী এই অসুবিধা ছিল যে, ঝড়বৃষ্টি হইলেই ধূলা, পাতা ও তৃণসঙ্কুল প্রভঞ্জনের তাণ্ডব নৃত্যের পর আমার খাঁচার মধ্যে ছােটখাট একটী জলপ্লাবন হইত ৷ তাহার পরে রাত্রিতে ভিজা কম্বল লইয়া ঘরের কোণে পলায়ন ভিন্ন উপায় ছিল না ৷ প্রকৃতির এই লীলা বিশেষ সাঙ্গ হইলেও জলপ্লাবিত মাটী যতক্ষণ না শুকাইত ততক্ষণ নিদ্রার আশা পরিত্যাগ

Page 18

পূৰ্ব্বক চিন্তার আশ্রয় লইতে হইত, কেননা শৌচক্রিয়ার সামগ্রীর নিকটই একমাত্র শুষ্কস্থল থাকিত কিন্ত‍‍ু সেই দিকে কম্বল পাতিতে প্রবৃত্তি হইত না ৷ এই সব অসুবিধা সত্ত্বেও ঝড়ের দিনে ভিতরে প্রচুর বাতাস আসিত এবং ঘরের সেই তপ্ত উনুন-তাত বিদূরিত হইত বলিয়া ঝড়বৃষ্টিকে সাদরে স্বাগত করিতাম ৷

আলিপুর গবর্ণমেণ্ট হােটেলের যে বর্ণনা করিলাম, এবং ভবিষ্যতে আরও করিব, তাহা নিজের কষ্টভােগ জ্ঞাপন করিবার জন্য নয়; —সুসভ্য বৃটিশ রাজ্যে মােকদ্দমার আসামীর জন্য কি অদ্ভুত ব্যবস্থা, নির্দ্দোষীর দীর্ঘকালব্যাপী কি যন্ত্রণা হইতে পারে, ইহা দেখাইবার জন্য এই বর্ণনা ৷ যে সব কষ্টের কারণ দেখাইয়াছি, সে সব ছিল বটে, কিন্ত‍‍ু ভগবানের দয়া দৃষ্টি ছিল বলিয়া কয়েকদিন মাত্র এই কষ্ট অনুভব করিয়াছিলাম, তাহার পরে – কি উপায়ে তাহা পরে বলিব – মন সেই দুঃখের অতীত হইয়া কষ্ট অনুভব করিতে অসমর্থ হইয়াছিল ৷ সেইজন্য জেলের স্মৃতি মনে উদয় হইলে ক্রোধ বা দুঃখ না হইয়া হাসিই পায় ৷ যখন সর্ব্বপ্রথম জেলের বিচিত্র পােষাক পরিয়া আমার পিঞ্জরে ঢুকিয়া থাকিবার বন্দোবস্ত দেখিলাম, তখন এই ভাবই মনে প্রকাশ পাইল ৷ মনে মনে হাসিতে লাগিলাম ৷ আমি ইংরাজ জাতির ইতিহাস ও আধুনিক আচরণ নিরীক্ষণ করিয়া তাহাদের বিচিত্র ও রহস্যময় চরিত্র অনেকদিন আগে বুঝিয়া লইয়াছিলাম; সেইজন্য আমার প্রতি তাহাদের এইরূপ ব্যবহার দেখিয়াও কিছুমাত্র আশ্চর্য্যান্বিত বা দুঃখিত হইলাম না ৷ সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের সহিত এইরূপ ব্যবহার করা তাহাদের পক্ষে অতিশয় অনুদার ও নিন্দনীয় ৷ আমরা সকলে ভদ্রলােকের সন্তান, অনেকে জমিদারের ছেলে, কয়েকজন বংশে, বিদ্যায়, গুণে, চরিত্রে ইংলণ্ডের শীর্ষস্থানীয় লােকের সমকক্ষ ৷ আমরা যে অভিযােগে ধৃত, তাহাও সামান্য খুন চুরি ডাকাতি নয়; দেশের জন্য বিদেশী রাজপুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধ-চেষ্টা করা বা সমরােদ্যোগের ষড়যন্ত্র ৷ তাহাতেও অনেকের দোষের সম্বন্ধে প্রমাণের নিতান্ত অভাব, পুলিসের সন্দেহই তাহাদের ধৃত হইবার একমাত্র কারণ ৷ এইরূপ স্থলে সামান্য চোর-ডাকাতদের মত রাখা – চোর-ডাকাত কেন, পশুর ন্যায় পিঞ্জরে রাখিয়া পশুর অখাদ্য আহার খাওয়ান, জলকষ্ট, ক্ষুৎপিপাসা, রৌদ্র, বৃষ্টি, শীত সহ্য করান, ইহাতে বৃটিশ রাজপুরুষদের ও বৃটিশ জাতির গৌরব বৃদ্ধি হয় না ৷ ইহা কিন্ত‍‍ু তাঁহাদের জাতীয় চরিত্রগত দোষ ৷ ইংরাজদের দেহে ক্ষত্রিয়ােচিত গুণ থাকিলেও শত্রু বা বিরুদ্ধাচরণকারীর সঙ্গে ব্যবহার করিবার সময় তাঁহারা ষােল-আনা বেনে ৷ আমার কিন্ত‍‍ু তখনও বিরক্তি-ভাব মনে স্থান পায় নাই, বরং আমার ও

Page 19

দেশের সাধারণ অশিক্ষিত লােকের মধ্যে কোন প্রভেদ করা হয় নাই দেখিয়া একটু আনন্দিত হইয়াছিলাম, অধিকন্ত‍‍ু এই ব্যবস্থা মাতৃভক্তির প্রেমভাবে আহুতি দান করিল ৷ একে বুঝিলাম যােগ শিক্ষা ও দ্বন্দ্বজয়ে অপূর্ব্ব উপকরণ ও অনুকূল অবস্থা পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে আমি চরমপন্থী দলের একজন, যাহাদের মতে প্রজাতন্ত্র এবং ধনী-দরিদ্রে সাম্য জাতীয় ভাবের একটী প্রধান অঙ্গ ৷ মনে পড়িল সেই মতকে কার্য্যে পরিণত করা কর্ত্তব্য বলিয়া সুরাট যাত্রার সময় সকলে এক সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী হইয়াছিলাম, ক্যাম্পে নেতারা নিজেদের স্বতন্ত্র বন্দোবস্ত না করিয়া সকলের সঙ্গে একভাবে এক ঘরে শুইতাম ৷ ধনী, দরিদ্র, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, বাঙ্গালী, মারাঠা, পাঞ্জাবী, গুজরাটি, দিব্য ভ্রাতৃভাবে এক সঙ্গে থাকিতাম, শুইতাম, খাইতাম ৷ মাটীতে শয্যা, ডাল ভাত দহিই আহার, সর্ব্ববিষয়ে স্বদেশী ধরণের পরাকাষ্ঠা হইয়াছিল ৷ কলিকাতা ও বােম্বে সহরের বিলাত-ফেরত ও মাদ্রাজের তিলক কাটা ব্রাহ্মণসন্তান এক সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিলেন ৷ এই আলিপুর জেলে বাসকালীন আমার দেশের কয়েদী, আমার দেশের চাষা, লােহার, কুমার, ডােম-বাগ‍্দীর সমান আহার, সমান থাকা, সমান কষ্ট, সমান মানমৰ্য্যাদা লাভ করিয়া বুঝিলাম সর্ব্বশরীরবাসী নারায়ণ এই সাম্যবাদ, এই একতা, এই দেশব্যাপী ভ্ৰাতৃভাবে সম্মত হইয়া যেন আমার জীবনব্রতে স্বাক্ষর দিয়াছেন ৷ যেদিন জন্মভূমিরূপিণী জগজ্জননীর পবিত্র মণ্ডপে দেশের সর্ব্ব শ্রেণী ভ্রাতৃভাবে একপ্রাণ হইয়া জগতের সম্মুখে উন্নতমস্তকে দাঁড়াইবেন, সহবাসী আসামী ও কয়েদীদের প্রেমপূর্ণ আচরণে এবং রাজপুরুষদের এই সাম্যভাবে এই কারাবাসে হৃদয়ের মধ্যে সেই শুভদিনের পূর্ব্বাভাস লাভ করিয়া কতবার হর্ষান্বিত ও পুলকিত হইতাম ৷ সেদিন দেখিলাম পুনার “Indian Social Reformer” আমার একটী সহজ বােধগম্য উক্তি লইয়া বিদ্রূপ করিয়া বলিয়াছেন, “জেলে ভগবৎ-সান্নিধ্যের বড় ছড়াছড়ি হইল দেখিতেছি!” হায়, মানসম্ভ্রমান্বেষী অল্প বিদ্যায়, অল্প সদ‍্গুণে ৷ গর্ব্বিত মানুষের অহঙ্কার ও অল্পতা! জেলে, কুটীরে, আশ্রমে, দুঃখীর হৃদয়ে ভগবৎ-প্রকাশ না হইয়া বুঝি ধনীর বিলাস-মন্দিরে বা সুখান্বেষী স্বার্থান্ধ সংসারীর আরাম-শয্যায় তাহা সম্ভব? ভগবান বিদ্যা, সম্ভ্রম, লােকমান্যতা, লােকপ্রশংসা, বাহ্যিক স্বচ্ছন্দতা ও সভ্যতা দেখেন না ৷ তিনি দুঃখীর নিকটেই দয়াময়ী মাতৃরূপ প্রকাশ করেন ৷ যিনি মানবমাত্রে, জাতিতে, স্বদেশে, দুঃখী গরীব পতিত পাপীতে নারায়ণকে দেখিয়া সেই নারায়ণের সেবায় জীবন সমর্পণ করেন তাঁহারই হৃদয়ে নারায়ণ আসিয়া বসেন ৷ আর উত্থানােদ্যত পতিত জাতির মধ্যে দেশসেবকের

Page 20

নির্জ্জন কারাগারেই ভগবৎ-সান্নিধ্যের ছড়াছড়ি সম্ভব ৷

জেলর আসিয়া কম্বল ও থালা-বাটীর বন্দোবস্ত করিয়া চলিয়া গেলে পর আমি কম্বলের উপরে বসিয়া জেলের দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম ৷ এই নির্জ্জন কারাবাস লালবাজার হাজত হইতে অনেক ভাল বােধ হইল ৷ সেখানে সেই প্রকাণ্ড ঘরের নির্জ্জনতা যেন বিশাল বপু ছড়াইবার অবকাশ পাইয়া আরও নির্জ্জনতা বৃদ্ধি করে ৷ এইখানে ক্ষুদ্র ঘরের দেওয়াল সঙ্গীস্বরূপ যেন নিকটে আসিয়া ব্রহ্মময় হইয়া আলিঙ্গন করিতে উদ্যত ৷ সেইখানে দোতালার ঘরের অতি উচ্চ জানালা দিয়া বাহিরের আকাশও দেখা যায় না, এই জগতে গাছপালা, মানুষ, পশু-পক্ষী, বাড়ী-ঘর যে আছে তাহা অনেকবার কল্পনা করা কঠিন হয় ৷ এই স্থানে উঠানের দরজা খােলা থাকায় গরাদের নিকটে বসিলে বাহিরে জেলের খােলা জায়গা ও কয়েদীদের যাতায়াত দেখা যায় ৷ উঠানের দেওয়ালের গায়ে একটী বৃক্ষ ছিল, তাহার নয়নরঞ্জক নীলিমায় প্রাণ জুড়াইতাম ৷ ছয় ডিক্রীর ছয়টী ঘরের সামনে যে শান্ত্রী ঘুরিয়া থাকে, তাহার মুখ ও পদশব্দ অনেকবার পরিচিত বন্ধুর ঘােরাফেরার মত প্রিয় বােধ হইত ৷ ঘরের পার্শ্ববর্ত্তি গােয়ালঘরের কয়েদীরা ঘরের সম্মুখ দিয়া গরু চরাইতে লইয়া যাইত ৷ গরু ও গােপাল নিত্য প্রিয় দৃশ্য ছিল ৷ আলিপুরের নির্জ্জন কারাবাসে অপূর্ব্ব প্রেমশিক্ষা পাইলাম ৷ এইখানে আসিবার আগে মানুষের মধ্যেও আমার ব্যক্তিগত ভালবাসা অতিশয় ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আবদ্ধ ছিল এবং পশু-পক্ষীর উপর রুদ্ধ প্রেমস্রোত প্রায় বহিত না ৷ মনে আছে রবি বাবুর একটী কবিতায় মহিষের উপর গ্রাম্য বালকের গভীর ভালবাসা বড় সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে, সেই কবিতা প্রথম পড়িয়া কিছুতেই তাহা আমার হৃদয়ঙ্গম হয় নাই, ভাবের বর্ণনায় অতিশয়ােক্তি ও অস্বাভাবিকতা দোষ দেখিয়াছিলাম ৷ এখন পড়িলে তাহা অন্য চক্ষে দেখিতাম ৷ আলিপুরে বসিয়া বুঝিতে পারিলাম, সর্ব্বপ্রকার জীবের উপর মানুষের প্রাণে কি গভীর ভালবাসা স্থান পাইতে পারে, গরু, পাখী, পিপীলিকা পৰ্য্যন্ত দেখিয়া কি তীব্র আনন্দ স্ফুরণে মানুষের প্রাণ অস্থির হইতে পারে ৷

কারাবাসের প্রথম দিন শান্তিতে কাটিয়া গেল ৷ সবই নূতন, তাহাতে মনে স্ফূর্ত্তি হইল ৷ লালবাজার হাজতের সঙ্গে তুলনা করিয়া এই অবস্থাতেই প্রীতিলাভ করিলাম এবং ভগবানের উপর নির্ভর ছিল বলিয়া এখানে নির্জ্জনতা বােধ হয় নাই ৷ জেলের আহারের অদ্ভুত চেহারা দেখিয়াও এই ভাবের ব্যাঘাত হয় নাই ৷ মােটা ভাত, তাহাতেও খােলা, কঙ্কর, পােকা, চুল, ময়লা ইত্যাদি কত প্রকার

Page 21

মশলা দেওয়া, – স্বাদহীন ডালে জলের ভাগ অধিক, তরকারীর মধ্যে ঘাস পাতা শুদ্ধ শাক ৷ মানুষের আহার যে এত স্বাদহীন ও নিঃসার হইতে পারে, তাহা আমি আগে জানিতাম না ৷ এই শাকের বিমর্ষ গাঢ় কৃষ্ণ মূর্ত্তি দেখিয়াই ভয় পাইলাম, দুই গ্রাস খাইয়া তাহাকে ভক্তিপূর্ণ নমস্কার করিয়া বৰ্জ্জন করিলাম ৷ সকল কয়েদীর ভাগ্যে একই তরকারী জোটে, এবং একবার কোন প্রকার তরকারী আরম্ভ হইলে তাহা অনন্তকাল চলিতে থাকে ৷ এই সময় শাকের রাজত্ব ছিল ৷ দিন যায়, পক্ষ যায়, মাস যায়, কিন্ত‍‍ু দুবেলা শাকের তরকারী, ঐ ডাল, ঐ ভাত ৷ জিনিষটা বদলান দূরের কথা, চেহারারও লেশমাত্র পরিবর্ত্তন হয় নাই, তাহার ঐ নিত্য সনাতন অনাদ্যনন্ত অপরিণামাতীত অদ্বিতীয় রূপ ৷ দুই সন্ধ্যার মধ্যেই কয়েদীকে এই নশ্বর মায়াজগতের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে প্রতীতি জন্মাইবে ৷ এই বিষয়েও অন্য আসামী হইতে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, তাহাও ডাক্তারবাবুর দয়ায় ৷ তিনি আমার জন্য হাসপাতাল হইতে দুধের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তদ্বারা কয়েকদিন শাক-দর্শন হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছিলাম ৷

সেই রাত্রে সকাল সকাল ঘুমাইলাম, কিন্ত‍‍ু নিশ্চিন্ত নিদ্রাভােগ করা নির্জ্জন কারাবাসের নিয়ম নয়, তাহাতে কয়েদীর সুখপ্রিয়তা জাগিতে পারে ৷ সেই জন্য এই নিয়ম আছে যে, যতবার পাহারা বদলায়, ততবার কয়েদীকে ডাক হাঁক করিয়া উঠাইতে হয়, সাড়া না দিলে ছাড়িতে নাই ৷ যাঁহারা যাঁহারা ছয় ডিক্রীতে পাহারা দিতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে এই কৰ্ত্তব্যপালনে বিমুখ ছিলেন, – সিপাহীদের মধ্যে প্রায়ই কঠোর কর্ত্তব্য জ্ঞান অপেক্ষা দয়া ও সহানুভূতির ভাব অধিক ছিল, বিশেষতঃ হিন্দুস্থানীদের স্বভাব এইরূপ ৷ কয়েকজন কিন্ত‍‍ু ছাড়ে নাই ৷ তাহারা আমাদিগকে এইরূপে উঠাইয়া এই কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করিত, “বাবু ভাল আছেন ত?” এই অসময় রহস্য সব সময় প্রীতিকর হইত না, তবে বুঝিলাম যাহারা এইরূপ করিতেছে তাহারা সরলভাবে নিয়ম বলিয়া আমাদিগকে উঠাইতেছে ৷ কয়েকদিন বিরক্ত হইয়াও ইহা সহ্য করিলাম, শেষে নিদ্রা রক্ষার জন্য ধমক দিতে হইল ৷ দুই চারিবার ধমক দিবার পরে দেখিলাম, রাত্রে কুশল সংবাদ নেওয়া প্রথা আপনিই উঠিয়া গেল ৷

পরদিন সকালে চারিটা বাজিয়া পনের মিনিটে জেলের ঘণ্টা বাজিল ৷ কয়েদীদের উঠাইবার জন্য এই প্রথম ঘণ্টা ৷ কয়েক মিনিট পর আবার ঘণ্টা বাজে, তাহার পর কয়েদীরা ফাইলে বাহিরে আসে, হাত মুখ ধুইয়া লফ‍্সী খাইয়া খাটুনি আরম্ভ করে ৷ এত ঘণ্টা বাজানাের মধ্যে ঘুম হওয়া অসম্ভব বুঝিয়া আমিও উঠিলাম ৷

