CWSA Set of 37 volumes
Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 of CWSA 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

Editions

ABOUT

All writings in Bengali and Sanskrit including brief works written for the newspaper 'Dharma' and 'Karakahini' - reminiscences of detention in Alipore Jail.

Writings in Bengali and Sanskrit

Sri Aurobindo symbol
Sri Aurobindo

All writings in Bengali and Sanskrit. Most of the pieces in Bengali were written by Sri Aurobindo in 1909 and 1910 for 'Dharma', a Calcutta weekly he edited at that time; the material consists chiefly of brief political, social and cultural works. His reminiscences of detention in Alipore Jail for one year ('Tales of Prison Life') are also included. There is also some correspondence with Bengali disciples living in his ashram. The Sanskrit works deal largely with philosophical and cultural themes. (This volume will be available both in the original languages and in a separate volume of English translations.)

The Complete Works of Sri Aurobindo (CWSA) Writings in Bengali and Sanskrit Vol. 9 715 pages 2017 Edition
Bengali
 PDF   

বাংলা রচনা




বেদ ও উপনিষদ




ঋগ্বেদ

ভূমিকা

“আৰ্য” পত্রিকায় “বেদরহস্য”তে বেদ সম্বন্ধে যে নূতন মত প্রকাশিত হইতেছে, এইগুলি সেই মতের অনুযায়ী অনুবাদ ৷ সেই মতে, বেদের প্রকৃত অর্থ আধ্যাত্মিক, কিন্তু গুহ্য ও গােপনীয় বলিয়া অনেক উপমা, সঙ্কেতশব্দ, বাহ্যিক যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের যােগ্য বাক্যসকল দ্বারা সেই অর্থ আবৃত ৷ আবরণ সাধারণের পক্ষে অভেদ্য, দীক্ষিত বৈদিকের পক্ষে পাতলা ও সত্যের সর্বাঙ্গপ্রকাশক বস্তু মাত্র ছিল ৷ উপমা ইত্যাদির পিছনে এই অর্থ খুঁজিতে হইবে ৷ দেবতাদের “গুপ্তনাম” ও স্ব স্ব প্রক্রিয়া, “গাে” “অশ্ব” “সােমরস” ইত্যাদি সঙ্কেতশব্দের অর্থ, দৈত্যদের কর্ম ও গুঢ় অর্থ, বেদের রূপক, myth ইত্যাদির তাৎপৰ্য্য জানিতে পারিলে সেই বেদের অর্থ মােটামুটি বােঝা যায় ৷ অবশ্য তাহার গূঢ় অর্থের প্রকৃত ও সূক্ষ্ম উপলব্ধি বিশেষ জ্ঞান ও সাধনার ফল, বিনা সাধনে কেবল বেদাধ্যয়নে হয় না ৷

এই সকল বেদতত্ত্ব বাঙ্গালী পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিতে ইচ্ছা রহিয়াছে ৷ আপাততঃ কেবল বেদের মুখ্য কথা সংক্ষেপে বলি ৷ সেই কথা এই: জগৎ ব্রহ্মময় কিন্তু ব্রহ্মতত্ত্ব মনের অজ্ঞেয় ৷ অগস্ত্য ঋষি বলিয়াছেন “তৎ অদ্ভূতং”, অর্থাৎ সকলের উপরে ও সকলের অতীত, কালাতীত ৷ আজও নহে, কল্য নহে, কে তাহা জানিতে পারিয়াছে? আর সকলের চৈতন্যে তাহার সঞ্চার, কিন্ত মন যদি নিকটে গিয়া নিরীক্ষণ করিবার চেষ্টা করে, তৎ অদৃশ্য হয় ৷ কেনােপনিষদের রূপকেরও এই অর্থ, ইন্দ্র ব্রহ্মের দিকে ধাবিত হন, নিকটে এলেই ব্ৰহ্ম অদৃশ্য ৷ তথাপি তৎ “দেবরূপে জ্ঞেয় ৷

দেবও “অদ্ভুত”, কিন্তু ত্রিধাতুতে প্রকাশিত – অর্থাৎ দেব সন্ময়, চিৎশক্তিময়, আনন্দময় ৷ আনন্দতত্ত্বে দেবকে লাভ করা যায় ৷ দেব নানারূপে, বিবিধ নামে জগৎকে ব্যাপ্ত করিয়া ও ধারণ করিয়া রহিয়াছে ৷ এই নামরূপ সকল বেদের দেবতাসকল ৷

বেদে বলে, প্রকাশ্য জগতের উপরে ও নিম্নে দুই সমুদ্র আছে ৷ নিম্ন অপ্রকেত “হৃদ্য” বা হৃৎসমুদ্র, ইংরাজিতে যাহাকে subconscient বলে, – উপরে সৎসমুদ্র, ইংরাজিতে যাহাকে superconscient বলে ৷ দুটীকে গুহা বা গুহ্যতত্ত্ব বলে ৷ ব্ৰহ্মণস্পতি অপ্রকেত হইতে বাক দ্বারা ব্যক্তকে প্রকাশ করেন, রুদ্র প্রাণতত্ত্বে প্রবিষ্ট হইয়া রুদ্রশক্তি দ্বারা বিকাশ করেন, উপরের দিকে জোর করিয়া তােলেন, ভীম তাড়নায় গন্তব্যপথে চালান, বিষ্ণু ব্যাপক শক্তি দ্বারা ধারণ করিয়া এই নিত্যগতির সৎসমুদ্র বা জীবনের সপ্ত নদীর গন্তব্যস্থল অবকাশ দেন ৷ অন্য সকল দেবতা এই গতির কর্মকারক, সহায়, উপায় ৷

সূৰ্য্য সত্যজ্যোতির দেবতা, সবিতা অর্থাৎ সৃজন করেন, ব্যক্ত করেন, পূষা অর্থাৎ পােষণ করেন, “সূৰ্য্য” অর্থাৎ অনৃতের অজ্ঞানের রাত্রী হইতে সত্যের জ্ঞানের আলােক জন্মাইয়া দেন ৷ অগ্নি চিৎশক্তির “তপঃ”, জগৎকে নির্মাণ করেন, জগতের সর্ববস্তুর ভিতরে রহিয়াছেন ৷ তিনি ভূতত্ত্বে অগ্নি, প্রাণতত্ত্বে কামনা ও ভােগপ্রেরণা, যাহা পান তাহা ভক্ষণ করেন, মনস্তত্বে চিন্তাময় প্রেরণা ও ইচ্ছাশক্তি, মনের অতীত তত্ত্বে জ্ঞানময় ক্রিয়াশক্তির অধীশ্বর ৷


[নির্বাচিত ঋকসূক্ত]

প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ১

মূল, অন্বয় ও ব্যাখ্যা

অগ্নিম্ ঈড়ে পুরােহিতং যজ্ঞস্য দেবম্ ঋত্বিজম্ ৷
হােতারং রত্নতমম্ ॥১॥

অগ্নিকে ভজনা করি যিনি যজ্ঞের দেব পুরােহিত, ঋত্বিক, হােতা এবং আনন্দ-ঐশ্বর্য্যের বিধানে শ্রেষ্ঠ ৷

ঈড়ে – ভজামি, প্রার্থয়ে, কাময়ে ৷ ভজনা করি ৷

পুরােহিতং – যে যজ্ঞে পুরঃ সম্মুখে স্থাপিত; যজমানের প্রতিনিধি ও যজ্ঞের সম্পাদক ৷

ঋত্বিজম্ – যে ঋতু অনুসারে অর্থাৎ যথার্থ কাল দেশ নিমিত্ত অনুসারে যজ্ঞ সম্পাদন করে ৷

হােতারং – যে দেবতাকে আহ্বান করিয়া হােম নিম্পাদন করে ৷

রত্নধা – সায়ণ রত্নের অর্থ রমণীয় ধন করিয়াছেন ৷ আনন্দময় ঐশ্বৰ্য্য বলিলে যথার্থ অর্থ হয় ৷

“ধা”র অর্থ যে ধারণ করে বা যে বিধান করে বা যে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করে ৷

অগ্নিঃ পূৰ্ব্বেভির ঋষিভির ঈড্যো নৃতনৈতর উত ৷
    স দেবা এহ বক্ষতি ॥২॥

যে অগ্নি পূর্ব ঋষিগণের ভজনীয় ছিলেন, তিনি নূতন ঋষিদেরও (উত) ভজনীয় ৷ কেননা তিনি দেবগণকে এই স্থানে আনয়ন করেন ৷ সে ভজনীয়ত্বের কারণ নির্দিষ্ট হইতেছে, ‘স’শব্দ সেই আভাস দেয় ৷ এহ বক্ষতি – ইহ আবহতি ৷ অগ্নি স্বরথে দেবতাদিগকে আনয়ন করেন ৷

অগ্নিনা রয়িম্ অশ্নবৎ পােষ এব দিবে দিবে ৷
    যশসং বীরবত্তমম্ ॥৩॥

রয়িং – রত্নর যে অর্থ, রয়িঃ, রাধঃ, রায়ঃ ইত্যাদির সেইই অর্থ ৷ তবে রত্ন শব্দে “আনন্দ” অর্থ অধিক প্রস্ফুট ৷

অশ্নবৎ – অণুয়াৎ ৷ প্রাপ্ত হয় বা ভােগ করে ৷

পােষম প্রভৃতি রয়ির বিশেষণ ৷ পােষং অর্থাৎ যে পুষ্ট হয়, যে বৃদ্ধি পায় ৷

যশসং – সায়ণ যশ শব্দের অর্থ কখন কীৰ্ত্তি কখন অন্ন করিয়াছেন ৷ আসল অর্থ বােধহয় যেন সাফল্য, লক্ষ্যস্থান প্রাপ্তি ইত্যাদি ৷ দীপ্তি অর্থও সঙ্গ এখানে তাহা খাটে না ৷

অগ্নে যং যজ্ঞম্ অধ্বরং বিশ্বতঃ পরিভূর অসি ৷
স ইদ দেবেষু গচ্ছতি ॥৪॥

যে অধ্বর যজ্ঞের সৰ্ব্বদিকে তুমি ঘিরিয়া প্রাদুর্ভুত, সেই যজ্ঞ দেবদের নিকট গমন করে ৷

অধ্বরং – ধৃ ধাতু অর্থ হিংসা করা ৷ সায়ণ “অহিংসিত যজ্ঞ” অর্থ করিয়াছেন ৷ কিন্তু “অধ্বর” শব্দ স্বয়ং যজ্ঞবাচক হইয়া গিয়াছে, – “অহিংসিত” শব্দের কখনও সেইরূপ পরিণাম অসম্ভব ৷ অধ্বর অর্থ পথ, অধ্বর পথগামী বা পথ-স্বরূপই হইবে ৷ যজ্ঞ দেবধাম গমনের পথ ছিল আবার যজ্ঞ দেবধামের পথিক বলিয়া সৰ্ব্বত্র খ্যাত ৷ এই অর্থ সঙ্গত ৷ অধ্বর যে অধ্বরার মত অধ ধাতু সম্ভুত, ইহার এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে অধ্ব ও অধ্বর দুইটীই আকাশ অর্থে ব্যবহৃত ছিল ৷

পরিভৃঃ – পরিতাে জাতঃ ৷

দেবেষু – সপ্তমী দ্বারা লক্ষ্যস্থান নির্দিষ্ট ৷

ইৎ – এব

অগ্নিহোতা কবিক্রতুঃ সত্যশ্চিত্রশ্রবস্তমঃ ৷
    দেবা দেবেভিরাগমৎ ॥৫॥

যদঙ্গ দাশুষে ত্বমগ্নে ভদ্রং করিষ্যসি ৷
    তবেৎ তৎ সত্যমঙ্গিরঃ ॥৬ ॥

উপ ত্বাগ্নে দিবে দিবে দোষাবস্তর্ধিয়া বয়ম্ ৷
    নমাে ভরন্ত এমসি ॥৭ ॥

রাজন্তমধ্বরাণাং গােপামৃতস্য দীদিবি ৷
    বর্ধমানং স্বে দমে ৷৮ ॥

স নঃ পিতেব সূনবেহগ্নে সূপায়নাে ভব ৷
    সচস্বা নঃ স্বস্তয়ে ॥৯॥


আধ্যাত্মিক অর্থের অনুবাদ

যিনি দেবতা হইয়া আমাদের যজ্ঞে কৰ্ম্মনিয়ামক পুরােহিত, কালজ্ঞ ঋত্বিক, হবিঃ ও আহ্বানের প্রাপক হােতা সাজেন এবং অশেষ আনশ্বৈৰ্য্য বিধান করেন, সেই তপােদেব অগ্নিকে ভজনা করি ৷ (১)

যেমন প্রাচীন ঋষিদের তেমনই আধুনিক সাধকদেরও এই তপােদেবতা ভজনার যােগ্য ৷ তিনিই দেবগণকে এই মর্ত্যলােকে আনয়ন করেন ৷ (২)

তপঃ-অগ্নি দ্বারাই মানুষ দিব্য ঐশ্বৰ্য্য প্রাপ্ত হয় ৷ এই ঐশ্বৰ্য্য অগ্নিবলে দিনদিন বর্ধিত, অগ্নিবলে বিজয়স্থলে অগ্রসর, অগ্নিবলে বহুল বীরশক্তিসম্পন্ন হয় ৷ (৩)

হে তপঃ-অগ্নি, যে দেবপথগামী যজ্ঞের সৰ্ব্বদিকে তােমার সত্তা অনুভূত হয়, সেই আত্মপ্রয়াসই দেবতার নিকট পহুঁচিয়া সিদ্ধ হয় ৷ (৪)

এই তপঃ-অগ্নি যিনি হােতা, যিনি সত্যময়, সত্যদৃষ্টিতে যাঁহার কৰ্ম্মশক্তি স্থাপিত, নানাবিধ জ্যোতির্ময় শ্রৌতজ্ঞানে যিনি ধনী, তিনিই দেববৃন্দকে লইয়া যজ্ঞে নামিয়া আসুন ৷ (৫)

হে তপঃ-অগ্নি, যে তােমাকে দেয়, তুমি যে তাহার শ্রেয়ঃ সৃষ্টি করিবেই, ইহাই তােমার সত্যসত্তার লক্ষণ ৷ (৬) ৷

অগ্নি, আমরা প্রতিদিন অহােরাত্রে তােমার নিকট বুদ্ধির চিন্তায় আত্মসমর্পণকে উপহারস্বরূপ বহন করিয়া আগত হই ৷ (৭)