Page 22

৫টার সময় গরাদ খােলা হয়, আমি হাত-মুখ ধুইয়া আবার ঘরে বসিলাম ৷ অল্পক্ষণ পরে লফ‍্সী আমার দরজায় হাজির হইল কিন্ত‍‍ু সেই দিন তাহা খাই নাই, কেবল তাহার সহিত চাক্ষুষ পরিচয় হইল ৷ ইহার কয়েকদিন পরে প্রথমবার এই পরমান্ন ভােগ হয় ৷ লফ‍্সীর অর্থ ফেনের সহিত সিদ্ধ ভাত, ইহাই কয়েদীর ছােট হাজরী ৷ লফ‍্সীর ত্রিমূৰ্ত্তি বা তিন অবস্থা আছে ৷ প্রথম দিন লফ‍্সীর প্রাজ্ঞভাব, অমিশ্রিত মূলপদার্থ, শুদ্ধ শিব শুভ্রমূৰ্ত্তি ৷ দ্বিতীয় দিন লফ‍্সীর হিরণ্যগর্ভ, ডালে সিদ্ধ, খিচুড়ি নামে অভিহিত, পীতবর্ণ, নানা ধর্মসঙ্কুল ৷ তৃতীয় দিনে লফ‍্সীর বিরাট মূর্ত্তি অল্প গুড়ে মিশ্রিত, ধূসর বর্ণ, কিয়ৎ পরিমাণে মনুষ্যের ব্যবহার যােগ্য ৷ আমি প্রাজ্ঞ ও হিরণ্যগর্ভ সেবন সাধারণ মর্ত্য মনুষ্যের অতীত বলিয়া ত্যাগ করিয়াছিলাম, এক একবার বিরাটের দুগ্রাস উদরস্থ করিয়া বৃটিশ রাজত্বের নানা সদ‍্গুণ ও পাশ্চাত্য সভ্যতার উচ্চ দরের humanitarianism ভাবিতে ভাবিতে আনন্দে মগ্ন হইতাম ৷ বলা উচিত লফ‍্সীই বাঙ্গালী কয়েদীর একমাত্র পুষ্টিকর আহার, আর সবই সারশূন্য ৷ তাহা হইলেও বা কি হইবে? তাহার যেরূপ স্বাদ, তাহা কেবল ক্ষুধার চোটেই খাওয়া যায়, তাহাও জোর করিয়া, মনকে কত বুঝাইয়া তবে খাইতে হয় ৷

সেদিন সাড়ে এগারটার সময় স্নান করিলাম ৷ প্রথম চারি পাঁচ দিন বাড়ী হইতে যাহা পরিয়া আসিয়াছিলাম, তাহাই পরিয়া থাকিতে হইল ৷ তবে স্নানের সময় যে গােয়ালঘরের বৃদ্ধ কয়েদী ওয়ার্ডার আমার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত হইয়াছিলেন তিনি একটী এণ্ডির দেড় হাত চওড়া কাপড় যােগাড় করিয়াছিলেন, আমার একমাত্র বস্ত্র শুকান পৰ্য্যন্ত ইহা পরিয়া বসিয়া থাকিতাম ৷ আমায় কাপড় কাচিতে বা বাসন মাজিতে হইত না, গােয়ালঘরের একজন কয়েদী ইহা করিত ৷ এগারটার সময় খাওয়া ৷ ঘরে চুপড়ীর সান্নিধ্য বর্জ্জন করিবার জন্য গ্রীষ্মের রৌদ্র সহ্য করিয়া প্রায়ই উঠানে খাইতাম ৷ শান্ত্রীও ইহাতে বাধা দিতেন না ৷ সন্ধ্যার খাওয়া পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটার সময় হইত ৷ তাহার পর আর গরাদ খােলা নিষিদ্ধ ছিল ৷ সাতটার সময় সন্ধ্যার ঘণ্টা বাজে ৷ মুখ্য জমাদার কয়েদী ওয়ার্ডারদের একত্র করিয়া উচ্চৈঃস্বরে নাম পড়িয়া যান, তাহার পরে সকলে স্ব স্ব স্থানে যায় ৷ শ্রান্ত কয়েদী নিদ্রার শরণ লইয়া জেলের সেই একমাত্র সুখ অনুভব করে ৷ এই সময় দুৰ্ব্বলচেতা নিজের দুর্ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ জেলদুঃখ ভাবিয়া কাঁদে ৷ ভগবদ্ভক্ত, নীরব রাত্রিতে ঈশ্বর-সান্নিধ্য অনুভব করিয়া প্রার্থনায় বা ধ্যানে আনন্দ ভােগ করেন ৷ রাত্রিতে এই দুর্ভাগ্য-পতিত সমাজ-পীড়িত তিন সহস্র ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাণীর

Page 23

সেই আলিপুর জেল স্বরূপ প্রকাণ্ড যন্ত্রণাগৃহ বিশাল নীরবতায় মগ্ন হয় ৷

যাঁহারা আমার সঙ্গে এক অভিযােগে অভিযুক্ত, তাঁহাদের সঙ্গে জেলে প্রায়ই দেখা হইত না ৷ তাঁহারা স্বতন্ত্র স্থানে রক্ষিত ছিলেন ৷ ছয় ডিক্রীর পশ্চাদ্ভাগে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘরের দুটী লাইন ছিল, এই দুটী লাইনে সব শুদ্ধ চুয়াল্লিশটী ঘর, সেই জন্য ইহাকে চুয়াল্লিশ ডিক্রী বলে ৷ এই ডিক্রীর একটী লাইনে অধিকাংশ আসামীর বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল ৷ তাঁহারা cell-এ আবদ্ধ হইয়াও নির্জ্জন কারাবাস ভােগ করেন নাই, কেন না এক ঘরে তিনজন করিয়া থাকিতেন ৷ জেলের অন্য দিকে আর একটী ডিক্রী ছিল, তাহাতে কয়েকটী বড় ঘর ছিল; এক একটী ঘরে বারজন পৰ্য্যন্ত থাকিতে পারিত ৷ যাঁহাদের ভাগ্যে এই ডিক্রী পড়িত, তাঁহারা অধিক সুখে থাকিতেন ৷ এই ডিক্রীতে অনেকে এক ঘরে আবদ্ধ ছিলেন, তাঁহারা রাত দিন গল্প করিবার অবসর ও মনুষ্য-সংসর্গ লাভ করিয়া সুখে কালযাপন করিতেন ৷ তবে তাঁহাদের মধ্যে একজন এই সুখে বঞ্চিত ছিলেন ৷ ইনি হেমচন্দ্র দাস ৷ জানি না কেন ইঁহার উপর কর্ত্তৃপক্ষের বিশেষ ভয় অথবা ক্রোধ ছিল, এত লােকের মধ্যে নির্জ্জন কারাবাসের যন্ত্রণা ভােগ করাইবার জন্য কর্ত্তৃপক্ষ তাঁহাকেই স্বতন্ত্র করিয়াছিলেন ৷ হেমচন্দ্রের নিজের ধারণা ছিল যে, পুলিস অশেষ চেষ্টা করিয়াও তাঁহাকে দোষ স্বীকার করাইতে পারেন নাই বলিয়া তাঁহার উপর এই ক্রোধ ৷ তাঁহাকে এই ডিক্রীর একটী অতি ক্ষুদ্র ঘরে আবদ্ধ করিয়া বাহিরের দরজা পৰ্য্যন্ত বন্ধ করিয়া রাখা হইত ৷ বলিয়াছি, ইহাই এই বিশেষ সাজার চরম অবস্থা ৷ মাঝে মাঝে পুলিস নানা জাতির, নানা বর্ণের, নানা আকৃতির সাক্ষী আনাইয়া identification প্রহসন অভিনয় করাইত ৷ তখন আমাদের সকলকে আফিসের সম্মুখে এক দীর্ঘ শ্রেণীবদ্ধ করিয়া দাঁড় করাইত ৷ জেলের কর্ত্তৃপক্ষেরা আমাদের সঙ্গে জেলের অন্য অন্য মােকদ্দমার আসামী মিশাইয়া তাহাদিগকে দেখাইতেন ৷ ইহা কিন্ত‍‍ু নামের জন্য ৷ এই আসামীদের মধ্যে শিক্ষিত বা ভদ্রলােক একজনও ছিল না, যখন তাহাদের সহিত এক শ্রেণীতে দাঁড়াইতাম, তখন এই দুই প্রকার আসামীবর্গের এত অমিল থাকিত যে, এক দিকে বােমার মােকদ্দমায় অভিযুক্ত বালকদের তেজস্বী তীক্ষ্ণবুদ্ধি প্রকাশক মুখের ভাব ও গঠন এবং অন্যদিকে সাধারণ আসামীর মলিন পােষাক ও নিস্তেজ মুখের চেহারা দেখিয়া কে কোন শ্রেণীর লােক তাহা যিনি নির্ণয় করিতে না পারিতেন, তাঁহাকে নির্ব্বোধ কেন, নিকৃষ্ট মনুষ্যবুদ্ধিরহিত বলিতে হয় ৷ এই identification প্যারেড আসামীদের অপ্রিয়

Page 24

ছিল না ৷ এতদ্বারা জেলের একঘেয়ে জীবনে একটী বৈচিত্র্য হইত, এবং পরস্পরকে দুটী কথাও বলিবার অবকাশ পাওয়া যাইত ৷ গ্রেপ্তারের পর এইরূপ একটী প্যারেডে আমার ভাই বারীন্দ্রকে প্রথম দেখিতে পাইলাম, কিন্ত‍‍ু তাহার সঙ্গে তখন কথা হয় নাই ৷ প্রায়ই নরেন্দ্রনাথ গােস্বামীই আমার পার্শ্বে দাঁড়াইতেন, সেই জন্য তাঁহার সঙ্গে তখন এই সময়ে আলাপ একটু অধিক হইয়াছিল ৷ গোঁসাই অতিশয় সুপুরুষ, লম্বা, ফরসা, বলিষ্ঠ, পুষ্টকায় কিন্ত‍‍ু তাঁহার চোখের ভাব কুবৃত্তি প্রকাশক ছিল, কথায়ও বুদ্ধিমত্তার কোন লক্ষণ পাই নাই ৷ এই বিষয়ে অন্য যুবকদের সঙ্গে তাঁহার বিশেষ প্রভেদ ছিল ৷ তাঁহাদের মুখে প্রায়ই উচ্চ ও পবিত্র ভাব অধিক এবং কথায় প্রখর বুদ্ধি, জ্ঞানলিপ্সা ও মহৎ স্বার্থহীন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাইত ৷ গোঁসাইয়ের কথা নির্ব্বোধ ও লঘুচেতা লােকের কথার ন্যায় হইলেও তেজ ও সাহসপূর্ণ ছিল ৷ তাঁহার তখন সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, তিনি খালাস পাইবেন ৷ তিনি বলিতেন, “আমার বাবা মােকদ্দমার কীট, তাঁহার সঙ্গে পুলিস কখনও পারিবে না ৷ আমার এজাহারও আমার বিরুদ্ধে যাইবে না, প্রমাণিত হইবে পুলিস আমাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়া এজাহার করাইয়াছে ৷” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি পুলিসের হাতে ছিলে ৷ সাক্ষী কোথায়?” গোঁসাই অম্লানবদনে বলিলেন, “আমার বাবা কত শত মােকদ্দমা করিয়াছেন, ও সব বেশ বােঝেন ৷ সাক্ষীর অভাব হইবে না ৷” এইরূপ লােকই Approver হয় ৷

ইতিপূৰ্ব্বে আসামীর অনর্থক অসুবিধা ও নানা কষ্টের কথা বলা হইয়াছে কিন্ত‍‍ু ইহাও বলা উচিত যে এই সকলই জেলের প্রণালীর দোষ; এই সকল কষ্ট জেলের কাহারও ব্যক্তিগত নিষ্ঠুরতা বা মনুষ্যোচিত গুণের অভাবে হয় নাই ৷ বরং আলিপুর জেলে যাঁহাদের উপর কর্ত্তৃত্বের ভার ছিল, তঁহারা সকলেই অতিশয় ভদ্র, দয়াবান এবং ন্যায়পরায়ণ ৷ যদি কোন জেলে কয়েদীর যন্ত্রণার কম হয়, য়ুরােপীয় জেল প্রণালীর অমানুষিক বর্ব্বরতা দয়ায় ও ন্যায়পরায়ণতায় লঘুকৃত হয়, তবে আলিপুর জেলে ও এমারসন সাহেবের রাজত্বে সেই মন্দের ভাল ঘটিয়াছে ৷ এই ভাল হইবার দুটী প্রধান কারণ জেলের ইংরাজ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট এমারসন সাহেব ও বাঙ্গালী হাসপাতাল আসিষ্টাণ্ট ডাক্তার বৈদ্যনাথ চাটার্জ্জীর অসাধারণ গুণ ৷ ইঁহাদের মধ্যে একজন য়ুরােপের লুপ্তপ্রায় খৃষ্টান আদর্শের অবতার, অপরটী হিন্দুধর্মের সারমর্ম্ম দয়া ও পরােপকারের জীবন্ত মূর্ত্তি ৷ এমারসন সাহেবের মত ইংরাজ আর এই দেশে বড় আসে না, বিলাতেও আর বড় জন্মায় না ৷ তাঁহার শরীরে খৃষ্টান gentleman-এর যে সকল গুণ হওয়া উচিত, সকলই এক

Page 25

সময়ে অবতীর্ণ হইয়াছে ৷ তিনি শান্তিপ্রিয়, বিচারশীল, দয়াদাক্ষিণ্যে অতুলনীয়, ন্যায়বান; ভদ্র ব্যবহার ভিন্ন অধমের প্রতিও অভদ্রতা প্রকাশ করিতে স্বভাবতঃ অক্ষম, সরল, অকপট, সংযমী ৷ দোষের মধ্যে তাঁহার কৰ্ম্মকুশলতা ও উদ্যম কম ছিল, জেলরের উপর সমুদয় কৰ্ম্মভার অর্পণ করিয়া তিনি স্বয়ং নিশ্চেষ্ট থাকিতেন ৷ ইহাতে যে বড় বেশী ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা আমার বােধ হয় না ৷ জেলর যােগেন্দ্র বাবু দক্ষ ও যােগ্য পুরুষ ছিলেন, বহুমূত্র রােগে অতিশয় ক্লিষ্ট হইয়াও স্বয়ং কাৰ্য্য দেখিতেন এবং সাহেবের স্বভাব চিনিতেন বলিয়া জেলে ন্যায়নিষ্ঠা ও ক্রুরতার অভাবই রক্ষা করিতেন ৷ তবে তিনি এমারসনের মত মহাত্মা লােক ছিলেন না, সামান্য বাঙ্গালী সরকারী ভৃত্য মাত্র, সাহেবের মন রাখিতে জানিতেন, দক্ষতা ও কর্ত্তব্যবুদ্ধির সহিত কৰ্ম্ম করিতেন, স্বাভাবিক ভদ্রতা ও শান্তভাবের সহিত লােকের সঙ্গে ব্যবহার করিতেন, ইহা ছাড়া তাঁহার মধ্যে কোন বিশেষ গুণ লক্ষ্য করি নাই ৷ চাকরীর উপর তাঁহার প্রবল মায়া ছিল ৷ বিশেষতঃ তখন মে মাস, পেনশন নিবার সময় তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইয়াছিল, জানুয়ারীতে পেনশন নিয়া দীর্ঘ পরিশ্রমােপার্জ্জিত বিশ্রাম ভােগ করিবার আশা তখন বর্ত্তমান ছিল ৷ আলিপুরের বােমার মােকদ্দমার আসামীর আবির্ভাব দেখিয়া আমাদের জেলর মহাশয় নিতান্ত ভীত ও চিন্তিত হইয়াছিলেন ৷ এই সকল উগ্রস্বভাব তেজস্বী বাঙ্গালী বালক কোন্ দিনে কি কাণ্ড করিয়া বসিবেন, এই ভাবনায় তিনি অস্থির হইয়া থাকিতেন ৷ তিনি বলিতেন, তালগাছে চড়িতে আর দেড় ইঞ্চি বাকী ৷ কিন্ত‍‍ু সেই দেড় ইঞ্চির অর্দ্ধেকটা মাত্র তিনি চড়িতে পারিয়াছিলেন ৷ আগস্ট মাসের শেষেই বােকানন সাহেব জেলে পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে আসিয়া সন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইয়া গেলেন ৷ জেলর মহাশয় আনন্দে বলিলেন, “আমার কর্ম্মকালে এই সাহেবের শেষ আসা, আর পেনশনের ভয় নাই ৷” হায়, মানুষ মাত্রের অন্ধতা! কবি যথার্থই বলিয়াছেন, বিধি দুঃখী মনুষ্যের দুটী পরম উপকার করিয়াছেন ৷ প্রথম, ভবিষ্যৎ নিবিড় অন্ধকারে ঢাকিয়া রাখিয়াছেন, দ্বিতীয়, তাহার একমাত্র অবলম্বন ও সান্ত্বনাস্থল স্বরূপ অন্ধ আশা তাহাকে দিয়াছেন ৷ এই উক্তির চার পাঁচদিন পরেই নরেন গোঁসাই কানাইয়ের হস্তে হত হইলেন, বােকাননের জেলে ঘন ঘন আসা আরম্ভ হইল ৷ তাহার ফলে যােগেন্দ্র বাবুর অকালে কৰ্ম্ম গেল এবং শােক ও রােগের মিলিত আক্রমণে তাঁহার দেহত্যাগও ঘটিল ৷ এইরূপ কর্ম্মচারীর উপর সম্পূর্ণ ভার না দিয়া এমারসন সাহেব যদি স্বয়ং সব কাৰ্য্য দেখিতেন, তাহা হইলে তাঁহার রাজত্বকালে আলিপুর জেলের অধিক সংস্কার ও উন্নতি হইবার সম্ভাবনা ছিল ৷

Page 26

তিনি যতটুকু দেখিতেন, তাহা সুসম্পন্নও করিতেন, তাঁহার চরিত্রগত গুণেও জেলটী নরক না হইয়া মানুষের কঠোর শাস্তির স্থানই হইয়া রহিয়াছিল ৷ তিনি অন্যত্র গেলেও তাঁহার সাধুতার ফল সম্পূর্ণ ঘুচে নাই, এখনও পরবর্ত্তী কর্ম্মচারীগণ তাঁহার সাধুতা দশ আনা বজায় রাখিতে বাধ্য হইয়াছেন ৷