দেবােনাখ সকল প্রয়াসের নিয়ামক, সত্যের দীপ্তিময় রক্ষক, যিনি স্বীয় ধামে সর্বদা বর্ধিত হইতেছেন, তাহারই নিকট আগত হই ৷ (৮)

যেমন পিতার সামীপ্য সন্তানের সুলভ, তুমিও সেইরূপ আমাদের নিকট সুলভ হও, দৃঢ়সঙ্গী হইয়া কল্যাণগতি সাধিত কর ৷ (৯)


[বিকল্প অনুবাদ]

তপােদেবতা অগ্নিকে আমি কামনা করি আমার যজ্ঞের যিনি পুরােহিত ও ঋত্বিক, আমার যজ্ঞের যিনি হােতা, প্রভূত আনন্দ যাঁহার দান ৷ (১)

তপােদেবতাই পুরাতন ঋষিদের কাম্য ছিলেন, তিনিই নবীনদের কাম্য ৷ তিনিই এই পৃথিবীতে দেবসংঘকে বহন করিয়া আসেন ৷ (২)

তপােদেব অগ্নি দ্বারা মানুষ সেই বৈভব ভােগ করে যাহার দিনদিন বৃদ্ধি যে যশস্বী যে বীরশক্তিতে ভরা ৷ (৩)

হে অগ্নি তপােদেবতা, যে পথযাত্রী যজ্ঞের চারিদিকে তুমি তােমার সত্তায় পরিবেষ্টন কর, সেই কৰ্ম্মই দেবমণ্ডলে পহুঁচিয়া লক্ষ্যস্থানে উপস্থিত হয় ৷ (৪)

তপােদেবতা অগ্নি আমাদের যজ্ঞের হােতা সত্য কবিকৰ্মা বিচিত্র ভিন্ন স্তুতির শ্রোতা ৷ দেবতা, অন্যসকল দেবতাদের লইয়া আমাদের নিকটে আসেন ৷ (৫)

হে অঙ্গিরা অগ্নি, যজ্ঞদাতার জন্যে তুমি যে পরম আনন্দ ও কল্যাণ সৃষ্টি করিবে, সেটাই সেই পরম সত্য ৷ (৬)

অগ্নি তপােদেবতা, আমরা প্রতিদিন দিনে রাত্রে তােমার কাছে চিন্তায় মনের নতি ভরিয়া বহন করিয়া আসি ৷ (৭)

তুমি দেবযাত্রী রাজাস্বরূপ সত্যের গােপ্তা স্বভবনে সর্বদা বর্ধিত হইয়া স্বদীপ্তি প্রকাশ কর ৷ (৮)

পিতা যেমন তাঁহার পুত্রের তুমিও আমাদের সহজগম্য হও ৷ আমাদের স্বস্তি দিতে লাগিয়া থাক ৷ (৯)


ব্যাখ্যা

বিশ্বযজ্ঞ

বিশ্বজীবন একটী বৃহৎ যজ্ঞস্বরূপ ৷ যজ্ঞের দেবতা স্বয়ং ভগবান, প্রকৃতি যজ্ঞদাতা ৷ ভগবান শিব, প্রকৃতি উমা, উমার হৃদয়ের অন্তরে শিবরূপকে ধারণ করিয়া প্রত্যক্ষ শিবরূপ হারা, প্রত্যক্ষ শিবরূপকে পাইবার জন্য সৰ্ব্বদা লালায়িত ৷ এই লালসা বিশ্বজীবনের নিগূঢ় অর্থ ৷

কিন্তু কি উপায়ে সফলমনােরথ হয়? নিজ স্বরূপে পহুচিয়া পুরুষােত্তমের স্বরূপকে পাইবার কি কৌশল বিধেয়, কোন্ পথ প্রকৃতির নির্দিষ্ট? চক্ষে অজ্ঞানের আবরণ, চরণে স্কুলের সহস্র নিগড় ৷ স্থূলসত্তা অনন্ত সৎকেও যেন সান্তে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, নিজেও যেন বন্দী হইয়া পড়িয়াছে, স্বয়ংগঠিত এই কারাগৃহের হারান চাবি আর হাতের কাছে পায় না ৷ জড়-প্রাণশক্তির অবশ সঞ্চারে অনন্ত উন্মুক্ত চিৎশক্তি যেন বিমূঢ়, নিলীন অচেতন হইয়া পড়িয়াছে ৷ অনন্ত আনন্দ যেন তুচ্ছ সুখদুঃখের অধীন প্রাকৃত চৈতন্য সাজিয়া ছদ্মবেশে বেড়াইতে বেড়াইতে নিজ স্বরূপ ভুলিয়া গিয়াছে, আর তাঁহাকে খুঁজিয়া পায় না, খুঁজিতে খুঁজিতে আরও দুঃখের অসীম পঙ্কে নিমজ্জিত হইতে যায় ৷ সত্য যেন অনৃতের দ্বিধাময় তরঙ্গে ডবিয়া গিয়াছে ৷ মানসাতীত বিজ্ঞানতত্ত্বে অনন্ত সত্যের প্রতিষ্ঠাস্থল, বিজ্ঞানতত্ত্বের ক্রীড়া পার্থিব চৈতন্যে হয় নিষিদ্ধ নয় স্বল্প ও বিরল, যেন আড়াল হইতে ক্ষণিক বিদ্যুতের ভগ্ন উন্মেষ মাত্র ৷ এখানে শুধু সত্যানৃতে দোলায়মান ভীরু খোঁড়া মূঢ় মানসতত্ত্ব ঘুরিয়া ফিরিয়া সত্যকে অন্বেষণ করিতেছে, পাইয়াও আবার হারায়, একমুহূৰ্ত্ত সত্যের একদিক ধরিয়া রাখিতে পারিলে অন্যদিক ধরিতে গিয়াই প্রথমটী হাত হইতে খসিয়া যায় ৷ মানসতত্ত্ব বিপুল প্রয়াসে সত্যের আভাস বা সত্যের ভগ্নাংশ পাইতে পারে, কিন্তু সত্যের পূর্ণ ও প্রকৃত জ্যোতির্ময় অনন্ত রূপ তাহার হস্তের ইয়ত্তার অতীত ৷ যেমনই জ্ঞানে, তেমনই কৰ্ম্মেও সেই বিরােধ, সেই অভাব, সেই বৈফল্য ৷ সহজ সত্যকৰ্ম্মের হাস্যময় দেবনৃত্যের স্থানে প্রাকৃত ইচ্ছাশক্তির নিগড়বদ্ধ চেষ্টা সত্য অসত্য পাপ পুণ্য বৈধ অবৈধ কর্ম অকৰ্ম্ম বিকৰ্ম্মের জটিলপাশে বৃথা ছটফট করিতেছে ৷ বাসনাহীন বৈফল্যহীন আনন্দময় প্রেমময় ঐক্যরসমত্তা ভাগবতী ক্রিয়াশক্তির গতি সর্বদা মুক্ত অকুণ্ঠিত ও অঙ্খলিত ৷ সেই স্বাভাবিক সহজ বিশ্বময় সঞ্চরণ প্রাকৃত ইচ্ছাশক্তির অসম্ভব ৷ এইরূপে সান্তের অনৃত ফাদে পড়া এই পার্থিব প্রকৃতির সেই অনন্ত সত্তা, অনন্ত চিৎশক্তি, অনন্ত আনন্দচৈতন্য লাভ করিবার কি বা আশা কি বা উপায়?