যেমন জেলের অন্যান্য বিভাগে বাঙ্গালী যােগেন বাবু হর্ত্তাকর্ত্তা ছিলেন, তেমনই হাসপাতালে বাঙ্গালী ডাক্তার বৈদ্যনাথ বাবু সৰ্ব্বেসৰ্ব্বা ছিলেন ৷ তাঁহার উপরিতন কর্ম্মচারী ডাক্তার ডেলি, এমারসন সাহেবের ন্যায় দয়াবান না হইয়াও অতিশয় ভদ্রলােক ও বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন ৷ তিনি বালকদের শান্ত আচরণ, প্রফুল্লতা ও বাধ্যতা দেখিয়া অশেষ প্রশংসা করিতেন এবং অল্প বয়স্কদের সহিত হাসিতামাসা ও অপর আসামীদের সহিত রাজনীতি, ধর্ম্ম ও দর্শন বিষয়ক চৰ্চ্চা করিতেন ৷ ডাক্তার সাহেব আইরিশ বংশজাত, সেই উদার ও ভাবপ্রবণ জাতির অনেক গুণ তাঁহার শরীরে আশ্রয় লাভ করিয়াছিল ৷ তাঁহার লেশমাত্র ক্রূরতা ছিল না, এক একবার ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া রূঢ় কথা বা কঠোর আচরণ করিতেন কিন্ত‍‍ু প্রায়ই উপকার করাই তাঁহার প্রিয় ছিল ৷ তিনি জেলের কয়েদীদের চাতুরী ও কৃত্রিম রােগ দেখিতে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্ত‍‍ু এমনও হইত যে প্রকৃত রােগীকেও এই কৃত্রিমতার ভয়ে উপেক্ষা করিতেন, তবে প্রকৃত রােগ বুঝিতে পারিলে অতি যত্ন ও দয়ার সহিত রােগীর ব্যবস্থা করিতেন ৷ আমার একবার সামান্য জ্বর হয় ৷ তখন বর্ষাকাল, অনেক বাতায়নযুক্ত প্রকাণ্ড দালানে জলসিক্ত মুক্ত বায়ু খেলা করিত, তথাপি আমি হাসপাতালে যাইতে বা ঔষধ খাইতে অনিচ্ছুক ছিলাম ৷ রােগ ও চিকিৎসা সম্বন্ধে আমার মত পরিবর্ত্তন হইয়াছিল এবং ঔষধ সেবনে আমার আর বড় আস্থা ছিল না, রােগ কঠোর না হইলে প্রকৃতির সাধারণ ক্রিয়াতেই স্বাস্থ্যলাভ হইবে, এই বিশ্বাস ছিল ৷ বর্ষার বাতাস স্পর্শে যাহা অনিষ্ট হওয়া সম্ভব, তাহা যােগবলে দমন করিয়া নিজের তর্কবুদ্ধির নিকট আমার যােগশিক্ষাগত ক্রিয়া সকলের যাথার্থ্য ও সফলতা প্রতিপাদন করিবার ইচ্ছা ছিল ৷ ডাক্তার সাহেব কিন্ত‍‍ু আমার জন্য মহা চিন্তিত ছিলেন, বড় আগ্রহের সহিত তিনি হাসপাতালে যাইবার প্রয়ােজনীয়তা আমাকে বুঝাইলেন ৷ সেইস্থানে গমন করিলে যতদূর সম্ভব নিজের বাড়ীর মত থাকিবার খাইবার ব্যবস্থা করিয়া আমাকে সাদরে রাখিলেন ৷ পাছে ওয়ার্ডে থাকিলে বর্ষার জন্য আমার স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এইজন্য তাঁহার ইচ্ছা ছিল আমাকে অনেকদিন এই সুখে রাখেন ৷ কিন্ত‍‍ু আমি

Page 27

জোর করিয়া ওয়ার্ডে ফিরিয়া গেলাম, আর হাসপাতালে থাকিতে অসম্মত হইলাম ৷ তাঁহার সকলের উপর সমান অনুগ্রহ ছিল না, বিশেষতঃ যাঁহারা পুষ্টশরীর ও বলবান ছিলেন, তাঁহাদের রােগ হইলেও হাসপাতালে রাখিতে ভয় করিতেন ৷ তাঁহার এই ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে যদি জেলে কোনও কাণ্ড হয় তাহা সবল ও চঞ্চল বালকদের দ্বারা হইবে ৷ শেষে ঠিক ইহার বিপরীত ফল হইল, হাসপাতালে যে কাণ্ড ঘটিল, তাহা ব্যাধিগ্রস্ত, বিশীর্ণ, শুষ্ককায় সত্যেন্দ্র নাথ বসু এবং রােগক্লিষ্ট ধীরপ্রকৃতি অল্পভাষী কানাইলাল ঘটাইলেন ৷ ডাক্তার ডেলির এই সকল গুণ থাকিলেও বৈদ্যনাথ বাবুই তাঁহার অধিকাংশ সৎকার্য্যের প্রবর্ত্তক ও প্রেরণাদায়ক ছিলেন ৷ বাস্তবিক বৈদ্যনাথ বাবুর ন্যায় হৃদয়বান লােক আমি আগেও দেখি নাই, পরেও দেখিবার আশা করি না, তিনি যেন দয়া ও উপকার করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন ৷ কোনও দুঃখ কাহিনী অবগত হওয়া এবং তাহা লাঘব করিবার জন্য ধাবিত হওয়া তাঁহার চরিত্রে যেন স্বাভাবিক কারণ ও অবশ্যম্ভাবী কাৰ্য্য হইয়াছিল ৷ তিনি এই যন্ত্রণাপূর্ণ দুঃখালয়ে যেন নরকের প্রাণী সকলকে স্বর্গের সযত্ন সঞ্চিত নন্দনবারি বিতরণ করিতেন ৷ কোনও অভাব, অন্যায় বা অনর্থক কষ্ট অপনােদন করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় ছিল তাহা ডাক্তারবাবুর কর্ণে পৌঁছাইয়া দেওয়া ৷ তাহা অপনােদন করা তাঁহার ক্ষমতার ভিতরে থাকিলে তিনি সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে ছাড়িতেন না ৷ বৈদ্যনাথ বাবু হৃদয়ে গভীর দেশভক্তি পােষণ করিতেন কিন্ত‍‍ু সরকারী চাকর বলিয়া সেই প্রাণের ভাবকে চরিতার্থ করিতে অক্ষম ছিলেন ৷ তাঁহার একমাত্র দোষ অতিরিক্ত সহানুভূতি ৷ কিন্ত‍‍ু সেই ভাব জেলের কর্ম্মচারীর পক্ষে দোষ হইলেও উচ্চ নীতির অনুসারে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ এবং ভগবানের প্রিয়তম গুণ বলা যায় ৷ সাধারণ কয়েদী ও “বন্দেমাতরম্” কয়েদীতে তাঁহার পক্ষে কোনও ভেদ ছিল না; পীড়িত দেখিলে সকলকেই যত্ন করিয়া হাসপাতালে রাখিতেন এবং সম্পূর্ণ শারীরিক স্বাস্থ্যলাভ না হওয়া পর্য্যন্ত ছাড়িতে ইচ্ছা করিতেন না ৷ এই দোষই তাঁহার পদচ্যুতির প্রকৃত কারণ ৷ গোঁসাইয়ের হত্যার পরে কর্ত্তৃপক্ষ তাঁহার এই আচরণে সন্দেহ করিয়া তাঁহাকে অন্যায় ভাবে কৰ্ম্মচ্যুত করেন ৷

এই সকল কর্ম্মচারীদের দয়া ও মনুষ্যোচিত ব্যবহার বর্ণনা করার বিশেষ প্রয়ােজন আছে ৷ জেলে আমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করা হইয়াছিল, ইতিপূর্ব্বে তাহার আলােচনা করিতে বাধ্য হইয়াছি এবং ইহার পরেও বৃটিশ জেলপ্রণালীর অমানুষিক নিষ্ঠুরতা প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিব ৷ পাছে কোনও পাঠক এই

Page 28

নিষ্ঠুরতা কর্ম্মচারীদের চরিত্রের কুফল বলিয়া মনে করেন, সেইজন্য মুখ্য কর্ম্মচারীদের গুণ বর্ণনা করিলাম ৷ কারাবাসের প্রথম অবস্থার বিবরণে তাঁহাদের এই সকল গুণের আরও প্রমাণ পাওয়া যাইবে ৷

নির্জ্জন কারাবাসে প্রথম দিনের মনের ভাব বর্ণনা করিয়াছি ৷ এই নির্জ্জন কারাবাসে কালযাপনের উপায় স্বরূপ পুস্তক বা অন্য কোন বস্ত‍‍ু ব্যতীত কয়েকদিন থাকিতে হইয়াছিল ৷ পরে এমারসন সাহেব আসিয়া আমাকে বাড়ী হইতে ধুতি জামা ও পড়িবার বই আনাইবার অনুমতি দিয়া যান ৷ আমি কৰ্ম্মচারীদের নিকট কালি কলম ও জেলের ছাপান চিঠির কাগজ আনাইয়া আমার পূজনীয় মেসাে মহাশয় সঞ্জীবনীর সুপ্রসিদ্ধ সম্পাদককে ধুতি জামা এবং পড়িবার বইর মধ্যে গীতা ও উপনিষদ পাঠাইতে অনুরােধ করিলাম ৷ এই পুস্তকদ্বয় আমার হাতে পৌঁছিতে দুই চারিদিন লাগে ৷ তাহার পূর্ব্বে নির্জ্জন কারাবাসের মহত্ত্ব বুঝিবার যথেষ্ট অবসর পাইয়াছিলাম ৷ কেন এইরূপ কারাবাসে দৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিরও ধ্বংস হয় এবং তাহা অচিরে উন্মাদ অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তাহাও বুঝিতে পারিলাম এবং সেই অবস্থায়ই ভগবানের অসীম দয়া এবং তাঁহার সঙ্গে যুক্ত হইবার কি দুর্লভ সুবিধা হয় তাহাও হৃদয়ঙ্গম হইল ৷ কারাবাসের পূর্ব্বে আমার সকালে এক ঘণ্টা ও সন্ধ্যাবেলায় এক ঘণ্টা ধ্যান করিবার অভ্যাস ছিল ৷ এই নির্জ্জন কারাবাসে আর কোনও কাৰ্য্য না থাকায় অধিককাল ধ্যানে থাকিবার চেষ্টা করিলাম ৷ কিন্ত‍‍ু মানুষের সহস্র-পথ-ধাবিত চঞ্চল মনকে ধ্যানার্থে অনেকটা সংযত ও এক লক্ষ্যগত রাখা অনভ্যস্ত লােকের পক্ষে সহজ নয় ৷ কোনও মতে দেড়ঘণ্টা দুইঘণ্টা একভাবে রাখিতে পারিতাম, শেষে মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিত, দেহও অবসন্ন হইয়া পড়িত ৷ প্রথম নানা চিন্তা লইয়া থাকিতাম ৷ তাহার পরে সেই মানুষের আলাপরহিত চিন্তার বিষয়শূন্য অসহনীয় অকর্ম্মণ্যতায় মন ধীরে ধীরে চিন্তাশক্তি রহিত হইতে লাগিল ৷ এমন অবস্থা হইতে লাগিল যেন সহস্র অস্পষ্ট চিন্তা মনের দ্বার সকলের চারিদিকে ঘুরিতেছে অথচ প্রবেশ পথ নিরুদ্ধ; দুয়েকটী প্রবেশ করিতে সমর্থ হইয়াও সেই নিস্তব্ধ মনােরাজ্যের নীরবতায় ভীত হইয়া নিঃশব্দে পলায়ন করিতেছে ৷ এই অনিশ্চিত অবশ অবস্থায় অতিশয় মানসিক কষ্ট পাইতে লাগিলাম ৷ প্রকৃতির শােভায় চিত্তবৃত্তি স্নিগ্ধ হইবার এবং তপ্ত মন সান্ত্বনা পাইবার আশায় বাহিরে চাহিয়া দেখিলাম, কিন্ত‍‍ু সেই একমাত্র বৃক্ষ, নীল আকাশের পরিমিত খণ্ডটুকু এবং সেই জেলের নিরানন্দ দৃশ্যে কতক্ষণ মানুষের এই অবস্থাপ্রাপ্ত মন সান্ত্বনা লাভ করিতে পারে? দেওয়ালের দিকে চাহিলাম ৷ জেলের ঘরের সেই নির্জ্জীব সাদা

Page 29

দেওয়াল দর্শনে যেন মন আরও নিরুপায় হইয়া কেবল বদ্ধাবস্থার যন্ত্রণাই উপলব্ধি করিয়া মস্তিষ্ক পিঞ্জরে ছটফট করিতে লাগিল ৷ আবার ধ্যানে বসিলাম, ধ্যান কিছুতেই হইল না বরং সেই তীব্র বিফল চেষ্টায় মন আরও শ্রান্ত, অকর্ম্মণ্য ও দগ্ধ হইতে লাগিল ৷ চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম, শেষে মাটীতে কয়েকটী বড় বড় কাল পিপীলিকা গর্ত্তের নিকট বেড়াইতেছে দেখিলাম, তাহাদের গতিবিধি ও চেষ্টা চরিত্র নিরীক্ষণ করিতে সময় কাটিয়া গেল ৷ তাহার পরে দেখিলাম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল পিপীলিকা বেড়াইতেছে ৷ কালতে লালে বড় ঝগড়া, কালগুলি লালকে পাইয়া দংশন করিতে করিতে প্রাণবধ করিতে লাগিল ৷ অত্যাচার পীড়িত লাল পিপীলিকার উপর বড় দয়া ও সহানুভূতি হইল ৷ আমি কালগুলিকে তাড়াইয়া তাহাদের বাঁচাইতে লাগিলাম ৷ ইহাতে একটী কাৰ্য্য জুটিল, চিন্তার বিষয়ও পাওয়া গেল, পিপীলিকা-গুলির সাহায্যে এই কয়েকদিন কাটান গেল ৷ তথাপি দীর্ঘ দিনাৰ্দ্ধ যাপন করিবার উপায় আর জুটিতেছিল না ৷ মনকে বুঝাইয়া দিলাম, জোর করিয়া চিন্তা আনিলাম, কিন্ত‍‍ু দিন দিন মন বিদ্রোহী হইতে লাগিল, হাহাকার করিতে লাগিল ৷ কাল যেন তাহার উপর অসহ্য ভার হইয়া পীড়ন করিতেছে, সেই চাপে চূর্ণ হইয়া সে হাঁপ ছাড়িবার শক্তিও পাইতেছে না, যেন স্বপ্নে শত্রুদ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি গলাপীড়নে মরিয়া যাইতেছে অথচ হাত পা থাকিয়াও নড়িবার শক্তি রহিত ৷ আমি এই অবস্থা দেখিয়া আশ্চৰ্য্য হইলাম ৷ সত্য বটে, আমি কখন অকর্মণ্য বা নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিতে ভালবাসি নাই, তবে কতবার একাকী থাকিয়া চিন্তায় কালযাপন করিয়াছি, এক্ষণে এতই কি মনের দুর্ব্বলতা হইয়াছে যে অল্পদিনের নির্জ্জনতায় এত আকুল হইয়া পড়িতেছি? ভাবিতে লাগিলাম, হয়ত সেই স্বেচ্ছাপ্রাপ্ত নির্জ্জনতা ও এই পরেচ্ছাপ্রাপ্ত নির্জ্জনতায় অনেক প্রভেদ আছে ৷ বাড়ীতে বসিয়া একাকী থাকা এক কথা, আর পরের ইচ্ছায় কারাগৃহে এই নির্জ্জনবাস স্বতন্ত্র কথা ৷ সেখানে যখন ইচ্ছা হয় মানুষের আশ্রয় লইতে পারি, পুস্তকগত জ্ঞান ও ভাষালালিত্যে, বন্ধুবান্ধবের প্রিয় সম্ভাষণে, রাস্তার কোলাহলে, জগতের বিবিধ দৃশ্যে মনের তৃপ্তি সাধন করিয়া প্রাণকে শীতল করিতে পারি ৷ কিন্ত‍‍ু এখানে কঠিন নিয়মে আবদ্ধ হইয়া পরের ইচ্ছায় সৰ্ব্বসংস্রব রহিত হইয়া থাকিতে হইবে ৷ কথা আছে, যে নির্জ্জনতা সহ্য করিতে পারে, সে হয় দেবতা নয় পশু, এই সংযম মানুষের সাধ্যাতীত ৷ সেই কথায় আমি আগে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতাম না, এখন বুঝিলাম সত্য সত্যই যােগাভ্যস্ত সাধকেরও এই সংযম সহজসাধ্য নয় ৷ ইতালীর রাজহত্যাকারী ব্রেশীর ভীষণ পরিণাম মনে পড়িল ৷ তাঁহার নিষ্ঠুর

Page 30

বিচারকগণ তাঁহাকে প্রাণে না মারিয়া সপ্ত বৎসরের নির্জ্জন কারাবাসে দণ্ডিত করিয়াছিলেন ৷ এক বৎসরও অতিবাহিত না হইতেই ব্রেশী উন্মাদাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন ৷ তবে এতদিন সহ্য করিলেন ত! আমার মনের দৃঢ়তা কি এতই কম? তখন বুঝিতে পারি নাই যে ভগবান আমার সহিত খেলা করিতেছেন, ক্রীড়াচ্ছলে আমাকে কয়েকটী প্রয়ােজনীয় শিক্ষা দিতেছেন ৷ প্রথমতঃ, কিরূপ মনের গতিতে নির্জ্জন কারাবাসের কয়েদী উন্মত্ততার দিকে ধাবিত হয়, তিনি তাহা দেখাইয়া এইরূপ কারাবাসের অমানুষিক নিষ্ঠুরতা বুঝাইয়া আমাকে য়ুরােপীয় জেলপ্রণালীর ঘাের বিরােধী করিলেন, এবং যাহাতে আমার সাধ্যমত আমি দেশের লােককে ও জগৎকে এই বর্ব্বরতা হইতে ফিরাইয়া দয়ানুমােদিত জেলপ্রণালীর পক্ষপাতী করিবার চেষ্টা করি তিনি সেই শিক্ষা আমাকে দিলেন ৷ মনে পড়ে আমি পনের বৎসর আগে বিলাত হইতে দেশে আসিয়া যখন বােম্বাই হইতে প্রকাশিত ইন্দুপ্রকাশ পত্রিকায় কংগ্রেসের নিবেদন-নীতির তীব্র প্রতিবাদপূর্ণ প্রবন্ধ লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলাম, তখন স্বর্গগত মহাদেব গােবিন্দ রাণাডে যুবকদের মনে এই প্রবন্ধগুলির ফল হইতেছে দেখিয়া তাহা বন্ধ করিবার উদ্দেশ্যে আমি তাঁহার সহিত দেখা করিতে যাইবামাত্র আমাকে আধঘণ্টা পর্য্যন্ত এই কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিয়া কংগ্রেসের কোনও কার্য্যভার গ্রহণ করিতে উপদেশ দেন ৷ তিনি আমার উপর জেলপ্রণালী সংশােধনের ভার দিতে ইচ্ছুক হইয়াছিলেন ৷ রাণাডের এই অপ্রত্যাশিত উক্তিতে আমি আশ্চর্য্যান্বিত ও অসন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইয়াছিলাম, এবং সেই ভার গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিয়াছিলাম ৷ তখন জানিতাম না যে ইহা সুদূর ভবিষ্যতের পূর্ব্বাভাস মাত্র এবং একদিন স্বয়ং ভগবান আমাকে জেলে একবৎসর কাল রাখিয়া সেই প্রণালীর ক্রুরতা ও ব্যর্থতা এবং সংশােধনের প্রয়ােজনীয়তা বুঝাইবেন ৷ এক্ষণে বুঝিলাম অদ্যকার রাজনৈতিক অবস্থায় এই জেলপ্রণালীর সংশােধনের সম্ভাবনা নাই, তবে, স্ব-অধিকার প্রাপ্ত ভারতে যাহাতে বিদেশী সভ্যতার এই নারকীয় অংশ গৃহীত না হয়, তাহা প্রচার করিতে ও তৎসম্বন্ধে যুক্তি দেখাইতে জেলে বসিয়া আমার অন্তরাত্মার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম ৷ ভগবানের দ্বিতীয় অভিসন্ধি বুঝিলাম, আমার মনের এই দুর্ব্বলতা মনের সম্মুখে তুলিয়া তাহা চিরকালের জন্য বিনাশ করা ৷ যে যােগাবস্থাপ্রার্থী তাহার পক্ষে জনতা ও নির্জ্জনতা সমান হওয়া উচিত ৷ বাস্তবিক অতি অল্পদিনের মধ্যে এই দুর্ব্বলতা ঘুচিয়া গেল, এখন বােধ হয় দশ বৎসর একাকী থাকিলেও মন টলিবে না ৷ মঙ্গলময় অমঙ্গল দ্বারাও পরম মঙ্গল ঘটান ৷ তৃতীয় অভিসন্ধি, আমাকে এই শিক্ষা দেওয়া যে

Page 31

আমার যােগাভ্যাস স্বচেষ্টায় কিছু হইবে না, শ্রদ্ধা ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই সিদ্ধিলাভের পন্থা, ভগবান স্বয়ং প্রসন্ন হইয়া যে শক্তি সিদ্ধি বা আনন্দ দিবেন, তাহাই গ্রহণ করিয়া তাঁহার কাৰ্য্যে লাগান আমার যােগলিপ্সার একমাত্র উদ্দেশ্য ৷ যেদিন হইতে অজ্ঞানের প্রগাঢ় অন্ধকার লঘীভূত হইতে লাগিল, সেদিন হইতে আমি জগতের ঘটনাসকল নিরীক্ষণ করিতে করিতে মঙ্গলময় শ্রীহরির আশ্চর্য্য অনন্ত মঙ্গল স্বরূপত্ব উপলব্ধি করিতেছি ৷ এমন ঘটনা নাই, – সেই ঘটনা মহান্ হৌক বা ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতম হৌক, – যাহার দ্বারা কোনও মঙ্গল সম্পাদিত হয় না ৷ প্রায়ই তিনি এক কাৰ্য্য দ্বারা দুই চারি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেন ৷ আমরা জগতে অনেকবার অন্ধশক্তির খেলা দেখি, অপব্যয়ই প্রকৃতির নিয়ম বলিয়া ভগবানের সৰ্ব্বজ্ঞতাকে অস্বীকার করিয়া ঐশ্বরিক বুদ্ধির দোষ দিই ৷ সে অভিযােগ অমূলক ৷ ঐশী শক্তি কখনও অন্ধ ভাবে কাৰ্য্য করেন না, তাঁহার শক্তির বিন্দুমাত্র অপব্যয় হইতে পারে না, বরং তিনি এমন সংযত ভাবে অল্প ব্যয়ে বহু ফল উৎপাদন করেন যে তাহা মানুষের কল্পনার অতীত ৷

এইরূপ ভাবে মনের নিশ্চেষ্টতায় পীড়িত হইয়া কয়েক দিন কষ্টে কালযাপন করিলাম ৷ একদিন অপরাহ্নে আমি চিন্তা করিতেছিলাম, চিন্তা আসিতেই লাগিল, হঠাৎ সেই চিন্তা সকল এমন অসংযত ও অসংলগ্ন হইতে লাগিল যে বুঝিতে পারিলাম চিন্তার উপর বুদ্ধির নিগ্রহশক্তি লুপ্ত হইতে চলিল ৷ তাহার পরে যখন প্রকৃতিস্থ হইলাম, তখন মনে পড়িল যে বুদ্ধির নিগ্রহশক্তি লুপ্ত হইলেও বুদ্ধি স্বয়ং লুপ্ত বা এক মুহূর্ত্তও ভ্রষ্ট হয় নাই, বরং শান্তভাবে মনের এই অপূৰ্ব্ব ক্রিয়া যেন নিরীক্ষণ করিতেছিল ৷ কিন্ত‍‍ু তখন আমি উন্মত্ততা-ভয়ে ত্রস্ত হইয়া ইহা লক্ষ্য করিতে পারি নাই ৷ প্রাণপণে ভগবানকে ডাকিলাম, আমার বুদ্ধিভ্রংশ নিবারণ করিতে বলিলাম ৷ সেই মুহূর্ত্তে আমার সমস্ত অন্তঃকরণে হঠাৎ এমন শান্তি প্রসারিত হইল, সমস্ত শরীরময় এমন শীতলতা ব্যাপ্ত হইতে লাগিল, উত্তপ্ত মন এমন স্নিগ্ধ, প্রসন্ন ও পরম সুখী হইল যে পূর্ব্বে এই জীবনে এমন সুখময় অবস্থা অনুভব করিতে পারি নাই ৷ শিশু মাতৃক্রোড়ে যেমন আশ্বস্ত ও নির্ভীক হইয়া শুইয়া থাকে আমিও যেন বিশ্বজননীর ক্রোড়ে সেইরূপ শুইয়া রহিলাম ৷ এই দিনেই আমার কারাবাসের কষ্ট ঘুচিয়া গেল ৷ ইহার পরে কয়েকবার বদ্ধাবস্থার অশান্তি, নির্জ্জন কারাবাস ও কর্ম্মহীনতায় মনের অসােয়াস্তি, শারীরিক ক্লেশ বা ব্যাধি, যােগান্তর্গত কাতর অবস্থা ঘটিয়াছে, কিন্ত‍‍ু সে দিনে ভগবান এক মুহূর্ত্তে অন্তরাত্মায় এমন শক্তি দিলেন যে এই সকল দুঃখ মনে আসিয়া ও মন হইতে

Page 32

চলিয়া যাইবার পরে কোন দাগ বা চিহ্ন রাখিতে পারিত না, দুঃখের মধ্যেই বল ও আনন্দ উপভােগ করিয়া বুদ্ধি মনের দুঃখকে প্রত্যাখ্যান করিতে সক্ষম হইত ৷ সেই দুঃখ পদ্মপত্রে জলবিন্দুবৎ বােধ হইত ৷ তাহার পরে যখন পুস্তক আসিল, তখন তাহার প্রয়ােজনীয়তা অনেক কমিয়া গিয়াছিল ৷ বই না আসিলেও আমি থাকিতে পারিতাম ৷ যদিও আমার আন্তরিক জীবনের ইতিহাস লেখা এই প্রবন্ধগুলির উদ্দেশ্য নয়, তথাপি এই ঘটনা উল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না ৷ পরে দীর্ঘকাল নির্জ্জন কারাবাসে কেমন করিয়া আনন্দে থাকা সম্ভব হইল, তাহা এই ঘটনা হইতেই বােঝা যাইবে ৷ এই কারণেই ভগবান সেই অবস্থা ঘটাইয়াছিলেন ৷ তিনি উন্মত্ততা না ঘটাইয়া নির্জ্জন কারাবাসে উন্মত্ততার ক্রমবিকাশের প্রণালী আমার মনের মধ্যে অভিনয় করাইয়া বুদ্ধিকে সেই নাটকের অবিচলিত দর্শকরূপে বসাইয়া রাখিলেন ৷ তাহাতে আমি শক্তি পাইলাম, মানুষের নিষ্ঠুরতায় অত্যাচার-পীড়িত ব্যক্তিদের উপর দয়া ও সহানুভূতি বাড়িল এবং প্রার্থনার অসাধারণ শক্তি ও সফলতা হৃদয়ঙ্গম করিলাম ৷

আমার নির্জ্জন কারাবাসের সময় ডাক্তার ডেলি ও সহকারী সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব প্রায় রােজ আমার ঘরে আসিয়া দুই চারিটী গল্প করিয়া যাইতেন ৷ জানি না কেন, আমি প্রথম হইতে তাঁহাদের বিশেষ অনুগ্রহ ও সহানুভূতি লাভ করিতে পারিয়াছিলাম ৷ আমি উঁহাদের সহিত বিশেষ কোন কথা কহিতাম না, তাঁহারা যাহা জিজ্ঞাসা করিতেন, তাহার উত্তর দিতাম ৷ যে বিষয় উত্থাপন করিতেন, তাহা হয় নীরবে শুনিতাম, না হয় দু’একটী সামান্য কথা মাত্র বলিয়া ক্ষান্ত হইতাম ৷ তথাপি তাঁহারা আমার নিকট আসিতে ছাড়িতেন না ৷ একদিন ডেলি সাহেব আমাকে বলিলেন, আমি সহকারী সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে বলিয়া বড় সাহেবকে সম্মত করাইতে পারিয়াছি যে তুমি প্রত্যহ সকালে ও বিকালে ডিক্রীর সামনে বেড়াইতে পারিবে ৷ তুমি যে সমস্ত দিন এক ক্ষুদ্র কুঠরীতে আবদ্ধ হইয়া থাকিবে, ইহা আমার ভাল লাগে না, ইহাতে মন খারাপ হয় এবং শরীরও খারাপ হয় ৷ সেই দিন হইতে আমি সকালে বিকালে ডিক্রীর সম্মুখে খােলা জায়গায় বেড়াইতাম ৷ বিকালে দশ মিনিট, পনর মিনিট, কুড়ি মিনিট, বেড়াইতাম, কিন্ত‍‍ু সকালে এক ঘণ্টা, এক একদিন দুই ঘণ্টা পর্য্যন্ত বাহিরে থাকিতাম, সময়ের কোনও নিয়ম ছিল না ৷ এই সময় বড় ভাল লাগিত ৷ একদিকে জেলের কারখানা, অপরদিকে গােয়ালঘর – আমার স্বাধীন রাজ্যের এই দুই সীমা ছিল ৷ কারখানা হইতে

Page 33

গােয়ালঘর, গােয়ালঘর হইতে কারখানা, ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে করিতে হয় উপনিষদের গভীর ভাবােদ্দীপক অক্ষয় শক্তিদায়ক মন্ত্র সকল আবৃত্তি করিতাম, না হয় কয়েদীদের কাৰ্য্যকলাপ ও যাতায়াত লক্ষ্য করিয়া সৰ্ব্বঘটে নারায়ণ এই মূল সত্য উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতাম ৷ বৃক্ষে, গৃহে, প্রাচীরে, মনুষ্যে, পশুতে, পক্ষীতে, ধাতুতে, মৃত্তিকায় সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম মনে মনে এই মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক সৰ্ব্বভূতে সেই উপলব্ধি আরােপ করিতাম ৷ এইরূপ করিতে করিতে এমন ভাব হইয়া যাইত যে, কারাগার আর কারাগারই বােধ হইত না ৷ সেই উচ্চ প্রাচীর, সেই লােহার গরাদ, সেই সাদা দেওয়াল, সেই সূৰ্য্যরশ্মিদীপ্ত নীলপত্রশােভিত বৃক্ষ, সেই সামান্য জিনিসপত্র যেন আর অচেতন নহে, যেন সর্ব্বব্যাপী চৈতন্যপূর্ণ হইয়া সজীব হইয়াছে, তাহারা আমাকে ভালবাসে, আমাকে আলিঙ্গন করিতে চায় এইরূপ বােধ হইত ৷ মনুষ্য, গাভী, পিপীলিকা, বিহঙ্গ চলিতেছে, উড়িতেছে, গাহিতেছে, কথা বলিতেছে, অথচ সবই প্রকৃতির ক্রীড়া; ভিতরে এক মহান্ নিৰ্ম্মল নির্লিপ্ত আত্মা শান্তিময় আনন্দে নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছেন ৷ এক একবার এমন বােধ হইত যেন ভগবান্ সেই বৃক্ষতলে আনন্দের বংশী বাজাইতে দাঁড়াইয়াছেন; এবং সেই মাধুর্য্যে আমার হৃদয় টানিয়া বাহির করিতেছেন ৷ সর্ব্বদা বােধ হইতে লাগিল, যেন কে আমাকে আলিঙ্গন করিতেছে, কে আমাকে কোলে করিয়া রহিয়াছে ৷ এই ভাববিকাশে আমার সমস্ত মনপ্রাণ অধিকার করিয়া কি এক নিৰ্ম্মল মহতী শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল, তাহার বর্ণনা করা যায় না ৷ প্রাণের কঠিন আবরণ খুলিয়া গেল এবং সর্ব্বজীবের উপর প্রেমের স্রোত বহিতে লাগিল ৷ প্রেমের সহিত দয়া, করুণা, অহিংসা ইত্যাদি সাত্ত্বিক ভাব আমার রজঃপ্রধান স্বভাবকে অভিভূত করিয়া বিশেষ বিকাশ লাভ করিতে লাগিল ৷ আর যতই বিকাশ পাইতে লাগিল, ততই আনন্দ বৃদ্ধি হইল এবং নির্ম্মল শান্তিভাব গভীর হইল ৷ মােকদ্দমার দুশ্চিন্তা প্রথম হইতে দূর হইয়া গিয়াছিল, এখন বিপরীত ভাব মনে স্থান পাইল ৷ ভগবান মঙ্গলময়, আমার মঙ্গলের জন্যই আমাকে কারাগৃহে আনিয়াছেন, নিশ্চয় কারামুক্তি ও অভিযােগখণ্ডন হইবে, এই দৃঢ় বিশ্বাস হইয়া গেল ৷ ইহার পরে অনেক দিন আমার জেলের কোনও কষ্টভােগ করিতে হয় নাই ৷

এই অবস্থা ঘনীভূত হইতে কয়েকদিন লাগিল, তাহারই মধ্যে ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে মােকদ্দমা আরম্ভ হয় ৷ নির্জ্জন কারাবাসের নীরবতা হইতে হঠাৎ বহির্জ্জগতের কোলাহলের মধ্যে আনীত হইয়া প্রথম মন বড় বিচলিত হইল,

Page 34

সাধনার স্থৈর্য্যভঙ্গ হইল এবং সেই পাঁচ ঘণ্টাকাল মােকদ্দমার নীরস ও বিরক্তিকর কথা শুনিতে মন কিছুতে সম্মত হইল না ৷ প্রথম আদালতে বসিয়া সাধনা করিতে চেষ্টা করিতাম, কিন্ত‍‍ু অনভ্যস্ত মন প্রত্যেক শব্দ ও দৃশ্যের দিকে আকৃষ্ট হইত, গােলের মধ্যে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হইত, পরে ভাবের পরিবর্ত্তন হয়, এবং সমীপবর্ত্তী শব্দ দৃশ্য মনের বহির্ভূত করিয়া সমস্ত চিন্তাশক্তি অন্তর্মুখী করিবার শক্তি জন্মাইয়াছিল, কিন্ত‍‍ু মােকদ্দমার প্রথম অবস্থায় তাহা ঘটে নাই, তখন ধ্যানধারণার প্রকৃত ক্ষমতা ছিল না ৷ সেই কারণে এই বৃথা চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া মধ্যে মধ্যে সৰ্ব্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করিয়া সন্ত‍‍ু‍ষ্ট থাকিতাম, অবশিষ্ট সময় বিপদকালের সঙ্গীদের কথা ও তাহাদের কাৰ্য্যকলাপ লক্ষ্য করিতাম, অন্য চিন্তা করিতাম, অথবা কখনও নর্টন সাহেবের শ্রবণযােগ্য কথা বা সাক্ষীর সাক্ষ্যও শুনিতাম ৷ দেখিলাম নির্জ্জন কারাগৃহে যেমন সময় কাটান সহজ ও সুখকর হইয়া উঠিয়াছে, জনতার মধ্যে এবং সেই গুরুতর মােকদ্দমার জীবনমরণের খেলার মধ্যে সময় কাটান তেমন সহজ নয় ৷ অভিযুক্ত বালকদের হাসি তামাসা ও আমােদ প্রমােদ শুনিতে ও দেখিতে বড় ভাল লাগিত, নচেৎ আদালতের সময় কেবলই বিরক্তিকর বােধ হইত ৷ সাড়ে চারটা বাজিলে সানন্দে কয়েদীদের গাড়ীতে উঠিয়া জেলে ফিরিয়া যাইতাম ৷

পনের ষােল দিনের বন্দী অবস্থার পরে স্বাধীন মনুষ্য-জীবনের সংসর্গ ও পরস্পরের মুখ দর্শনে অন্যান্য কয়েদীদের অতিশয় আনন্দ হইয়াছিল ৷ গাড়ীতে উঠিয়াই তাহাদের হাসি ও কথার ফোয়ারা খুলিয়া যাইত এবং যে দশ মিনিটকাল তাহাদিগকে গাড়ীতে থাকিতে হইত, তাহার এক মুহূর্ত্তও সেই স্রোত থামিত না ৷ প্রথম দিন আমাদের খুব সম্মানের সহিত আদালতে লইয়া যায় ৷ আমাদের সঙ্গেই য়ুরােপীয়ান সার্জ্জেণ্টের ক্ষুদ্র পল্টন এবং তাহাদের নিকট আবার গুলিভরা পিস্তল ছিল ৷ গাড়ীতে উঠিবার সময় একদল সশস্ত্র পুলিস আমাদিগকে ঘিরিয়া থাকিত এবং গাড়ীর পশ্চাতে কুচকাওয়াজ করিত, নামিবার সময়ও তদ্রূপ আয়ােজন ছিল ৷ এই সাজসজ্জা দেখিয়া কোন কোন অনভিজ্ঞ দর্শক নিশ্চয় ভাবিয়াছিলেন যে, এই হাস্যপ্রিয় অল্পবয়স্ক বালকগণ না জানি কি দুঃসাহসিক বিখ্যাত মহাযােদ্ধার দল ৷ না জানি তাহাদের প্রাণে ও শরীরে কত সাহস ও বল যে খালি হাতে শত পুলিস ও গােরার দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করিয়া পলায়ন করিতেও সক্ষম ৷ সেইজন্য বােধ হয় অতি সম্মানের সহিত তাহাদিগকে এইরূপে লইয়া গেল ৷ কয়েক দিন এইরূপ ঠাট চলিল, তাহার পর ক্রমে ক্রমে তাহা কমিতে লাগিল, শেষে দুই