যজ্ঞই উপায় ৷ যজ্ঞের অর্থ আত্মসমর্পণ, আত্মবলিদান ৷ যাহা তুমি আছ, যাহা তােমার আছে, যাহা ভবিষ্যতে স্বচেষ্টায় বা দেবকৃপায় হইতে পার, যাহা কিছু কৰ্ম্মপ্রবাহে অৰ্জ্জন বা সঞ্চয় করিতে পার, সবই সেই অমৃতময়ের উদ্দেশ্যে হবিঃরূপে তপঃ অগ্নিতে ঢাল ৷ ক্ষুদ্ৰ সৰ্বস্ব দানে অনন্ত সৰ্বস্ব লাভ করিবে ৷ যজ্ঞে যােগ নিহিত ৷ যােগে আনন্ত্য অমরত্ব ও পরমতত্ত্বের পরমানন্দ প্রাপ্তি বিহিত ৷ ইহাই প্রকৃতির উদ্ধারের পথ ৷

জগতী দেবী সেই রহস্য জানেন ৷ সেই বিপুল আশায় তিনি সর্বদা অনিদ্রিত অশ্রান্ত, রাতদিন মাস পরে মাস বৎসর পরে বৎসর যুগ পরে যুগ যজ্ঞই করিতেছেন ৷ আমাদের সমস্ত কৰ্ম্ম, সমস্ত চেষ্টা, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত দ্বেষ ভ্ৰম, সুখদুঃখ এই বিশ্বযজ্ঞের অঙ্গমাত্র ৷ জগতী দেবী স্থল সৃষ্টি করিয়া বিশ্বময় অগ্নির জঠরে ঢালিয়া দিয়াছেন, পেয়েছেন বদলে প্রাণশক্তির খেলা জীবে উদ্ভিদে, ধাতুতে ৷ কিন্তু প্রাণশক্তি প্রকৃতির স্বরূপ নহে, প্রাণময় পুরুষ পুরুষােত্তম নহেন ৷ জগতী দেবী জগতের সকল প্রাণী ও তাহাদের সকল চেষ্টা বৈশ্বানর অগ্নির ক্ষুধিত জঠরে ঢালিয়া দিয়াছেন, পেয়েছেন বদলে মনঃশক্তির খেলা পশুতে, পক্ষীতে, মনুষ্যে ৷ কিন্তু মনঃশক্তিও প্রকৃতির স্বরূপ নহে, মনােময় পুরুষ পুরুষােত্তম নহেন ৷ জগতী দেবী জগতের সকল প্রেমদ্বেষ, হর্ষদুঃখ, সুখবেদনা, পাপপুণ্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, চেষ্টা-আবিষ্কার, মতিমনীষাবুদ্ধি বিশ্বমানব অগ্নির অনন্ত জঠরে ঢালিয়া দিয়াছেন, পাইবেন বদলে বিজ্ঞান তত্ত্বের উন্মক্ত দ্বার, অনন্ত সত্যের পন্থা, বিশ্ব-পৰ্ব্বতের আনন্দ চূড়ায় আরােহণ, অনন্ত ধামে অনন্ত পুরুষােত্তমের আলিঙ্গন ৷

পাইবেন, কিন্তু এখনও পান নাই ৷ ক্ষীণ আশার রেখামাত্র কাল-গগনে দেখা দিয়াছে ৷ অতএব অনবরত যজ্ঞ চলিতেছে, দেবী যাহাই উৎপাদন করিতে পারিয়াছেন, তাহাই বলি দিতেছেন ৷ তিনি জানেন সকলের ভিতরে সেই লীলাময় অকুণ্ঠিত মনে লীলার রসাস্বাদন করিতেছেন, যজ্ঞ বলিয়া সকলের চেষ্টা সকল তপস্যা গ্রহণ করিতেছেন ৷ তিনিই বিশ্বযজ্ঞকে আস্তে আস্তে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাঁকিয়া বাঁকিয়া উত্থানে পতনে জ্ঞানে অজ্ঞানে জীবনে মৃত্যুতে নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট গন্তব্যধামের দিকে সর্বদাই অগ্রসর করিতেছেন ৷ তাহার ভরসায় প্রকৃতি দেবী নির্ভীক অকুণ্ঠিত বিচারহীন ৷ সর্বত্রই সৰ্ব্বদাই ভাগবতী প্রেরণা বুঝিয়া সৃজন ও হনন, উৎপাদন ও বিনাশ, জ্ঞান ও অজ্ঞান সুখদুঃখ পাপপুণ্য পক অপক্ক কুৎসিত সুন্দর পবিত্র অপবিত্র যাহা হাতে পান, সবই সেই বৃহৎ চিরন্তন হােমকুণ্ডে নিক্ষেপ করিতেছেন ৷ স্থূল সূক্ষ্ম যজ্ঞের হবিঃ, জীব যজ্ঞের বদ্ধ পশু ৷ যজ্ঞের মনপ্রাণদেহরূপ ত্রিবন্ধনযুক্ত যূপকাষ্ঠে জীবকে বাঁধিয়া রাখিয়া প্রকৃতি তাহাকে অহরহ বলি দিতেছেন ৷ মনের বন্ধন অজ্ঞান, প্রাণের বন্ধন দুঃখ বাসনা ও বিরােধ, দেহের বন্ধন মৃত্যু ৷

প্রকৃতির উপায় নির্দিষ্ট হইল, এই বদ্ধ জীবের কি উপায় হইবে? তাহার নিস্তার না হইলে প্রকৃতিরও উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, সেজন্য উপায় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটী কি? উপায় যজ্ঞ, আত্মদান, আতুবলি ৷ তবে প্রকতির অধীন না হইয়া, স্বয়ং উঠিয়া দাড়াইয়া যজমান সাজিয়া সৰ্বস্ব দিতে হইবে ৷ ইহাই বিশ্বের নিগূঢ় রহস্য যে পুরুষই যেমন যজ্ঞের দেবতা, পুরুষও যজ্ঞের পশু ৷ জীবই পশুরূপ পুরুষ ৷ পুরুষ নিজ শরীর-মন-প্রাণ বলিরূপে যজ্ঞের প্রধান উপায়রূপে প্রকৃতির হাতে সমর্পণ করিয়াছেন ৷ তাহার আত্মদানের এই গুপ্ত উদ্দেশ্য নিহিত রহিয়াছে যে একদিন চৈতন্য প্রাপ্ত হইয়া প্রকৃতিকে নিজ হাতে লইয়া, প্রকৃতিকে তাহারা ইচ্ছার বশীভূত দাসী প্রণয়িনী ও যজ্ঞের সহধর্মিণী করিয়া স্বয়ং নির্দোষ যজ্ঞ সম্পাদন করিবেন ৷ এই গুপ্ত কামনা পূরণার্থে নরের সৃষ্টি ৷ পুরুষােত্তম নরমূৰ্ত্তিতে সেই লীলা করিতে চান ৷ আত্মস্বরূপ, অমরত্ব, সনাতন আনন্দের বিচিত্র আস্বাদন, অনন্ত জ্ঞান, অবাধ শক্তি, অনন্ত প্রেম নরদেহে নরচৈতন্যে ভােগ করিতে হইবে ৷ সকল আনন্দ পুরুষােত্তমের মধ্যে আছেই ৷ পুরুষ নিজের মধ্যে সনাতনরূপে সনাতনভােগ সৰ্ব্বদা করিতেছেন, তাহার উপর মানবকে সৃষ্টি করিয়া বহুতে একত্ব, সান্তে অনন্ত, বাহ্যেতে আন্তরিকতা, ইন্দ্রিয়ে অতীন্দ্রিয়, পার্থিবে অমরলােকত্ব, এই বিপরীত রসগ্রহণে তিনি তৎপর ৷ প্রথমে দুটীর মধ্যে অবিদ্যায় ভেদ সৃজন করিয়া ভােগ করিবার ইচ্ছা, পরে অবিদ্যাকে বিদ্যার আর বিদ্যাকে অবিদ্যার আলিঙ্গনে জড়াইয়া একত্বে দ্বিবিধত্ব বজায় রাখিয়া এক আধারে যুগপৎ সম্ভোগে দুইটী ভগিনীর পূর্ণ ভােগ করিবেন ৷ জাগরণের দিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যেই মনের উপরে বুদ্ধির ওপারে গুপ্ত সত্যময় বিজ্ঞানতত্ত্বে বসিয়া, আবার আমাদের মধ্যেই হৃদয়ের নীচে চিত্তের যে গুপ্ত স্তর, যেখানে হৃদয়গুহা, যেখানে নিহিত গুহ্য চৈতন্য-সমুদ্র, হৃদয় মন প্রাণ দেহ অহঙ্কার যে সমুদ্রের ক্ষুদ্র তরঙ্গ মাত্র, সেইখানেও বসিয়া এই পুরুষ প্রকৃতির অন্ধ প্রয়াস, অন্ধ অন্বেষণ দ্বন্দ্ব প্রতিঘাতে ঐক্যস্থাপনের চেষ্টায় নানা রসাস্বাদন অনুভব করিতেছেন ৷ উপরে সজ্ঞানে ভােগ, নিম্নে অজ্ঞানে ভােগ, এইরূপে দুইটাই যুগপৎ চলিতেছে ৷ কিন্তু চিরদিন এই অবস্থায় মগ্ন হইলে তাহার নিগুঢ় প্রত্যাশা, তাহার চরম অভিসন্ধি সিদ্ধ হয় না ৷এইজন্য প্রত্যেক মানুষের জাগরণের দিন বিহিত ৷ অন্তঃস্থ দেবতা একদিন অবশ পুণ্যহীন প্রাকৃত আত্মবলি ত্যাগ করিয়া সজ্ঞান সমন্ত্র যজ্ঞ আরম্ভ করিবেন; সকল প্রাণীমাত্রের পক্ষে ইহা অবধারিত ৷

এই সজ্ঞান সমন্ত্র যজ্ঞ বেদোক্ত কৰ্ম্ম ৷ তাহার উদ্দেশ্য দ্বিবিধ, বিশ্বময় বহুত্বে সম্পূর্ণতা – যাহাকে বেদে বৈশ্বদেব্য ও বৈশ্বানরত্ব বলে, আর তাহার সহিত একাত্মক পরমদেবসত্তায় অমরত্বলাভ ৷ যখন বৈশ্বদেব্য বলি, ইহা বুঝিবেন যে বেদোক্ত দেবগণ অর্বাচীন সাধারণের হেয় ইন্দ্র অগ্নি বরুণ নামক ক্ষুদ্র দেবতা নন ৷ ইহারা ভগবানের জ্যোতিৰ্ম্ময় শক্তিধর নানা মূৰ্ত্তি ৷ আর এই অমরত্ব পুরাণােক্ত তুচ্ছ স্বর্গ নয় ৷ বৈদিক ঋষিদের অভিলষিত স্বর্লোক জন্ম মৃত্যুর ওধারে পরমধাম অনন্তলােকের প্রতিষ্ঠা, বেদোক্ত অমরত্ব সচ্চিদানন্দের অনন্ত সত্তা ও চৈতন্য ৷ মানবের ভিতরে দেবত্ব জাগরণ, মানবাধারে সকল দেবতার গঠন, সেই দেবতাগণের একীভূত বহুত্বকে স্বপ্রতিষ্ঠা করিয়া পরম দেবতত্ত্বের সত্তায় চরম আরােহণ ও সেই জগৎবন্ধু গােপালের1 ক্রোড়ে নির্মল আনন্দের ক্রীড়া, ইহাই বেদোক্ত যজ্ঞের উদ্দেশ্য ৷


তপােদেব অগ্নি

এই যজ্ঞে জীবই যজমান, গৃহস্বামী, জীবের প্রকৃতি গৃহপত্নী, যজমানের সহধর্মিণী, কিন্তু পুরোহিত কে হইবে? জীব যদি স্বয়ং স্বযজ্ঞের পৌরােহিত্য সম্পাদন করিতে যায়, যজ্ঞ সচারুরূপে পরিচালিত হইবার আশা নাই-ই বলা যায়; কারণ জীব অহঙ্কার দ্বারা চালিত, মানসিক প্রাণিক ও দৈহিক ত্রিবিধ বন্ধনে জড়িত ৷ এই অবস্থায় স্বপৌরােহিত্য গ্রহণ করায় অহঙ্কারই হােতা ঋত্বিক এমন কি যজ্ঞের দেবতা সাজে, তাহা হইলে অবৈধ যজ্ঞবিধানে মহৎ অনর্থ ঘটিবার আশঙ্কা ৷ প্রথমে নিতান্ত বদ্ধ অবস্থা হইতে সে মুক্তি চায় ৷ আর যদি বন্ধনমুক্ত হইতে হয়, স্বশক্তি ভিন্ন অন্য শক্তির আশ্রয় লইতেই হইবে ৷ ত্রিবিধ ঘূপরঙ্গুর শিথিলীকরণের পরেও যজ্ঞ চালাইবার মত নির্দোষ জ্ঞান ও শক্তি হঠাৎ প্রাদুর্ভূত বা সত্বরে সুগঠিত হয় না ৷ দিব্য জ্ঞান ও দিব্য শক্তির প্রয়ােজন, তাহার যজ্ঞ দ্বারাই আবির্ভাব ও সুগঠন সম্ভব ৷ আর জীব মুক্ত হইলেও, দিব্যজ্ঞানী ও দিব্যশক্তিমান হইলেও যজ্ঞের ভর্তা অনুমন্তা ঈশ্বরও যজ্ঞফলের ভােক্তা হয়, কিন্তু কর্মকর্তা হয় না ৷ দেবতাকেই পুরােহিতরূপে বরণ করিয়া বেদীর উপরে সংস্থাপিত করিতে হইবে ৷ দেবতা স্বয়ং মানবহৃদয়ে প্রবিষ্ট প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পৰ্য্যন্ত মানবের পক্ষে দেবত্ব ও অমরত্ব অসাধ্য ৷ সত্য বটে দেবতা জাগ্রত হওয়ার আগে সেই বােধনাৰ্থে মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ যজমানের পৌরােহিত্য স্বীকার করেন, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র সুদাস সদস্যু ও ভরতপুত্রের হােতা হন ৷ কিন্তু দেবতাকে আহ্বান করিয়া বেদীর উপরে পুরােহিত ও হােতার স্থান দিবার জন্যেই সেই মন্ত্র প্রয়ােগ ও হবিঃ প্রয়ােগ ৷ দেবতা অন্তরে জাগ্রত না হইলে কেহ জীবকে তরণ করিতে পারে না ৷ দেবতাই ত্ৰাণকৰ্ত্তা, দেবতাই যজ্ঞের একমাত্র সিদ্ধিদাতা পুরােহিত ৷