Page 35

চারিজন সার্জ্জেণ্ট আমাদের লইয়া যাইত ও লইয়া আসিত ৷ নামিবার সময় তাহারা বড় দেখিত না, আমরা কি ভাবে জেলে ঢুকি; আমরা যেন স্বাধীন ভাবে বেড়াইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিতেছি, সেইরূপে জেলে ঢুকিতাম ৷ এইরূপ অযত্ন ও শিথিলতা দেখিয়া পুলিস কমিশনার সাহেব ও কয়েকজন সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট চটিয়া উঠিয়া বলিয়াছিলেন, “প্রথম দিন পঁচিশ ত্রিশজন সার্জ্জেণ্টের ব্যবস্থা করিয়াছিলাম, আজকাল দেখিতেছি, চার পাঁচজনও আসে না ৷” তাঁহারা সার্জ্জেণ্টদের তিরস্কার করিতেন এবং রক্ষণাবেক্ষণের কঠোর ব্যবস্থা করিতেন, তাহার পর দুদিন হয় ত আর দুইজন সার্জ্জেণ্ট আসিত, তাহার পর পূর্ব্বেকার শিথিলতা আবার আরম্ভ হইত ৷ সার্জ্জেণ্টগণ দেখিলেন যে, এই বােমার ভক্তগণ বড় নিরীহ ও শান্ত লােক, তাহাদের পলায়নের কোন উদ্যোগ নাই, কাহাকেও আক্রমণ করিবার, হত্যা করিবার মৎলবও নাই, তাঁহারা ভাবিলেন আমরা কেন অমূল্য সময় এই বিরক্তিকর কাৰ্য্যে নষ্ট করি ৷ প্রথমে আদালতে ঢুকিবার ও বাহির হইবার সময় আমাদিগকে তল্লাস করিত, তাহাতে সার্জ্জেণ্টদের কোমল করস্পর্শসুখ অনুভব করিতাম, ইহা ভিন্ন এই তল্লাসে কাহারও লাভ বা ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না ৷ বেশ বােঝা গেল যে, এই তল্লাসের প্রয়ােজনীয়তায় আমাদের রক্ষকদের গভীর অনাস্থা ছিল ৷ দুই চারিদিন পরে ইহাও বন্ধ হইল ৷ আমরা নির্ব্বিঘ্নে বই, রুটী, চিনি যাহা ইচ্ছা আদালতের ভিতরে লইয়া যাইতাম ৷ প্রথম লুকাইয়া, তাহার পরে প্রকাশ্য ভাবে লইয়া যাইতাম ৷ আমরা বােমা বা পিস্তল ছুঁড়িতে যাইব না, সেই বিশ্বাস তাঁহাদের শীঘ্র দূর হইল ৷ কিন্ত‍‍ু দেখিলাম একমাত্র ভয় সার্জ্জেণ্টদের মন হইতে বিদূরিত হয় নাই ৷ কে জানে কাহার মনে কবে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের মহিমান্বিত মস্তকে পাদুকা নিক্ষেপ করিবার বদ মৎলব ঢুকিবে, তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ ৷ সেই জন্য জুতা লইয়া ভিতরে যাইবার সবিশেষ নিষেধ ছিল এবং সেই বিষয়ে সার্জ্জেণ্টগণ সৰ্ব্বদা সতর্ক ছিলেন ৷ আর কোনরূপ সাবধানতার প্রতি তাঁহাদের লক্ষ্য দেখি নাই ৷

মােকদ্দমার স্বরূপ একটু বিচিত্র ছিল ৷ ম্যাজিষ্ট্রেট, কৌন্সিলী , সাক্ষী, সাক্ষ্য, Exihibits, আসামী, সকলই বিচিত্র ৷ দিন দিন সেই সাক্ষী ও Exihibits-এর অবিরাম স্রোত, সেই কৌন্সিলীর নাটকোচিত অভিনয়, সেই বালকস্বভাব ম্যাজিষ্ট্রেটের বালকোচিত চপলতা ও লঘুতা, সেই অপূৰ্ব্ব আসামীদের অপূৰ্ব্বভাব দেখিতে দেখিতে অনেকবার এই কল্পনা মনে উদয় হইত যে আমরা বৃটিশ বিচারালয়ে

Page 36

না বসিয়া কোন নাটগৃহের রঙ্গমঞ্চে বা কোন কল্পনাপূর্ণ ঔপন্যাসিক রাজ্যে বসিয়া আছি ৷ এক্ষণে সেই রাজ্যের বিচিত্র জীবসকলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করিতেছি ৷

এই নাটকের প্রধান অভিনেতা সরকার বাহাদুরের কৌন্সিলী নর্টন সাহেব ছিলেন ৷ তিনি প্রধান অভিনেতা কেন, এই নাটকের রচয়িতা, সূত্রধর (stage manager) এবং সাক্ষীর স্মারক (prompter) ছিলেন, —এমন বৈচিত্র্যময় প্রতিভা জগতে বিরল ৷ কৌন্সিলী নর্টন মাদ্রাজী সাহেব, সেইজন্য বােধ হয় বঙ্গদেশীয় ব্যারিষ্টার মণ্ডলীর প্রচলিত নীতি ও ভদ্রতায় অনভ্যস্ত ও অনভিজ্ঞ ৷ তিনি এক সময় জাতীয় মহাসভার একজন নেতা ছিলেন, সেইজন্য বােধ হয় বিরুদ্ধাচরণ ও প্রতিবাদ সহ্য করিতে অক্ষম এবং বিরুদ্ধাচারীকে শাসন করিতে অভ্যস্ত ৷ এইরূপ প্রকৃতিকে লােকে সিংহস্বভাব বলে ৷ নর্টন সাহেব কখন মাদ্রাজ কর্পোরেশনের সিংহ ছিলেন কি না, বলিতে পারি না, তবে আলিপুর কোর্টের সিংহ ছিলেন বটে ৷ তাঁহার আইন-অভিজ্ঞতার গভীরতায় মুগ্ধ হওয়া কঠিন – সে যেন গ্রীষ্মকালের শীত ৷ কিন্ত‍‍ু বক্তৃতার অনর্গল স্রোতে, কথার পারিপাট্যে, কথার চোটে লঘু সাক্ষ্যকে গুরু করার অদ্ভুত ক্ষমতায়, অমূলক বা অল্পমূলক উক্তির দুঃসাহসিকতায়, সাক্ষী ও জুনিয়ার ব্যারিষ্টারের উপর তম্বীতে এবং সাদাকে কালাে করিবার মনােমােহিনী শক্তিতে নর্টন সাহেবের অতুলনীয় প্রতিভা দেখিলেই মুগ্ধ হইতে হইত ৷ শ্রেষ্ঠ কৌন্সিলীর মধ্যে তিন শ্রেণী আছে, – যাঁহারা আইন-পাণ্ডিত্যে এবং যথার্থ ব্যাখ্যায় ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে জজের মনে প্রতীতি জন্মাইতে পারেন, যাঁহারা চতুর ভাবে সাক্ষীর নিকট সত্য কথা বাহির করিয়া ও মােকদ্দমার বিষয়ীভূত ঘটনা ও বিবেচ্য বিষয় দক্ষতার সহিত প্রদর্শন করিয়া জজ বা জুরির মন নিজের দিকে আকর্ষণ করিতে পারেন এবং যাঁহারা কথার জোরে, বিভীষিকা প্রদর্শনে, বক্তৃতার স্রোতে সাক্ষীকে হতবুদ্ধি করিয়া, মােকদ্দমার বিষয়ের দিব্য গােলমাল করিয়া, গলার জোরে জজ বা জুরির বুদ্ধি স্থানচ্যুত করিয়া মােকদ্দমায় জিতিতে পারেন ৷ নর্টন সাহেব তৃতীয় শ্রেণীর মধ্যে অগ্রগণ্য ৷ ইহা দোষের কথা নহে ৷ কৌন্সিলী ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা নেন, যে টাকা দেয় তাহার অভীপ্সিত ৷ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা তাঁহার কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম ৷ এখন বৃটিশ আইন প্রণালী দ্বারা সত্য কথা বাহির করা বাদী প্রতিবাদীর আসল উদ্দেশ্য নহে, কোনও উপায়ে মােকদ্দমায় জয় লাভ করাই উদ্দেশ্য ৷ অতএব কৌন্সিলী সেই চেষ্টা করিবেন, নচেৎ তাঁহাকে ধৰ্ম্মচ্যুত হইতে হয় ৷ ভগবান অন্য গুণ না দিয়া থাকিলে যে গুণ আছে, তাহার জোরেই মােকদ্দমায় জিতিতে হইবে, সুতরাং নর্টন সাহেব স্বধর্ম্ম পালনই

Page 37

করিতেছিলেন ৷ সরকার বাহাদুর তাঁহাকে রােজ হাজার টাকা দিতেন ৷ এই অর্থব্যয় বৃথা হইলে সরকার বাহাদুরের ক্ষতি হয়, সে ক্ষতি যাহাতে না হয় নর্টন সাহেব প্রাণপণে সেই চেষ্টা করিয়াছেন ৷ তবে যে মােকদ্দমা রাজনীতি সংক্রান্ত, তাহাতে বিশেষ উদার ভাবে আসামীকে সুবিধা দেওয়া এবং সন্দেহজনক বা অনিশ্চিত প্রমাণের উপর জোর না করা বৃটিশ আইন পদ্ধতির নিয়ম ৷ নর্টন সাহেব যদি এই নিয়ম সৰ্ব্বদা স্মরণ করিতেন তবে আমার বােধ হয় না যে তাঁহার কেসের কোন হানি হইত ৷ অপর দিকে কয়েকজন নির্দ্দোষী লােককে নির্জ্জন কারাবাসের যন্ত্রণা ভােগ করিতে হইত না এবং নিরীহ অশােক নন্দী প্রাণে বাঁচিতেও পারিতেন ৷ কৌন্সিলী সাহেবের সিংহপ্রকৃতি বােধ হয় এই দোষের মূল ৷ হলিংশেদ হল ও প্‍ল‍ুটার্ক যেমন সেক‍্‍সপিয়রের জন্য ঐতিহাসিক নাটকের উপাদান সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, পুলিস তেমনি এই মােকদ্দমা নাটকের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিল ৷ আমাদের নাটকের সেক‍্‍সপিয়র ছিলেন, নর্টন সাহেব ৷ তবে সেক‍্‍সপিয়রে নর্টনে এক প্রভেদ দেখিয়াছিলাম ৷ সেক‍্‍সপিয়র সংগৃহীত উপাদানের কয়েক অংশ মাঝে মাঝে ছাড়িয়াও দিলে, নর্টন সাহেব ভাল মন্দ সত্য মিথ্যা সংলগ্ন অসংলগ্ন অণােঃ অণীয়ান্, মহতাে মহীয়ান যাহা পাইতেন একটীও ছাড়েন নাই, তাহার উপর স্বয়ং কল্পনাসৃষ্ট প্রচুর suggestion, inference, hypothesis যােগাড় করিয়া এমন সুন্দর plot রচনা করিয়াছিলেন যে সেক‍্‍সপিয়র, ডেফো ইত্যাদি সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ কবি ও উপন্যাস লেখক এই মহাপ্রভুর নিকট পরাজিত হইলেন ৷ নিন্দুক বলিতে পারেন যে যেমন ফলষ্টাফের হােটেলের হিসাবে এক আনা খাদ্য ও অসংখ্য গ্যালন মদ্যের সমাবেশ ছিল, তেমনই নর্টনের plot-এ এক রতি প্রমাণের সঙ্গে দশমন অনুমান ও suggestion ছিল ৷ কিন্ত‍‍ু নিন্দুকও plot-এর পারিপাট্য ও রচনাকৌশল প্রশংসা করিতে বাধ্য ৷ নর্টন সাহেব এই নাটকের নায়করূপে আমাকেই পছন্দ করিয়াছিলেন দেখিয়া আমি সমধিক প্রীতিলাভ করিয়াছিলাম ৷ যেমন মিল্টনের Paradise Lost-এর সয়তান, আমিও তেমনি নর্টন সাহেবের plot-এর কল্পনাপ্রসূত মহাবিদ্রোহের কেন্দ্রস্বরূপ অসাধারণ তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ক্ষমতাবান ও প্রতাপশালী bold bad man ৷ আমিই জাতীয় আন্দোলনের আদি ও অন্ত, স্রষ্টা, পাতা ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের সংহারপ্রয়াসী ৷ উৎকৃষ্ট ও তেজস্বী ইংরাজী লেখা দেখিবামাত্র নর্টন লাফাইয়া উঠিতেন ও উচ্চৈঃস্বরে বলিতেন, অরবিন্দ ঘােষ ৷ আন্দোলনের বৈধ অবৈধ যত সুশৃঙ্খলিত অঙ্গ বা অপ্রত্যাশিত ফল সকলই অরবিন্দ ঘােষের সৃষ্টি, এবং যখন অরবিন্দের সৃষ্টি

Page 38

তখন বৈধ হইলেও নিশ্চয় অবৈধ অভিসন্ধি গুপ্তভাবে তাহার মধ্যে নিহিত ৷ তাঁহার বােধ হয় বিশ্বাস ছিল যে আমি ধরা না পড়িলে বােধ হয় দুই বৎসরের মধ্যে ইংরাজের ভারত সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হইত ৷ আমার নাম কোনও ছেঁড়া কাগজের টুকরায় পাইলে নর্টন মহা খুসি হইলে, এবং সাদরে এই পরম মূল্যবান প্রমাণ ম্যাজিষ্ট্রেটের শ্রীচরণে অৰ্পণ করিতেন ৷ দুঃখের কথা, আমি অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করি নাই, নচেৎ আমার প্রতি সেই সময়ের এত ভক্তি ও অনবরত আমার ধ্যানে নর্টন সাহেব নিশ্চয় তখনই মুক্তিলাভ করিতেন, তাহা হইলে আমাদের কারাবাসের সময় ও গবর্ণমেন্টের অর্থব্যয় উভয়ই সঙ্কুচিত হইত ৷ সেশন‍্‍স্ আদালতে আমি নির্দ্দোষী প্রমাণিত হওয়ায় নর্টন কৃত plot-এর শ্রী ও গৌরব বিনষ্ট হয় ৷ বেরসিক বীচক্রফ‍্‍ট হ্যামলেট নাটক হইতে হ্যামলেটকে বাদ দিয়া বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কাব্যকে হতশ্রী করিয়া গেলেন ৷ সমালােচককে যদি কাব্য পরিবর্ত্তন করিবার অধিকার দেওয়া হয়, তাহা হইলে এরূপ দুর্দ্দশা হইবে না কেন? নর্টন সাহেবের আর এক দুঃখ ছিল যে, কয়েক জন সাক্ষীও এইরূপ বেরসিক ছিল যে, তাঁহার রচিত plot-এর অনুযায়ী সাক্ষ্য দিতে তাহারা সম্পূর্ণ অসম্মত হইয়াছিল ৷ নর্টন সাহেব ইহাতে চটিয়া লাল হইতেন, সিংহ গর্জ্জনে সাক্ষীর প্রাণ বিকম্পিত করিয়া তাহাকে শাসাইয়া দিতেন ৷ স্বরচিত কথার অন্যথা প্রকাশে কবির এবং স্বদত্ত শিক্ষাবিরুদ্ধে অভিনেতার আবৃত্তি, স্বর বা অঙ্গভঙ্গীতে নাটকের সূত্রধরের যে ন্যায়সঙ্গত ও অদমনীয় ক্রোধ হয়, নর্টন সাহেবের সেই ক্রোধ হইত ৷ ব্যারিষ্টার ভুবন চাটার্জ্জীর সহিত তাঁহার যে সংঘর্ষ হইয়াছিল, এই সাত্ত্বিক ক্রোধই তাহার কারণ ৷ চাটার্জ্জী মহাশয়ের ন্যায় এরূপ রসানভিজ্ঞ লােক ত দেখি নাই ৷ তাঁহার সময় অসময় জ্ঞান আদবে ছিল না ৷ নর্টন সাহেব যখন সংলগ্ন অসংলগ্নের বিচারকে জলাঞ্জলি দিয়া কেবল কবিত্বের খাতিরে যে সে প্রমাণ ঢুকাইয়া দিতেছিলেন, তখন চাটার্জ্জী মহাশয় উঠিয়া অসংলগ্ন বা inadmissible বলিয়া আপত্তি করিতেন ৷ তিনি বুঝিতে পারেন নাই যে সংলগ্ন বা আইনসঙ্গত প্রমাণ বলিয়া নয়, নর্টন কৃত নাটকের উপযােগী হইতে পারে বলিয়া সেই সাক্ষ্যগুলি রুজু হইতেছে ৷ এই অসঙ্গত ব্যবহারে নর্টন কেন, বার্লি সাহেব পৰ্য্যন্ত চটিয়া উঠিতেন ৷ একবার বার্লি সাহেব চাটার্জ্জী মহাশয়কে করুণ স্বরে বলিয়াছিলেন, “Mr. Chatterji, we were getting on very nicely before you came” (আপনি যখন আসেন নাই, আমরা নির্ব্বিঘ্নে মােকদ্দমা চালাইতেছিলাম) ৷ তাহা বটে, নাটকের রচনার সময়ে কথায় কথায় আপত্তি তুলিলে নাটকও অগ্রসর হয় না, দর্শকবৃন্দেরও রসভঙ্গ হয় ৷