দেবতা যখন পুরােহিত হন, তখন তাহার নাম অগ্নি, তঁাহার রূপও অগ্নিরূপ ৷ অগ্নির পৌরােহিত্য সৰ্বাঙ্গসুন্দর সকল যজ্ঞের মুখ্য উপায় ও প্রারম্ভ ৷ এইজন্যই ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথম সুক্তের প্রথম ঋকে অগ্নির পৌরােহিত্য নির্দিষ্ট করা হইয়াছে ৷

এই অগ্নি কে? অগ ধাতুর অর্থ শক্তি, যিনি শক্তিমান তিনি অগ্নি ৷ আবার অগ ধাতুর অর্থ আলােক বা জ্বালা, যে শক্তি জ্বলন্ত জ্ঞানের আলােকে উদ্ভাসিত, জ্ঞানের কৰ্ম্মবলস্বরূপ, সেই শক্তির শক্তিধর অগ্নি ৷ আবার অগ ধাতুর অন্য অর্থ পূৰ্ব্বত্ব ও প্রধানত্ব, যে জ্ঞানময় শক্তি জগতের আদিতত্ত্ব হইয়া জগতের অভিব্যক্ত সকল শক্তির মূল ও প্রধান, সেই শক্তির শক্তিধর অগ্নি ৷ আবার অগ ধাতুর অর্থ নয়ন, জগদি সনাতন পুরাতন প্রধান শক্তির যে শক্তিধর জগৎকে নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট গন্তব্যধামের দিকে লইয়া অগ্রসর হইতেছেন, যে কুমার দেবসেনার সেনানী, যিনি পথে প্রদর্শক, যিনি প্রকৃতির নানা শক্তিকে জ্ঞানে বলে স্ব স্ব ব্যাপারে প্রবর্তিত করিয়া সুপথে চালিত করেন, সেই শক্তিধর অগ্নি ৷ বেদের শত শত সূক্তে অগ্নির এই সকল গুণ ব্যক্ত ও স্তৃত হইয়াছে ৷ জগতের আদি, জগতের প্রত্যেক স্ফুরণে নিহিত, সকল শক্তির মূল ও প্রধান, সকল দেবতার আধার, সকল ধৰ্ম্মের নিয়ামক, জগতের নিগুঢ় উদ্দেশ্য ও নিগুঢ় সত্যের রক্ষক এই অগ্নি আর কিছুই নন, ভগবানের ওজঃ-তেজঃ-ভ্রাজঃ-স্বরূপ সৰ্ব্বজ্ঞানমণ্ডিত পরম-জ্ঞানাত্মক তপঃ-শক্তি ৷

সচ্চিদানন্দের সত্তত্ত্ব চিন্ময় ৷ এই যে সতের চিৎ, সেই আবার সতের শক্তি ৷ চিৎশক্তিই জগতের আধার, চিৎশক্তিই জগতের আদিকরণ ও স্রষ্টা, চিৎশক্তিই জগতের নিয়ামক ও প্রাণস্বরূপ ৷ চিন্ময়ী যখন সৎপুরুষের বক্ষস্থলে মুখ লুকাইয়া স্তিমিতলােচনে কেবল সতের স্বরূপ চিন্তা করেন, তখন অনন্ত চিৎশক্তি নিস্তব্ধ হয়, সেই অবস্থা প্রলয় অবস্থা, নিস্তব্ধ আনন্দসাগরস্বরূপ ৷ আবার যখন চিন্ময়ী মুখ তুলিয়া নয়ন উন্মীলন করিয়া সৎপুরুষের মুখ ও তনু সপ্রেমে দেখেন, সৎপুরুষের অনন্ত নাম ও রূপ ধ্যান করেন, কৃত্রিম বিচ্ছেদমিলনজনিত সম্ভোগের লীলা স্মরণ করেন, তখন সেই আনন্দের অজস্র প্রবাহ তাহার উন্মত্ত বিক্ষোভ বিশ্বানন্দের অনন্ত তরঙ্গ সৃষ্টি করে ৷ চিৎশক্তির এই নানা ধ্যান এই একমুখী অথচ বহুমুখী সমাধিই তপঃশক্তির নামে অভিহিত ৷ সৎপুরুষ যখন তাহার চিৎশক্তিকে কোনও নামরূপসৃজন, কোনও তত্ত্ববিকাশ, কোনও অবস্থাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে সং-গৃহীত, সঞ্চালিত, স্ববিষয়ের উপর সংস্থাপিত করেন, তখন তপঃশক্তির প্রয়ােগ হয় ৷ এই তপঃপ্রয়ােগই যােগেশ্বরের যােগ ৷ ইহাকেই ইংরাজীতে Divine will বা Cosmic will বলে ৷ এই Divine will বা তপঃশক্তি দ্বারা জগৎ সৃষ্ট, চালিত, রক্ষিত হয় ৷ অগ্নিই এই তপঃ ৷

চিৎশক্তির দুই দিক দেখি, চিন্ময় ও তপােময়, সৰ্ব্বজ্ঞানস্বরূপ ও সর্বশক্তি-স্বরূপ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দুইটাই এক ৷ ভগবানের জ্ঞান সৰ্ব্বশক্তিময়, তাহার শক্তি সৰ্ব্বজ্ঞানময় ৷ তিনি আলােকজ্ঞান করিলেই আলােক সৃষ্টি অনিবাৰ্য্য: কারণ তাহার জ্ঞান তাহার শক্তির চিন্ময় স্বরূপ মাত্র ৷ আবার জগতের যে কোন জড়স্পন্দনেও, যেমন অণর নৃত্যে বা বিদ্যুতের লম্ফনে জ্ঞান নিহিত, কারণ তাঁহার শক্তি হার জ্ঞানের স্ফুরণ মাত্র ৷ কেবল আমাদের মধ্যে অবিদ্যার ভেদবুদ্ধিতে অপরাপ্রকৃতির ভেদগতিতে জ্ঞান ও শক্তি বিভিন্ন অসম ও পরস্পরে যেন কলহ-প্রিয় বা অমিলে ক্লিষ্ট ও খৰ্ব্বীকৃত হইয়া পড়িয়াছে অথবা ক্রীড়ার্থে সেইরূপ অসমতা ও কন্দলের ঢং করে ৷ প্রকৃতপক্ষে জগতের ক্ষুদ্রতম কৰ্ম্ম বা সঞ্চারে ভগবানের সৰ্ব্বজ্ঞান ও সৰ্ব্বশক্তি নিহিত, ইহার ব্যতিরেকে বা ইহার কমেতে সে কৰ্ম্ম বা সঞ্চার ঘটাইবার কাহারও শক্তি নাই ৷ যেমন ঋষির বেদবাক্যে বা শক্তিধর মহাপুরুষের যুগপ্রবর্তনে, তেমনি মূখের নিরর্থক বাচালতায় বা আক্রান্ত ৷ ক্ষুদ্র কীটের ছটফটানিতে এই সৰ্ব্বজ্ঞান ও সর্বশক্তি প্রযুক্ত হয় ৷ তুমি আমি যখন জ্ঞানের অভাবে শক্তির অপচয় করি বা শক্তির অভাবে জ্ঞানের নিষ্ফল প্রয়ােগ করি, সৰ্ব্বজ্ঞানী সৰ্বশক্তিমান আড়ালে বসিয়া সেই শক্তিপ্রয়ােগকে তাহার জ্ঞান দ্বারা, সেই জ্ঞানপ্রয়ােগকে তঁাহার শক্তি দ্বারা সামলান ও চালান বলিয়া সেই ক্ষুদ্র চেষ্টায় জগতে একটা কিছু হয় ৷ নির্দিষ্ট কৰ্ম্ম হইয়া উঠিল, তাহার উচিত কৰ্ম্মফলও সাধিত হইল ৷ ইহাতে আমার তােমার অজ্ঞ মনােরথ ও প্রত্যাশা ব্যর্থ হইল বটে, কিন্তু সেই বৈফল্যেই তাহার গূঢ় অভিসন্ধি সাধিত হয় এবং সেই বৈফল্যেই আমাদের কোনও ছদ্মবেশী কল্যাণ ও জগতের মহান উদ্দেশ্যের এক ক্ষুদ্রতম অংশের ক্ষুদ্র আংশিক অথচ অত্যাবশ্যক উপকার সিদ্ধ হয় ৷ অশুভ, অজ্ঞান ও বৈফল্য ছদ্মবেশ মাত্র ৷ অশুভে শুভ, অজ্ঞানে জ্ঞান, বৈফল্যে সিদ্ধি ও শক্তি গুপ্ত হইয়া অপ্রত্যাশিত কৰ্ম্ম সম্পাদন করে ৷ তপঃ-অগ্নির নিগূঢ় অবস্থিতি ইহার কারণ ৷ এই অনিবাৰ্য শুভ, এই অখণ্ডনীয় জ্ঞান, এই অবিথ শক্তি ভগবানের অগ্নিরূপ ৷ যেমন সৎপুরুষের চিৎ ও তপঃ এক, যেমন দুইটাই আনন্দেরই স্পন্দন, সেইরূপে তাহার প্রতিনিধিস্বরূপ এই অগ্নিতে জ্ঞান ও শক্তি অবিচ্ছিন্ন এবং দুইটীই শুভ ও কল্যাণকর ৷

জগতের বাহিরের আকৃতি অন্যরূপ, সেখানে অনৃত, অজ্ঞান, অশুভ, বৈফল্যই প্রধান ৷ অথচ এই ছেলেকে ভয় দেখান মুখােসের ভিতরে মাতৃমুখ লুক্কায়িত ৷ এই অচেতন, এই জড়, এই নিরানন্দ ভেল্কী মাত্র, ভিতরে জগৎপিতা জগন্মাতা জগতাত্মা সচ্চিদানন্দ আসীন ৷ এইজন্য বেদে আমাদের সাধারণ চৈতন্য রাত্রী নামে অভিহিত ৷ আমাদের মনের চরম বিকাশও জ্যোৎস্না-পুলকিত তারানক্ষত্র-মণ্ডিত ভগবতী রাত্রীর বিহার মাত্র ৷ কিন্তু এই রাত্রীর কোলে তাহার ভগিনী দৈবী উষা অনন্তপ্রসূত ভাবী দিব্যজ্ঞানের আলােক লইয়া লুক্কায়িত ৷ পার্থিব চৈতন্যের এই রাত্রীতেও তপঃ-অগ্নি পুনঃ পুনঃ জাজ্বল্যমান হইয়া উষার আভাতে আলােকবিস্তার করেন ৷ তপঃ-অগ্নিই অন্ধ জগতে সত্যচৈতন্যময়ী উষার জন্ম-মুহুৰ্ত্ত প্রস্তুত করিতেছেন ৷ পরম দেবতা এই তপঃ-অগ্নিকে জগতে প্রেরণ ও স্থাপন করিয়াছেন, প্রত্যেক পদার্থ ও জীবজন্তুর অন্তরে নিহিত হইয়া বিশ্বের সমস্ত গতিকে অগ্নিই নিয়মন করিতেছেন ৷ ক্ষণিক অনৃতের মধ্যে সেই অগ্নিই চিরন্তন সত্যের রক্ষক, অচেতনে ও জড়ে অগ্নিই অচেতনের নিগুঢ় চৈতন্য, জড়ের প্রচণ্ড গতি ও শক্তি ৷ অজ্ঞানের আবরণে অগ্নিই ভগবানের গূঢ় জ্ঞান, পাপের বৈরাপ্যে অগ্নিই তাহার সনাতন অকলঙ্ক শুদ্ধতা, দুঃখদৈন্যের বিমর্ষ কুয়াশায় অগ্নিই তাহার জ্বলন্ত বিশ্বভােগী আনন্দ, দুর্বলতা ও জড়তার মলিন বেশে অগ্নিই তাহার সৰ্বাহক সৰ্ব্বকৰ্ম্ম-বিশারদ ক্রিয়াশক্তি ৷ একবার এই কৃষ্ণ আবরণ ভেদ করিয়া যদি অগ্নিকে আমাদের অন্তরে প্রজ্বলিত প্রকাশিত উন্মুক্ত ও ঊর্ধ্বগামী করিতে পারি, তিনিই দৈবী উষাকে মানবচৈতন্যে আনিয়া দেবগণকে ভিতরে জাগাইয়া অনৃত অজ্ঞান নিরানন্দ বৈফল্যের কৃষ্ণ আবরণকে সরাইয়া আমাদিগকে অমর ও দেবভাবাপন্ন করিয়া তুলিবেন ৷ অগ্নিই অন্তঃস্থ দেবতার প্রথম ও প্রধান জাগ্রত রূপ ৷ তাঁহাকে হৃদয়বেদীতে প্রজ্বলিত করিয়া পৌরােহিত্যে বরণ করি ৷ তঁাহার সর্বপ্রকাশক জ্বালা জ্ঞান, তঁাহার সৰ্ব্বদাহক ও পাবক জ্বালা শক্তি ৷ সেই জ্ঞানময় শক্তিময় জ্বলন্ত আগুনে আমাদের এই সকল তুচ্ছ সুখদুঃখ, এই সকল ক্ষুদ্র পরিমিত চেষ্টা ও বৈফল্য, এই সমুদায় মিথ্যা ও মৃত্যু সমর্পিত করি ৷ পুরাতন ও অনৃত ভস্মীভূত হৌক, নুতন ও সত্য জাজ্বল্যমান সাবিত্রীরূপে গগনস্পর্শী ৷ তপঃ-অগ্নি হইতে আবির্ভূত হইবে ৷