Page 39

নর্টন সাহেব যদি নাটকের রচয়িতা, প্রধান অভিনেতা ও সূত্রধর হন, ম্যাজিষ্ট্রেট বার্লিকে নাটককারের পৃষ্ঠপােষক বা patron বলিয়া অভিহিত করা যায় ৷ বার্লি সাহেব বােধ হয়, স্কচ জাতির গৌরব ৷ তাঁহার চেহারা স্কটলণ্ডের স্মারকচিহ্ন ৷ অতি সাদা, অতি লম্বা, অতি রােগা, দীর্ঘ দেহযষ্টির উপর ক্ষুদ্র মস্তক দেখিয়া মনে হইত যেন অভ্রভেদী অক‍্টারলােনী মনুমেন্টের উপর ক্ষুদ্র অক‍্টারলােনী বসিয়া আছেন, বা ক্লিয়পাত্রার obelisk-এর চূড়ায় একটী পাকা নারিকেল বসান রহিয়াছে ৷ তাঁহার চুল ধূলার বর্ণ (sandy haired) এবং স্কটলণ্ডের সমস্ত হিম ও বরফ তাঁহার মুখের ভাবে জমিয়া রহিয়াছে ৷ যাঁহার এত দীর্ঘ দেহ, তাঁহার বুদ্ধিও তদ্রপ হওয়া চাই ৷ নচেৎ প্রকৃতির মিতব্যয়িতা সম্বন্ধে সন্দেহের উদ্রেক হয় ৷ কিন্ত‍‍ু এই বিষয়ে বার্লি-সৃষ্টির সময়ে প্রকৃতি দেবী বােধ হয় একটু অমনােযােগী ও অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন ৷ ইংরাজ কবি মারলাে এই মিতব্যয়িতা infinite riches in a little room (ক্ষুদ্র ভাণ্ডারে অসীম ধন) বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, কিন্ত‍‍ু বার্লি দর্শনে কবির বর্ণনার বিপরীত ভাব মনে উদয় হয়, infinite room-A little riches ৷বাস্তবিক এই দীর্ঘ দেহে এত অল্প বিদ্যাবুদ্ধি দেখিয়া দুঃখ হইত এবং এই ধরণের অল্পসংখ্যক শাসনকর্ত্তা দ্বারা ত্রিশ কোটী ভারতবাসী শাসিত হইয়া রহিয়াছে স্মরণ করিয়া ইংরাজের মহিমা ও ব্রিটিশ শাসনপ্রণালীর উপর প্রগাঢ় ভক্তির উদয় হইত ৷ বার্লি সাহেবের বিদ্যা শ্রীযুক্ত ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তীর জেরার সময় প্রকাশ হইয়াছিল ৷ স্বয়ং কবে মােকদ্দমা স্বীয় করকমলে গ্রহণ করিয়াছিলেন বা কি করিয়া মােকদ্দমা গ্রহণ সম্পন্ন হয়, এত বৎসরের ম্যাজিষ্ট্রেটগিরির পরে তাহা নির্ণয় করিতে গিয়া বার্লির মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল, সেই সমস্যার মীমাংসায় অসমর্থ হইয়া চক্রবর্ত্তী সাহেবের উপর সেই ভার দিয়া সাহেব নিষ্কৃতি পাইতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন ৷ এখনও বার্লি কবে মােকদ্দমা গ্রহণ করিলেন, এই প্রশ্ন মােকদ্দমার অতি জটিল সমস্যার মধ্যে গণ্য ৷ চাটার্জ্জী মহাশয়ের নিকট যে করুণ নিবেদনের উল্লেখ করিলাম, তাহাতেও সাহেবের বিচার প্রণালীর কতকটা অনুমান করা যায় ৷ প্রথম হইতে তিনি নর্টন সাহেবের পাণ্ডিত্যে ও বাগ্মিতায় মন্ত্র মুগ্ধবৎ হইয়া তাঁহার বশ হইয়াছিলেন ৷ এমন বিনীতভাবে নর্টনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করিতেন, নর্টনের মতে মত দিতেন, নর্টনের হাসিতে হাসিতেন, নর্টনের রাগে রাগিতেন যে, এই সরল শিশুর আচরণ দেখিয়া মাঝে মাঝে প্রবল স্নেহ ও বাৎসল্য ভাব মনে আবির্ভূত হইত ৷ বার্লি নিতান্ত বালকস্বভাব ৷ কখন তাঁহাকে ম্যাজিষ্ট্রেট বলিয়া ভাবিতে পারি নাই, বােধ হইত যেন স্কুলের ছাত্র হঠাৎ

Page 40

স্কুলের শিক্ষক হইয়া শিক্ষকের উচ্চ মঞ্চে আসীন হইয়াছেন ৷ সেই ভাবে তিনি কোর্টের কার্য্য চালাইতেন ৷ কেহ তাঁহার প্রতি অপ্রিয় ব্যবহার করিলে স্কুলের শিক্ষকের ন্যায় শাসন করিতেন ৷ আমাদের মধ্যে যদি কেহ কেহ মােকদ্দমা প্রহসনে বিরক্ত হইয়া পরস্পরে কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিতেন, বার্লি সাহেব স্কুলমাষ্টারী ধরণে বকিয়া উঠিতেন, না শুনিলে সকলকে দাঁড়াইবার হুকুম করিতেন, তাহাও তৎক্ষণাৎ না শুনিলে প্রহরীকে দাঁড় করাইতে বলিতেন ৷ আমরা এই স্কুলমাষ্টারী ধরণ প্রত্যক্ষ করিতে এত অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিলাম যে যখন বার্লিতে ও চাটার্জ্জী মহাশয়ে ঝগড়া লাগিয়া গিয়াছিল, আমরা তখন প্রতিক্ষণে এই প্রত্যাশায় ছিলাম যে ব্যারিষ্টার মহাশয়ের উপর এবার দাঁড়াইবার শাস্তি প্রচারিত হইবে ৷ বার্লি সাহেব কিন্ত‍‍ু উল্টা উপায় ধরিলেন, চীৎকার করিয়া “Sit down Mr. Chatterji বলিয়া তাঁহার আলিপুর স্কুলের এই নবাগত দুরন্ত ছাত্রকে বসাইয়া দিলেন ৷ যেমন এক একজন মাষ্টার, ছাত্র কোন প্রশ্ন করিলে বা পড়ার সময় অতিরিক্ত ব্যাখ্যা চাহিলে, বিরক্ত হইয়া তাহাকে শাসাইয়া দেন, বার্লিও আসামীর উকিল আপত্তি করিলে বিরক্ত হইয়া তাহাকে শাসাইতেন ৷ কোন কোন সাক্ষী নর্টনকে ব্যতিব্যস্ত করিত ৷ নর্টন বাহির করিতে চাহিলে যে অমুক লেখা অমুক আসামীর হস্তাক্ষর, সাক্ষী যদি বলিতেন, না, এ ত ঠিক সেই লেখার মত লেখা নয়, তবে হইতে পারে, বলা যায় না, – অনেক সাক্ষী এইরূপ উত্তর দিতেন, নর্টন ইহাতে অধীর হইতেন ৷ বকিয়া ঝকিয়া, চেঁচাইয়া শাসাইয়া কোন উপায়ে অভীপ্সিত উত্তর বাহির করিবার চেষ্টা করিতেন ৷ তাঁহার শেষ প্রশ্ন হইত, “What is your belief?” তুমি কি মনে কর, হাঁ কি না ৷ সাক্ষী হাঁ-ও বলিতে পারিতেন না, না-ও বলিতে পারিতেন না, বারবার ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই উত্তরই করিতেন ৷ নর্টনকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন যে তাঁহার কোনও belief নাই, তিনি সন্দেহে দোলায়মান ৷ কিন্ত‍‍ু নর্টন সেই উত্তর চাহিতেন না, বারবার মেঘগর্জ্জনের রবে সেই সাংঘাতিক প্রশ্নে সাক্ষীর মাথায় বজ্রাঘাত পড়িত, “Come, sir, what is your belief?” নর্টনের রাগে বার্লি রাগিয়া উপর হইতে গর্জ্জন করিতেন, “টোমার বিস্ওয়াস কি আছে?” বেচারা সাক্ষী মহা ফাঁপরে পড়িতেন ৷ তাঁহার কোন বিস্ওয়াস নাই, অথচ একদিকে ম্যাজিষ্ট্রেট, অপর দিকে নর্টন ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় তাঁহার নাড়ী ভুঁড়ি ছিঁড়িয়া সেই অমূল্য অপ্রাপ্য বিস্ওয়াস বাহির করিতে কৃতােদ্যম হইয়া দুইদিক হইতে ভীষণ গর্জ্জন করিতেছেন ৷ প্রায়ই বিস্ওয়াস বাহির হইত না, সাক্ষী ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে ঘূর্ণ্যমান বুদ্ধিতে তাঁহার যন্ত্রণাস্থান

Page 41

হইতে প্রাণ লইয়া পালাইয়া যাইতেন ৷ এক একজন বিস্ওয়াসের অপেক্ষা প্রাণই প্রিয় জিনিস বলিয়া কৃত্রিম বিস্ওয়াস নর্টন সাহেবের চরণকমলে উপহার দিয়া বাঁচিতেন, নর্টন অতি সন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইয়া বাকী জেরা স্নেহের সহিত সম্পন্ন করিতেন ৷ এইরূপ কৌন্সিলীর সঙ্গে এইরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট জুটিয়াছিলেন বলিয়া মােকদ্দমা আরও নাটকের আকার ধারণ করিয়াছিল ৷

কয়েকজন সাক্ষী এইরূপ বিরুদ্ধাচরণ করিলেও অধিকাংশই নর্টন সাহেবের প্রশ্নের অনুকূল উত্তর দিতেন ৷ ইহাদের মধ্যে চেনা মুখ অতি অল্পই ছিল ৷ এক একজন কিন্ত‍‍ু পরিচিত ছিলেন ৷ দেবদাস করণ মহাশয় আমাদের বিরক্তি দূর করিয়া খুব হাসাইয়াছিলেন, তাহার জন্য আমরা তাঁহার নিকট চিরকাল কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ ৷ এই সত্যবাদী সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়াছিলেন যে, যখন মেদিনীপুর সম্মিলনীর সময় সুরেন্দ্র বাবু তাঁহার ছাত্রের নিকটে গুরুভক্তি প্রার্থনা করিয়াছিলেন, অরবিন্দ বাবু তখন বলিয়া উঠিয়াছিলেন “দ্রোণ কি করিলেন?” ইহা শুনিয়া নর্টন সাহেবের আগ্রহ ও কৌতুহলের সীমা ছিল না, তিনি নিশ্চয় ভাবিয়াছিলেন দ্রোণ কোন বােমার ভক্ত বা রাজনৈতিক হত্যাকারী, অথবা মানিকলা বাগান বা ছাত্র ভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত ৷ নর্টন মনে করিয়াছিলেন এই বাক্যের অর্থ বােধ হয় যে অরবিন্দ ঘােষ সুরেন্দ্র বাবুকে গুরুভক্তির বদলে বােমারূপ পুরস্কার দিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন, তাহা হইলে মােকদ্দমার অনেক সুবিধা হইতে পারে ৷ অতএব তিনি আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “দ্রোণ কি করিলেন?” প্রথমতঃ সাক্ষী কিছুতেই প্রশ্নের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারেন নাই ৷ তাহা লইয়া পাঁচ মিনিট টানাটানি হয়, শেষে করণ মহাশয় দুই হাত আকাশে নিক্ষেপ করিয়া নর্টনকে জানাইলেন, “দ্রোণ অনেক অনেক আশ্চর্য্য কাণ্ড করিয়াছিলেন ৷” ইহাতে নর্টন সাহেব সন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইলেন না ৷ দ্রোণের বােমার অনুসন্ধান না পাইলে সন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইবেন কেন? আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “অনেক কাণ্ড আবার কি? বিশেষ কি করিলেন বলুন?” সাক্ষী ইহার অনেক উত্তর করিলেন, কিন্ত‍‍ু একটীতেও দ্রোণাচার্য্যের জীবনময় এই গুপ্ত রহস্য ভেদ হয় নাই ৷ নর্টন সাহেব চটিলেন, গর্জ্জন আরম্ভ করিলেন ৷ সাক্ষীও চিৎকার ৷ আরম্ভ করিলেন ৷ একজন উকিল হাসিয়া এই সন্দেহ প্রকাশ করিলেন যে, সাক্ষী বােধ হয় জানেন না, দ্রোণ কি করিলেন ৷ করণ মহাশয় ইহাতে ক্রোধে অভিমানে আগুন হইলেন ৷ চীৎকার করিয়া বলিলেন, “কি? আমি? আমি জানি না দ্রোণ কি করিলেন? বাঃ, আমি কি আদ্যোপান্ত মহাভারত বৃথা পড়িয়াছি?” আধঘণ্টা দ্রোণাচার্য্যের মৃতদেহ লইয়া করণে নর্টনে মহাযুদ্ধ চলিল ৷ প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর

Page 42

নর্টন আলিপুর বিচারালয় কম্পিত করিয়া তাঁহার প্রশ্ন ঘােষণা করিতে লাগিলেন, “Out with it, Mr. Editor! What did Dron do?” সম্পাদক মহাশয় উত্তরে এক লম্বা রামকাহিনী আরম্ভ করিলেন, তাহাতে দ্রোণ কি করিলেন, তাহার বিশ্বাসযােগ্য সংবাদ পাওয়া গেল না ৷ সমস্ত আদালত হাসির মহা রােলে প্রতিধ্বনিত হইল ৷ শেষে টিফিনের সময়ে করণ মহাশয় মাথা ঠাণ্ডা করিয়া একটু ভাবিয়া চিন্তিয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং সমস্যার এই মীমাংসা জানাইলেন যে, বেচারা দ্রোণ কিছুই করেন নাই, বৃথাই আধ ঘণ্টাকাল তাঁহার পরলােকগত আত্মা লইয়া টানাটানি হইয়াছে, অৰ্জ্জুনই গুরু দ্রোণকে বধ করিয়াছিলেন ৷ অৰ্জ্জুনের এই মিথ্যা অপবাদে দ্রোণাচাৰ্য্য অব্যাহতি পাইয়া কৈলাসে সদাশিবকে ধন্যবাদ দিয়াছিলেন যে, করণ মহাশয়ের সাক্ষ্যে আলিপুর বােমার মােকদ্দমায় তাঁহাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইল না ৷ সম্পাদক মহাশয়ের এক কথায় সহজে অরবিন্দ ঘােষের সঙ্গে তাঁহার সম্বন্ধ সপ্রমাণ হইত ৷ কিন্ত‍‍ু আশুতােষ সদাশিব তাঁহাকে রক্ষা করিলেন ৷

যাঁহারা সাক্ষ্য দিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হইতে পারেন ৷ পুলিস ও গােয়েন্দা, পুলিসের প্রেমে আবদ্ধ নিম্নশ্রেণীর লােক ও ভদ্রলােক এবং স্বদোষে পুলিসের প্রেমে বঞ্চিত, অনিচ্ছায় আগত সাক্ষীচয় ৷ প্রত্যেক শ্রেণীর সাক্ষ্য দিবার প্রথা স্বতন্ত্র ছিল ৷ পুলিস মহােদয়গণ প্রফুল্লভাবে অম্লানবদনে তাঁহাদের পূৰ্ব্বজ্ঞাত বক্তব্য মনের মত বলিয়া যাইতেন, যাহাকে চিনিতে হয়, চিনিয়া লইতেন, কোনও সন্দেহ নাই, দ্বিধা নাই, ভুলচুক নাই ৷ পুলিসের বন্ধুসকল অতিশয় আগ্রহের সহিত সাক্ষ্য দিতেন, যাহাকে চিনিতে হয়, তাহাকেও চিনিয়া লইতেন, যাহাকে চিনিতে হয় না, তাহাকেও অনেকবার অতিমাত্র আগ্রহের চোটে চিনিয়া লইতেন ৷ অনিচ্ছায় আগত যাঁহারা, তাঁহারা যাহা জানিতেন, তাহা বলিতেন, কিন্ত‍‍ু তাহা অতি অল্প হইত; নর্টন সাহেব তাহাতে অসন্ত‍‍ু‍ষ্ট হইয়া সাক্ষীর পেটে অশেষ মূল্যবান ও সন্দেহনাশক প্রমাণ আছে ভাবিয়া জেরার জোরে পেট চিরিয়া তাহা বাহির করিবার বিস্তর চেষ্টা করিতেন ৷ ইহাতে সাক্ষীগণ মহা বিপদে পড়িতেন ৷ এক দিকে নর্টন সাহেবের গর্জ্জন ও বার্লি সাহেবের আরক্ত চক্ষু, অপর দিকে মিথ্যা সাক্ষ্যে দেশবাসীকে দ্বীপান্তরে পাঠাইবার মহাপাপ ৷ নর্টন ও বার্লিকে সন্ত‍‍ু‍ষ্ট করিবেন, না ভগবানকে সন্ত‍‍ু‍ষ্ট করিবেন, সাক্ষীর পক্ষে এই প্রশ্ন গুরুতর হইয়া উঠিত ৷ একদিকে মানুষের ক্রোধে ক্ষণস্থায়ী বিপদ, অপর দিকে পাপের শাস্তি

Page 43

নরক ও পরজন্মে দুঃখ ৷ কিন্ত‍‍ু তিনি ভাবিতেন, নরক ও পরজন্ম এখনও দূরবর্ত্তী অথচ মনুষ্যকৃত বিপদ পরমুহূর্ত্তে গ্রাস করিতে পারে ৷ কবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে নারাজ হওয়ায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার অপরাধে ধৃত হইবেন, সেই ভয় অনেকের মনে বিদ্যমান থাকিবার কথা, কারণ এইরূপ স্থলে এইরূপ পরিণামের দৃষ্টান্ত বিরল নহে ৷ অতএব এই শ্রেণীর সাক্ষীর পক্ষে তাঁহারা যতক্ষণ সাক্ষীর কাঠগড়ায় অতিবাহিত করিতেন, ততক্ষণ বিলক্ষণ ভীতি ও যন্ত্রণার সময় হইত ৷ জেরা শেষ হইলে অর্দ্ধনির্গত প্রাণ আবার ধড়ে ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাদিগকে যন্ত্রণামুক্ত করিত ৷ কয়েকজন সাহসের সহিত সাক্ষ্য দিয়া নর্টনের গর্জ্জনের ভ্রূক্ষেপ করেন নাই, ইংরাজ কৌন্সিলীও তাহা দেখিয়া জাতীয় প্রথা অনুসরণ পূর্ব্বক নরম হইয়া পড়িতেন ৷ এইরূপ কত সাক্ষী আসিয়া কত প্রকার সাক্ষ্য দিয়া গেলেন, কিন্ত‍‍ু একজনও পুলিসের উল্লেখযােগ্য কোন সুবিধা করেন নাই ৷ একজন স্পষ্ট বলিলেন, আমি কিছুই জানি না, কেন পুলিস আমাকে টানিয়া আনিয়াছেন, তাহা বুঝি না! এইরূপ মােকদ্দমা করিবার প্রথা বােধ হয়, ভারতেই হইতে পারে, অন্য দেশ হইলে জজ ইহাতে চটিয়া উঠিতেন ও পুলিসকে তীব্র গঞ্জনার সহিত শিক্ষা দিতেন ৷ বিনা অনুসন্ধানে দোষী ও নির্দ্দোষী নির্ব্বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া আন্দাজে শত শত সাক্ষী আনিয়া দেশের টাকা নষ্ট করা এবং নিরর্থক আসামীদিগকে কারাযন্ত্রণার মধ্যে দীর্ঘকাল রাখা, এই দেশেরই পুলিসের পক্ষে শােভা পায় ৷ কিন্ত‍‍ু বেচারা পুলিস কি করিবে? তাঁহারা নামে গােয়েন্দা কিন্ত‍‍ু সেইরূপ ক্ষমতা যখন তাঁহাদের নাই, তখন এইরূপে সাক্ষীর জন্য বিশাল জাল ফেলিয়া উত্তম মধ্যম অধম সাক্ষী যােগাড় করিয়া আন্দাজে কাঠগড়ায় উপস্থিত করাই একমাত্র উপায় ৷ কে জানে, তাহারা কিছু জানিতেও পারে, কিছু প্রমাণ দিতেও পারে ৷