ভুলিও না যে সকলই আমাদের অন্তরে, মানবের ভিতরেই অগ্নি, ভিতরেই বেদী, হবিঃ ও হােতা, ভিতরেই ঋষি মন্ত্র ও দেবতা, ভিতরেই ব্রহ্মের বেদগান, ভিতরেই ব্রহ্মদ্বেষী রাক্ষস ও দেবদ্বেষী দৈত্য, ভিতরেই বৃত্র ও বৃহন্তা, ভিতরেই দেবদৈত্য যুদ্ধ, ভিতরেই বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র অঙ্গিরা অত্রি ভৃগু অথৰ্ব্বা সুদাস এস-দস্যু দাসজাতি ও পঞ্চবিধ ব্রহ্মান্বেষী আৰ্য্যগণ ৷ মানবের আত্মা ও জগৎ এক ৷ তাহার ভিতরেই দূর ও নিকট, দশ দিক, দুই সমুদ্র, সপ্ত নদী, সপ্ত ভুবন ৷ দুই গুপ্ত সমুদ্রের মাঝখানে আমাদের এই পার্থিব জীবন প্রকাশিত ৷ নিম্নর সমুদ্র সেই গুহ্য অনন্ত চৈতন্য যাহা হইতে এই সমুদায় ভাব ও বৃত্তি, নাম ও রূপ অহরহঃ ও মুহূর্তে মুহূর্তে প্রাদুর্ভূত হয়, যেমন ভগবতী রাত্রীর কোলে তারা নক্ষত্র প্রস্ফুটিত হয় ৷ ইহাকে আধুনিক ভাষায় অচেতন (inconscient) বা অচেতন-চৈতন্য (subconscient) বলে, বেদের অপ্রকেতং সলিলং, প্রজ্ঞাহীন সমুদ্র ৷ প্রজ্ঞাহীন হইলেও সে অচেতন নয়, তাহার মধ্যে প্রজ্ঞাতীত বিশ্বচৈতন্য সৰ্ব্বজ্ঞানে জ্ঞানী সৰ্ব্বকৰ্ম্মে সমর্থ হইয়া যেন অবশ সঞ্চারে জগতের সৃষ্টি ও গতি সম্পাদিত করে ৷ উপরে গুহ্য মুক্ত অনন্ত চৈতন্য যাহাকে অতিচৈতন্য (superconscient) বলে, যাহার ছায়া এই অচেতন-চেতন ৷ সেখানে সচ্চিদানন্দ জগতে পূর্ণপ্রকাশিত, সত্যলােকে অনন্ত সৎ-রূপে তপােলােকে অনন্ত চিৎ-রূপে জনলােকে অনন্ত আনন্দরূপে, মহর্লোকে বিশাল বিশ্ব-আধার সত্যরূপে ৷ মধ্যস্থ পার্থিব চৈতন্য বেদোক্ত পৃথিবী ৷ এই পৃথিবী হইতে জীবনের আরােহণীয় পৰ্বত গগনে উঠে, তাহার প্রত্যেক সানু আরােহণের একটী সােপান, প্রত্যেক সানু সপ্তলােকের একটী লােকের অন্তঃস্থ রাজ্য ৷ দেবতারা আরােহণের সহায়, দৈত্যরা শত্রু ও পথরােধক ৷ এই পর্বতারােহণই বৈদিক সাধকের যজ্ঞগতি, যজ্ঞের সহিত পরম-লােকে পরম আকাশে আলােকসমুদ্রে উঠিতে হইবে ৷ আরােহণের এই অগ্নিই সাধনস্বরূপ, এই পথের নেতা, এই যুদ্ধের যােদ্ধা, এই যজ্ঞের পুরােহিত ৷ বৈদিক কবিগণের অধ্যাত্মজ্ঞান এই মূল উপমার উপর প্রতিষ্ঠিত যেমন বৃন্দাবনবাসী ৷ প্রেমিক গােপগােপীর উপমার উপর বৈষ্ণবদের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক জ্ঞান-সকল ৷ এই উপমার অর্থ সর্বদা মনে রাখিলে বেদতত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হইয়া উঠে ৷


প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ২

হে সৰ্ব্বদ্রষ্টা জীবনদেব বায়ু, এস ৷ এই তােমার জন্যে আনন্দের মদ্যরস প্রস্তুত ৷ এই আনন্দ মদ্যরস পান কর, শুন এই আহ্বান যখন ডাকি, শুন ৷ (১)

জীবনদেবতা, তােমার প্রণয়ীগণ তাহাদের উক্তি বলে তােমাকে সাধনা করে, তাহাদের আনন্দরস প্রস্তুত, তােমার দিনগুলির জ্যোতি তাহাদের আয়ত্ত ৷ (২)

জীবনদেবতা, দাতার জন্যে তােমার ভরা প্রাণনদী স্পর্শ করিয়া বহিতেছে, আনন্দ মদ্য পান করিতে তাহার স্রোত হইয়াছে উরু ও বিস্তৃত ৷ (৩) ৷

ইন্দ্র ও বায়ু, এই সেই আনন্দ মদ্যরস, শ্রেয়সকল লইয়া এস ৷ সােম দেবতারা তােমাদের দুইজনকে কামনা করে ৷ (৪) ৷

বিভবে ধনশালী, ইন্দ্র ও বায়ু তােমরা আনন্দসের চেতনা জাগাইয়া দাও ৷ ধাবিত হও, এস ৷ (৫)

ইন্দ্র ও বায়ু, ত্রিদিবের নর, তােমাদের যথার্থ চিন্তা লইয়া এই সু-সিদ্ধ আনন্দ রসভােগ করিতে শীঘ্র উপস্থিত হও ৷ (৬)

পবিত্র বুদ্ধি মিত্রকে, নাশক পরিপন্থীর বিনষ্টা বরুণকে আহ্বান করি, জ্যোতির্ময় যাঁহারা সত্যের আলােময় চিন্তা সাধনা করেন ৷ (৭)

মিত্র ও বরুণ, তােমরা সত্যকে বর্ধন কর, সত্যকে স্পর্শ কর, সত্য দ্বারা বৃহৎ কর্মশক্তি লাভ করিয়া ভােগ কর ৷ (৮)

মিত্র ও বরুণ আমাদের দুই দ্রষ্টা কবি ৷ বহুবিধ তাহাদের জন্ম, উরু অনন্তলােক বাসভূমি ৷ কৰ্ম্মে তাহারা সম্মুখ জ্ঞানশক্তি ধারণ করেন ৷ (৯)


প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ৩

দ্রুপদ অশ্বীদ্বয়, বহুভােগী আনন্দপতি, আমাদের কর্মপ্রসূত প্রেরণাসকলে আনন্দ কর ৷ (১)

বহুকৰ্মী মনস্বী নর অশ্বীদ্বয়, তােমাদের তেজোময় চিন্তায় আমাদের উক্তি-সকলকে স্থান দিয়া সম্ভোগ কর ৷ (২) ৷

হে কৰ্মী পথিকদ্বয়! প্রসূত হইয়াছে, তাহার যৌবনভরা এই আনন্দরস স্থান ৷ এই যজ্ঞাসন, সেও প্রস্তুত ৷ তীব্ৰপন্থী তােমরা এস ৷ (৩)

হে বিচিত্ররশ্মি শক্তিধর ইন্দ্র, দশটী সূক্ষ্ম শক্তির হাতে এই সােমরস শরীরে পূত হইয়া তােমাকে কামনা করিতেছে ৷ (৪) ৷

এস, ইন্দ্র, আমাদের চিন্তা তােমাকে পথপ্রেরণা দিতেছে, দ্রষ্টা ঋষি সবেগে পথে চালাইতেছেন ৷ সােমদাতা! আহ্বানকারীর মন্ত্রগুলি বরণ করিতে এস ৷ (৫)

হরি-অশ্বের নিয়ামক ইন্দ্র, ত্বরিতগতি মন্ত্রগুলিকে বরণ করিতে এস এই সােমরসে যে আমাদের আনন্দ তােমার মনেও সেটিকে ধারণ কর ৷ (৬)

হে বিশ্বদেবেরা তােমরাও এস যাহারা দ্রষ্টা