আসামী চিনিবার ব্যবস্থাও অতি রহস্যময় ছিল ৷ প্রথমতঃ, সাক্ষীকে বলা হইত, তুমি কি ইহাদের মধ্যে কাহাকেও চিনিতে পারিবে? সাক্ষী যদি বলিতেন, হ্যাঁ, চিনিতে পারি, তৎক্ষণাৎ নর্টন সাহেব হর্ষোৎফুল্ল হইয়া কাঠগড়ায় identification parade-এর ব্যবস্থা করাইয়া তাঁহাকে সেইখানে তাঁহার স্মরণশক্তি চরিতার্থ করিবার আদেশ দিতেন ৷ যদি তিনি বলিতেন, জানি না, হয়ত চিনিতেও পারি, তিনি একটু বিমর্ষ হইয়া বলিতেন, আচ্ছা যাও, চেষ্টা কর ৷ যদি কেহ বলিতেন, না, পারিব না, তাহাদের দেখি নাই অথবা লক্ষ্য করি নাই; তথাপি নর্টন সাহেব তাঁহাকে ছাড়িতেন না ৷ যদি এতগুলি মুখ দেখিয়া পূৰ্ব্বজন্মের কোনও স্মৃতি জাগ্রত হয়, সেই জন্য তাঁহাকে পরীক্ষা করিতে পাঠাইতেন ৷ সাক্ষীর তেমন

Page 44

যােগশক্তি ছিল না ৷ হয় ত পূৰ্ব্বজন্মবাদে আস্থাও নাই, তিনি আসামীদের দীর্ঘ দুই শ্রেণীর আদি হইতে অন্ত পৰ্য্যন্ত সার্জ্জেণ্টের নেতৃত্বের অধীনে গম্ভীর ভাবে কুচ করিয়া আমাদের মুখের দিকে না চাহিয়াও মাথা নাড়িয়া বলিতেন, না, চিনি না ৷ নর্টন নিরাশ হৃদয়ে এই মৎস্যশূন্য জীবন্ত জাল ফিরাইয়া লইতেন ৷ এই মােকদ্দমায় মনুষ্যের স্মরণশক্তি কতদূর প্রখর ও অভ্রান্ত হইতে পারে, তাহার অপূৰ্ব্ব প্রমাণ পাওয়া গেল ৷ ত্রিশ চল্লিশ জন দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহাদের নাম জানা নাই, তাহাদের সহিত কোন জন্মে একবারও আলাপ হয় নাই, অথচ দুইমাস পূর্ব্বে কাহাকে দেখিয়াছি, কাহাকে দেখি নাই, অমুককে অমুক তিন স্থানে দেখিয়াছি, অমুক দুইস্থানে দেখি নাই; – উহাকে দাঁত মাজিতে একবার দেখিয়াছি অতএব তাঁহার চেহারা আমার মনে জন্ম-জন্মান্তর মত অঙ্কিত হইয়া রহিল ৷ ইহাকে কবে দেখিলাম কি করিতেছিলেন, কে সঙ্গে ছিলেন, না একাকী ছিলেন, কিছুই মনে নাই, অথচ তাঁহারও চেহারা আমার মনে জন্ম-জন্মান্তরের জন্য অঙ্কিত হইয়া রহিল; হরিকে দশবার দেখিয়াছি সুতরাং তাঁহাকে ভুলিবার কোন সম্ভাবনা নাই, শ্যামকে একবার মােটে আধ মিনিটের জন্য দেখিলাম, কিন্ত‍‍ু তাহাকেও মরণের অন্তিম দিন পর্য্যন্ত ভুলিতে পারিব না, কোন ভুল হইবার সম্ভাবনা নাই, – এইরূপ স্মরণশক্তি এই অসম্পূর্ণ মানব প্রকৃতিতে, এই তমাভিভূত মর্ত্ত্যধামে সচরাচর দেখা যায় না ৷ অথচ একজনের নহে, দুই জনের নহে, প্রত্যেক পুলিস পুঙ্গবের এইরূপ বিচিত্র নির্ভল অভ্রান্ত স্মরণশক্তি দেখা গেল ৷ এতদ্দ্বারা সী, আই, ডী,-র উপর আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা দিন দিন প্রগাঢ় হইতে লাগিল ৷ দুঃখের কথা, সেশন্স কোর্টে এই ভক্তি কমাইতে হইয়াছিল ৷ ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে যে দুই একবার সন্দেহ হয় নাই, তাহাও নয় ৷ যখন লেখা সাক্ষ্যে দেখিলাম যে, শিশির ঘােষ এপ্রিল মাসে বােম্বাইতে ছিলেন অথচ কয়েকজন পুলিস পুঙ্গব ঠিক সেই সময়ে তাঁহাকে স্কটস্ লেনে ও হ্যারিসন রােডে দেখিয়াছিলেন, তখন একটু সন্দেহ হইল বটে ৷ যখন শ্রীহট্টবাসী বীরেন্দ্রচন্দ্র সেন স্থূল শরীরে বানিয়াচঙ্গে পিতৃভবনে থাকিয়াও বাগানে ও স্কটস্ লেনে – যে স্কটস্ লেনের ঠিকানা বীরেন্দ্র জানিতেন না, ইহার অকাট্য প্রমাণ লেখা সাক্ষ্যে পাওয়া গেল – তাঁহার সূক্ষ্ম শরীর সী, আই, ডী,-এর সূক্ষ্ম দৃষ্টিগােচর হইয়াছিল, তখন আরও সন্দেহ হইল ৷ বিশেষতঃ যাঁহারা স্কটস্ লেনে কখনও পদার্পণ করেন নাই, তাঁহারা যখন শুনিলেন যে সেখানে পুলিস তাহাদিগকে অনেকবার দেখিয়াছেন, তখন একটু সন্দেহের উদ্রেক হওয়া নিতান্ত অস্বাভাবিক নহে ৷ একজন মেদিনীপুরের সাক্ষী বলিলেন যে তিনি

Page 45

– মেদিনীপুরের আসামীরা বলিলেন যে তিনিই গােয়েন্দা – শ্রীহট্টের হেমচন্দ্র সেনকে তমলুকে বক্তৃতা করিতে দেখিয়াছিলেন ৷ কিন্ত‍‍ু হেমচন্দ্র স্থূলচক্ষে কখন তমলুক দেখেন নাই, অথচ তাঁহার ছায়াময় শরীর দূর শ্রীহট্ট হইতে তমলুকে ছুটিয়া তেজস্বী ও রাজদ্রোহপূর্ণ স্বদেশী বক্তৃতা করিয়া গােয়েন্দা মহাশয়ের চক্ষুতৃপ্তি এবং কর্ণতৃপ্তি সম্পাদন করিয়াছিল ৷ কিন্ত‍‍ু চন্দননগরের চারুচন্দ্র রায়ের ছায়াময় শরীর মাণিকতলায় উপস্থিত হইয়া আরও রহস্যময় কাণ্ড করিয়াছিল ৷ দুই জন পুলিস কর্ম্মচারী শপথ করিয়া বলিলেন যে, তাঁহারা অমুক দিনে অমুক সময়ে চারু বাবুকে শ্যামবাজারে দেখিয়াছিলেন, তিনি শ্যামবাজার হইতে একজন মুখ্য ষড়যন্ত্রকারীর সহিত মাণিকতলা বাগানে হাঁটিয়া গিয়াছিলেন, তাঁহারাও সেই পৰ্য্যন্ত তাঁহার অনুসরণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা অতি নিকট হইতে দেখিয়া লক্ষ্য করিয়াছিলেন; ভুল হইবার কথা নাই ৷ উকিলের জেরায় সাক্ষীদ্বয় টলেন নাই ৷ ব্যাসস্য বচনং সত্যং, পুলিসের সাক্ষ্যও অন্যরূপ হইতে পারে না ৷ দিন ও সময় সম্বন্ধেও তাঁহাদের ভুল হইবার কথা নহে, কারণ ঠিক সেই দিনে সেই সময়ে চারু বাবু কলেজ হইতে ছুটি লইয়া কলিকাতায় উপস্থিত ছিলেন, চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের অধ্যক্ষের সাক্ষ্যে ইহা প্রমাণিত হইয়াছিল ৷ কিন্ত‍‍ু আশ্চর্য্যের কথা, ঠিক সেই দিনে সেই সময়ে চারু বাবু হাওড়া ষ্টেশনের প্লাটফরমে চন্দননগরের মেয়র তাৰ্দিভাল, তাৰ্দিভালের স্ত্রী, চন্দননগরের গবর্ণর ও অন্যান্য সম্ভ্রান্ত য়ুরােপীয় ভদ্রলােকের সহিত কথা কহিতে কহিতে পায়চারি করিতেছিলেন ৷ ইঁহারা সকলে সেই কথা স্মরণ করিয়া চারু বাবুর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হইয়াছিলেন ৷ ফ্রেঞ্চ গবর্ণমেন্টের চেষ্টায় পুলিস চারুবাবুকে মুক্তি দেওয়ায় বিচারালয়ে এই রহস্য উদ‍্ঘাটন হয় নাই ৷ চারু বাবুকে এই পরামর্শ প্রদান করিতেছি যে তিনি এই প্রমাণ সকল Psychical Research Society-র নিকট পাঠাইয়া মনুষ্যজাতির জ্ঞানসঞ্চয়ের সাহায্য করুন ৷ পুলিসের সাক্ষ্য মিথ্যা হইতে পারে না, – বিশেষতঃ সী, আই, ডী-র – অতএব থিয়সফির আশ্রয় ভিন্ন আমাদের আর উপায় নাই ৷ মােটের উপর বৃটিশ আইন প্রণালীতে কত সহজে নির্দ্দোষীর কারাদণ্ড, কালাপানি ও ফঁসি পর্য্যন্ত হইতে পারে, তাহার দৃষ্টান্ত এই মােকদ্দমায় পদে পদে পাইলাম ৷ নিজে কাঠগড়ায় না দাঁড়াইলে পাশ্চাত্য বিচারপ্রণালীর মায়াবী অসত্যতা হৃদয়ঙ্গম করা যায় না ৷ য়ুরােপের এই প্রণালী জুয়াখেলা বিশেষ; ইহা মানুষের স্বাধীনতা, মানুষের সুখ-দুঃখ, তাঁহার ও তাঁহার পরিবার ও আত্মীয়-বন্ধুর জীবনব্যাপী যন্ত্রণা, অপমান, জীবন্ত মৃত্যু লইয়া জুয়াখেলা ৷ ইহাতে কত দোষী বাঁচে, কত

Page 46

নির্দ্দোষী মরে, তাহার ইয়ত্তা নাই ৷ য়ুরােপে কেন Socialism C Anarchism-এর এত প্রচার ও প্রভাব হইয়াছে, এই জুয়াখেলার মধ্যে একবার আসিলে, এই নিষ্ঠুর নির্ব্বিচার সমাজরক্ষক পেষণযন্ত্রের মধ্যে একবার পড়িলে তাহা প্রথম বােধগম্য হয় ৷ এমত অবস্থায় ইহা আশ্চর্য্যের কথা নহে, যে অনেক উদারচেতা দয়ালু লােক বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, এই সমাজ ভাঙ্গিয়া দাও, চুরমার কর; এত পাপ, এত দুঃখ, এত নির্দ্দোষীর তপ্ত নিঃশ্বাসে ও হৃদয়ের শােণিতে যদি সমাজ রক্ষা করিতে হয়, তাহা হইলে তাহা রক্ষা করা নিষ্প্রয়ােজন ৷

ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে একমাত্র বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা নরেন্দ্রনাথ গােস্বামীর সাক্ষ্য ৷ সেই ঘটনা বর্ণনা করিবার পূর্ব্বে আমার বিপদের সঙ্গী বালক আসামীদের কথা বলি ৷ কোর্টে ইহাদের আচরণ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে বঙ্গে নূতন যুগ আসিয়াছে, নূতন সন্ততি মায়ের কোলে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে ৷ সেকালের বাঙ্গালীর ছেলে দুই প্রকার ছিল, হয় শান্ত, শিষ্ট, নিরীহ, সচ্চরিত্র, ভীরু, আত্মসম্মান ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা শূন্য, নয়ত দুশ্চরিত্র, দুর্দ্দান্ত, অস্থির, ঠগ, সংযম ও সততাশূন্য! এই দুই চরমাবস্থার মধ্যস্থলে নানারূপ জীব বঙ্গজননীর ক্রোড়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্ত‍‍ু আট দশজন অসাধারণ প্রতিভাবান শক্তিমান ভবিষ্যৎকালের পথপ্রদর্শক ভিন্ন এই দুই শ্রেণীর অতীত তেজস্বী আৰ্য্যসন্তান প্রায়ই দেখা যাইত না ৷ বাঙ্গালীর বুদ্ধি ছিল, মেধাশক্তি ছিল, কিন্ত‍‍ু শক্তি ও মনুষ্যত্ব ছিল না ৷ কিন্ত‍‍ু এই বালকগণকে দেখিয়াই বােধ হইত যেন অন্য কালের অন্য শিক্ষাপ্রাপ্ত উদারচেতা দুর্দ্দান্ত তেজস্বী পুরুষ সকল আবার ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিয়াছেন ৷ সেই নির্ভীক, সরল চাহনি, সেই তেজপূর্ণ কথা, সেই ভাবনাশূন্য আনন্দময় হাস্য, এই ঘাের বিপদের সময়ে সেই অক্ষুন্ন তেজস্বিতা, মনের প্রসন্নতা, বিমর্ষতা ভাবনা বা সন্তাপের অভাব সেকালের তমঃক্লিষ্ট ভারতবাসীর নহে, নূতন যুগের নূতন জাতির, নূত্ন কৰ্ম্মস্রোতের লক্ষণ ৷ ইঁহারা যদি হত্যাকারী হন, তবে বলিতে হয় যে, হত্যার রক্তময় ছায়া তাঁহাদের স্বভাবে পড়ে নাই, ক্রূরতা, উন্মত্ততা, পাশবিক ভাব তাঁহাদের মধ্যে আদবে ছিল না ৷ তাঁহারা ভবিষ্যতের জন্য বা মােকদ্দমার ফলের জন্য লেশমাত্র চিন্তা না করিয়া কারাবাসের দিন বালকের আমােদে, হাস্যে, ক্রীড়ায়, পড়া-শুনায়, সমালােচনায় কাটাইয়াছিলেন ৷ তাঁহারা অতি শীঘ্র জেলের কর্ম্মচারী, সিপাহী, কয়েদী, য়ুরােপীয় সার্জ্জেণ্ট, ডিটেকটিভ, কোর্টের কর্ম্মচারী, সকলের সঙ্গে ভাব করিয়া লইয়াছিলেন এবং শত্রু মিত্র বড়

Page 47

ছােট বিচার না করিয়া সকলের সঙ্গে আমােদ গল্প ও উপহাস আরম্ভ করিয়াছিলেন ৷ কোর্টের সময় তাঁহাদের পক্ষে অতি বিরক্তিকর ছিল, কারণ মােকদ্দমা প্রহসনে রস অতি অল্প ছিল ৷ এই সময় কাটাইবার জন্য তাঁহাদের পড়িবার বই ছিল না, কথা কহিবার অনুমতিও ছিল না ৷ যাঁহারা যােগ আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাঁহারা তখনও গণ্ডগােলের মধ্যে ধ্যান করিতে শেখেন নাই, তাঁহাদের পক্ষে সময় কাটান বড় কঠিন হইয়া উঠিত ৷ প্রথমতঃ দুই চারিজন পড়িবার বই ভিতরে আনিতে লাগিলেন, তাঁহাদের দেখাদেখি আর সকলে সেই উপায় অবলম্বন করিলেন ৷ তাহার পরে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যাইত যে, মােকদ্দমা চলিতেছে, ত্রিশ চল্লিশ জন আসামীর সমস্ত ভবিষ্যৎ লইয়া টানাটানি হইতেছে, তাহার ফল ফঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু বা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হইতে পারে, অথচ সেই আসামীগণ সেই দিকে দৃক‍্পাত না করিয়া কেহ বঙ্কিমের উপন্যাস, কেহ বিবেকানন্দের রাজযােগ বা Science of Religions, কেহ গীতা, কেহ পুরাণ, কেহ য়ুরােপীয় দর্শন একাগ্রমনে পড়িতেছেন ৷ ইংরাজ সার্জ্জেণ্ট বা দেশী সিপাহী কেহই তাঁহাদের এই আচরণে বাধা দিত না ৷ তাঁহারা ভাবিয়া ছিলেন, ইহাতেই যদি এতগুলি পিঞ্জরাবদ্ধ ব্যাঘ্র শান্ত হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাদেরও কাৰ্য্য লঘু হয়; অধিকন্ত‍‍ু ইহাতে কাহারও ক্ষতি নাই ৷ কিন্ত‍‍ু একদিন বার্লি সাহেবের দৃষ্টি এই দৃশ্যের প্রতি আকৃষ্ট হইল, এই আচরণ ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের অসহ্য হইয়া উঠিল ৷ দুই দিন তিনি কিছু বলেন নাই, পরে আর থাকিতে পারিলেন না, বইয়ের আমদানি বন্ধ করিবার হুকুম দিলেন ৷ বাস্তবিক বার্লি এমন সুন্দর বিচার করিতেছেন, তাহা শ্রবণ করিয়া কোথায় সকলে আনন্দ লাভ করিবেন, না সকলে বই পড়িতেন ৷ ইহাতে বার্লির গৌরব ও বৃটিশ জষ্টিসের মহিমার প্রতি ঘাের অসম্মান প্রদর্শন করা হইত সন্দেহ নাই ৷

আমরা যতদিন স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ঘরে আবদ্ধ ছিলাম, ততদিন কেবল গাড়ীতে, ম্যাজিষ্ট্রেট আসিবার পূর্ব্বের একঘণ্টা বা আধঘণ্টাকাল এবং টিফিনের সময় কতকটা আলাপ করিবার অবসর পাইতাম ৷ যাঁহাদের পরস্পরের সহিত পরিচয় বা আলাপ ছিল, তাঁহারা এই সময়ে cell-এর নীরবতা ও নির্জ্জনতার শােধ লইতেন, হাসি, আমােদ ও নানা বিষয়ের আলােচনায় সময় কাটাইতেন ৷ কিন্ত‍‍ু এইরূপ অবসরে অপরিচিত লােকের সঙ্গে আলাপের সুবিধা হয় না, সেইজন্য আমার ভাই বারীন্দ্র ও অবিনাশ ভিন্ন আমি আর কাহারও সহিত অধিক আলাপ করিতাম না, তাঁহাদের হাসি ও গল্প শুনিতাম, স্বয়ং তাহাতে যােগ দিতাম না ৷

Page 48

কিন্ত‍‍ু একজন আমার কাছে মাঝে মাঝে ঘেঁসিয়া আসিতেন, তিনি ভাবী approver নরেন্দ্রনাথ গােস্বামী ৷ অন্য বালকদের ন্যায় তাঁহার শান্ত ও শিষ্ট স্বভাব ছিল না, তিনি সাহসী, লঘুচেতা এবং চরিত্রে, কথায়, কর্ম্মে অসংযত ছিলেন ৷ ধৃত হইবার কালে নরেন গোঁসাই তাঁহার স্বাভাবিক সাহস ও প্রগল‍্ভতা দেখাইয়াছিলেন, কিন্ত‍‍ু লঘুচেতা বলিয়া কারাবাসের যৎকিঞ্চিৎ দুঃখ অসুবিধা সহ্য করা তাঁহার পক্ষে অসাধ্য হইয়াছিল ৷ তিনি জমিদারের ছেলে সুতরাং সুখে, বিলাসে, দুর্নীতিতে লালিত হইয়া কারাগৃহের কঠোর সংযম ও তপস্যায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছিলেন, আর সেই ভাব সকলের নিকট প্রকাশ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই ৷ যে কোন উপায়ে এই যন্ত্রণা হইতে মুক্ত হইবার উৎকট বাসনা তাঁহার মনে দিন দিন বাড়িতে লাগিল ৷ প্রথম তাঁহার এই আশা ছিল যে নিজের স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করিয়া প্রমাণ করিতে পারিবেন যে পুলিস তাঁহাকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়া দোষ স্বীকার করাইয়াছিলেন ৷ তিনি আমাদের নিকট জানাইলেন যে, তাঁহার পিতা সেইরূপ মিথ্যা সাক্ষী যােগাড় করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন ৷ কিন্ত‍‍ু অল্প দিনেই আর এক ভাব প্রকাশ পাইতে লাগিল ৷ তাঁহার পিতা ও একজন মােক্তার তাঁহার নিকট জেলে ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিলেন, শেষে ডিটেক‍্টিভ শামসুল আলমও তাঁহার নিকট আসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া গােপনে কথাবার্ত্তা কহিতে লাগিলেন ৷ এই সময়ে হঠাৎ গোঁসাইয়ের কৌতূহল ও প্রশ্ন করিবার প্রবৃত্তি হইয়াছিল বলিয়া অনেকের সন্দেহের উদ্রেক হয় ৷ ভারতবর্ষে বড় বড় লােকের সহিত তাঁহাদের আলাপ বা ঘনিষ্ঠতা ছিল কি না, গুপ্ত সমিতিকে কে কে আর্থিক সাহায্য দিয়া তাহা পােষণ করিয়াছিলেন, সমিতির লােক বাহিরে বা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে কে কে ছিল, কাহারা এখন সমিতির কার্য্য চালাইবেন, কোথায় শাখা সমিতি রহিয়াছে ইত্যাদি অনেক ছােট বড় প্রশ্ন বারীন্দ্র ও উপেন্দ্রকে করিতেন ৷ গোঁসাইয়ের এই জ্ঞানতৃষ্ণার কথা অচিরাৎ সকলের কর্ণগােচর হইল এবং শামসুল আলমের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠতার কথাও আর গােপনীয় প্রেমালাপ না হইয়া open secret হইয়া উঠিল ৷ ইহা লইয়া অনেক আলােচনা হয় এবং কেহ কেহ ইহাও লক্ষ্য করে যে এইরূপ পুলিস দর্শনের পরই সর্ব্বদা নব নব প্রশ্ন গোঁসাইয়ের মনে জুটিত ৷ বলা বাহুল্য তিনি এই সকল প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পান নাই ৷ যখন প্রথম এই কথা আসামীদের মধ্যে রাষ্ট্র হইতে লাগিল, তখন গোঁসাই স্বয়ং স্বীকার করিয়াছিলেন যে পুলিস তাঁহার নিকট আসিয়া “রাজার সাক্ষী” হইবার জন্য তাঁহাকে নানা উপায়ে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছেন ৷ তিনি আমাকে কোর্টে

Page 49

একবার এই কথা বলিয়াছিলেন ৷ আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, “আপনি কি উত্তর দিয়াছেন?” তিনি বলিলেন, “আমি কি শুনিব! আর শুনিলেও আমি কি জানি যে তাঁহাদের মনের মত সাক্ষ্য দিব?” তাহার কিয়ৎদিন পরে আবার যখন এই কথা উল্লেখ করিলেন, তখন দেখিলাম, ব্যাপারটা অনেক দূরে গড়াইয়াছে ৷ জেলে Identification parade-এর সময় আমার পার্শ্বে গোঁসাই দাঁড়াইয়াছিলেন, তখন তিনি আমাকে বলেন, “পুলিস কেবলই আমার নিকট আসেন ৷” আমি উপহাস করিয়া বলিলাম, “আপনি এই কথা বলুন না কেন যে সার আন্দ্রু ফ্রেজার গুপ্ত সমিতির প্রধান পৃষ্ঠপােষক ছিলেন, তাহা হইলে তাঁহাদের পরিশ্রম সার্থক হইবে ৷” গোঁসাই বলিলেন, “সেই ধরণের কথা বলিয়াছি বটে ৷ আমি তাঁহাকে বলিয়াছি যে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জী আমাদের head এবং তাঁহাকে একবার বােমা দেখাইয়াছি ৷” আমি স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই কথা বলিবার প্রয়ােজন কি ছিল?” গোঁসাই বলিলেন, “আমি —দের শ্রাদ্ধ করিয়া ছাড়িব ৷ সেই ধরণের আরও অনেক খবর দিয়াছি ৷ বেটারা corroboration খুঁজিয়া খুঁজিয়া মরুক ৷ কে জানে, এই উপায়ে মােকদ্দমা ফাঁসিয়া যাইতেও পারে ৷” ইহার উত্তরে আমি কেবল বলিয়াছিলাম, “এই নষ্টামি ছাড়িয়া দিন ৷ উহাদের সঙ্গে চালাকী করিতে গেলে নিজে ঠকিবেন ৷” জানি না, গোঁসাইয়ের এই কথা কতদূর সত্য ছিল ৷ আর সকল আসামীদের এই মত ছিল যে আমাদের চক্ষে ধূলা দিবার জন্য তিনি এই কথা বলিয়াছিলেন, আমার বােধ হয় যে তখনও গোঁসাই approver হইতে সম্পূর্ণ কৃতনিশ্চয় হন নাই, তাঁহার মন সেই দিকে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছিল সত্য, কিন্ত‍‍ু পুলিসকে ঠকাইয়া তাঁহাদের কেস মাটী করিবার আশাও তাঁহার ছিল ৷ চালাকী ও অসদুপায়ে কার্য্যসিদ্ধি দুষ্প্রবৃত্তির স্বাভাবিক প্রেরণা ৷ তখন হইতে বুঝিতে পারিলাম যে, গোঁসাই পুলিসের বশ হইয়া সত্য মিথ্যা তাহাদের যাহা প্রয়ােজন, তাহা বলিয়া নিজে রক্ষা পাইবার চেষ্টা করিবেন ৷ একটী নীচ স্বভাবের আরও নিম্নতর দুষ্কৰ্ম্মের দিকে অধঃপতন আমাদের চক্ষের সম্মুখে নাটকের মত অভিনীত হইতে লাগিল ৷ আমি দিন দিন দেখিলাম, গোঁসাইয়ের মন কিরূপে বদলাইয়া যাইতেছে, তাহার মুখ, ভাবভঙ্গী, কথাবার্ত্তারও পরিবর্ত্তন হইতেছে ৷ তিনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহার সঙ্গীদের সর্ব্বনাশ করিবার যােগাড় করিতেছিলেন, তাহার সমর্থন জন্য ক্রমে ক্রমে নানা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক যুক্তি বাহির করিতে লাগিলেন ৷ এমন interesting psychological study প্রায়ই হাতের নিকট পাওয়া যায় না ৷

Page 50

প্রথম কেহই গোঁসাইকে জানিতে দিলেন না যে সকলে তাঁহার অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়াছেন ৷ তিনিও এমন নির্ব্বোধ যে অনেক দিন ইহার কিছু বুঝিতে পারেন নাই, তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি খুব গােপনে পুলিসের সাহায্য করিতেছি ৷ কিন্ত‍‍ু কয়েক দিন পরে যখন হুকুম হইল যে, আর আমাদের নির্জ্জন কারাবাসে রাখিয়া একসঙ্গে রাখা হইবে, তখন সেই নূতন ব্যবস্থায় পরস্পরের সহিত রাত-দিন দেখা ও কথাবার্ত্তা হওয়ায় আর বেশী দিন কিছুই লুকাইয়া রাখিবার সম্ভাবনা ছিল না ৷ এই সময়ে দুই একজন বালকের সঙ্গে গোঁসাইয়ের ঝগড়া হয়, তাহাদের কথায় ও সকলের অপ্রীতিকর ব্যবহারে গোঁসাই বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার অভিসন্ধি কাহারও অজ্ঞাত নহে ৷ যখন গোঁসাই সাক্ষ্য দেন, তখন কয়েকটী ইংরাজী কাগজে এই খবর বাহির হয় যে, আসামীগণ এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় চমৎকৃত ও উত্তেজিত হইলেন ৷ বলা বাহুল্য ইহা নিতান্ত রিপাের্টারদেরই কল্পনা ৷ অনেক দিন আগেই সকলে বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই প্রকার সাক্ষ্য দেওয়া হইবে ৷ এমন কি, যে দিনে যে সাক্ষ্য দেওয়া হইবে, তাহাও জানিতে পারা গিয়াছিল ৷ এই সময়ে একজন আসামী গোঁসাইয়ের নিকট গিয়া বলিলেন – দেখ ভাই, আর সহ্য হয় না, আমিও approver হইব, তুমি শামসুল আলমকে বল আমারও যেন খালাস পাইবার ব্যবস্থা করেন ৷ গোঁসাই সম্মত হইলেন, কয়েক দিন পরে তাঁহাকে বলিলেন যে এই অর্থে গবর্ণমেণ্ট হইতে চিঠি আসিয়াছে যে, সেই আসামীর নিবেদনের অনুকূল নির্ণয় (favourable consideration) হইবার সম্ভাবনা আছে ৷ এই বলিয়া গোঁসাই তাহাকে উপেন প্রভৃতির নিকট হইতে এইরূপ কয়েকটী আবশ্যকীয় কথা বাহির করিতে বলিলেন, যেমন কোথায় গুপ্ত সমিতির শাখা সমিতি ছিল, কাহারা তাহার নেতা, ইত্যাদি ৷ নকল approver আমােদ-প্রিয় ও রসিক লােক ছিলেন, তিনি উপেন্দ্রনাথের সহিত পরামর্শ করিয়া গোঁসাইকে কয়েকটী কল্পিত নাম জানাইয়া বলিলেন যে, মাদ্রাজে বিশ্বম্ভর পিলে, সাতারায় পুরুষােত্তম নাটেকর, বােম্বাইতে প্রােফেসার ভট্ট এবং বরােদায় কৃষ্ণাজীরাও ভাও এই গুপ্ত সমিতির শাখার নেতা ছিলেন ৷ গোঁসাই আনন্দিত হইয়া এই বিশ্বাসযােগ্য সংবাদ পুলিসকে জানাইলেন ৷ পুলিসও মাদ্রাজ তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিলেন, অনেক ছােট বড় পিলেকে পাইলেন, কিন্ত‍‍ু একটীও পিলে বিশ্বম্ভর বা অর্দ্ধ বিশ্বম্ভরও পাইলেন না, সাতারার পুরুষােত্তম নাটেকরও তাঁহার অস্তিত্ব ঘন অন্ধকারে গুপ্ত রাখিয়া রহিলেন, বােম্বাইয়ে একজন প্রােফেসার ভট্ট পাওয়া গেলেন, কিন্ত‍‍ু তিনি নিরীহ রাজভক্ত ভদ্রলােক, তাঁহার পিছনে কোন গুপ্ত সমিতি

Page 51

থাকিবার সম্ভাবনা ছিল না ৷ অথচ সাক্ষ্য দিবার সময় গোঁসাই পূৰ্ব্বকালে উপেনের নিকট শােনা কথা বলিয়া কল্পনারাজ্য নিবাসী বিশ্বম্ভর পিলে ইত্যাদি ষড়যন্ত্রের মহারথীগণকে নর্টনের শ্রীচরণে বলি দিয়া তাঁহার অদ্ভুত prosecution theory পুষ্ট করিলেন ৷ বীর কৃষ্ণাজীরাও ভাও লইয়া পুলিস আর একটী রহস্য করিলেন ৷ তাঁহারা বাগান হইতে বরােদার কৃষ্ণাজীরাও দেশপাণ্ডের নামে কোনও “ঘােষ’ দ্বারা প্রেরিত টেলিগ্রামের নকল বাহির করিলেন ৷ সেইরূপ নামের কোন লােক ছিল কি না, বরােদাবাসী তাহার কোন সন্ধান পান নাই, কিন্ত যখন সত্যবাদী গোঁসাই বরােদাবাসী কৃষ্ণাজীরাও ভাওয়ের কথা বলিয়াছেন, তখন নিশ্চয় কৃষ্ণাজীরাও ভাও ও কৃষ্ণাজীরাও দেশপাণ্ডে একই ৷ আর কৃষ্ণাজীরাও দেশপাণ্ডে থাকুন বা না থাকুন, আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু কেশবরাও দেশপাণ্ডের নাম চিঠিপত্রে পাওয়া গিয়াছিল ৷ অতএব নিশ্চয় কৃষ্ণাজীরাও ভাও, কৃষ্ণাজীরাও দেশপাণ্ডে এবং কেশবরাও দেশপাণ্ডে একই লােক ৷ ইহাতে প্রমাণিত হল যে, কেশবরাও দেশপাণ্ডে গুপ্ত ষড়যন্ত্রের একজন প্রধান পাণ্ডা ৷ এইরূপ অসাধারণ অনুমান সকলের উপর নর্টন সাহেবের সেই বিখ্যাত theory প্রতিষ্ঠিত ছিল ৷

গোঁসাইয়ের কথা বিশ্বাস করিলে ইহাই বিশ্বাস করিতে হয় যে, তাঁহারই কথায় আমাদের নির্জ্জন কারাবাস ঘুচিয়া যায় এবং আমাদের একত্ৰ বাসের হুকুম হয় ৷ তিনি বলিয়াছিলেন যে, পুলিস তাঁহাকে সকলের মধ্যে রাখিয়া ষড়-যন্ত্রের গুপ্ত কথা বাহির করিবার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা করেন ৷ গোঁসাই জানিতেন না যে সকলে পূর্ব্বেই তাঁহার নূতন ব্যবসার কথা জানিতে পারিয়াছেন, সেইজন্য কাহারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কোথায় শাখা সমিতি, কে টাকা দিতেন বা সাহায্য করিতেন, কে এখন গুপ্ত সমিতির কার্য্য চালাইবেন, এইরূপ অনেক প্রশ্ন করিতে লাগিলেন ৷ এই সকল প্রশ্নের কিরূপ উত্তর লাভ করিয়াছিলেন তাহার দৃষ্টান্ত উপরে দিয়াছি ৷ কিন্ত‍‍ু গোঁসাইয়ের অধিকাংশ কথাই মিথ্যা ৷ ডাক্তার ডেলি আমাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, তিনিই এমারসন সাহেবকে বলিয়া কহিয়া এই পরিবর্ত্তন করাইয়াছিলেন ৷ সম্ভবতঃ ডেলির কথাই সত্য, তাহার পরে হয়ত পুলিস নূতন ব্যবস্থার কথা অবগত হইয়া তাহা হইতে এইরূপ লাভের কল্পনা করিয়াছিলেন ৷ যাহাই হউক, এই পরিবর্ত্তনে আমা ভিন্ন সকলের পরম আনন্দ হইল, আমি তখন লােকের সঙ্গে মিশিতে অনিচ্ছুক ছিলাম, সেই সময়ে আমার সাধন খুব জোরে চলিতেছিল ৷ সমতা, নিষ্কামতা ও শান্তির কতক কতক আস্বাদ পাইয়াছিলাম, কিন্ত‍‍ু তখনও সেই ভাব দৃঢ় হয় নাই ৷ লােকের সঙ্গে মিশিলে, পরের চিন্তাস্রোতের আঘাত আমার

Page 52

অপক্ক নবীন চিন্তার উপর পড়িলেই এই নব ভাব হ্রাস পাইতে পারে, ভাসিয়া যাইতেও পারে ৷ বাস্তবিক তাহাই হইল ৷ তখন বুঝিতাম না যে আমার সাধনের পূর্ণতার জন্য বিপরীত ভাবের উদ্রেক আবশ্যক ছিল, সেইজন্য অন্তর্য্যামী আমাকে হঠাৎ আমার প্রিয় নির্জ্জনতা হইতে বঞ্চিত করিয়া উদ্দাম রজোগুণের স্রোতে ভাসাইয়া দিলেন ৷ আর সকলেই আনন্দে অধীর হইলেন ৷ সেই রাত্রিতে যে ঘরে হেমচন্দ্র দাস, শচীন্দ্র সেন ইত্যাদি গায়ক ছিলেন সেই ঘর সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ ছিল, অধিকাংশ আসামী সেইখানে একত্র হইয়াছিলেন, এবং দুটা তিনটা রাত্রি পর্য্যন্ত কেহ ঘুমাইতে পারেন নাই ৷ সারা রাত হাসির রােল, গানের অবিরাম স্রোত, এতদিনের রুদ্ধ গল্প বর্ষাকালের বন্যার মত বহিতে থাকায় নীরব কারাগার কোলাহলে ধ্বনিত হইল ৷ আমরা ঘুমাইয়া পড়িলাম কিন্ত‍‍ু যতবার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল ততবারই শুনিলাম সেই হাসি, সেই গান, সেই গল্প সমান বেগে চলিতেছে ৷ শেষ রাত্রে এই স্রোত ক্ষীণ হইয়া গেল, গায়কেরাও ঘুমাইয়া পড়িলেন, আমাদের ওয়ার্ড নীরব হইল ৷









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates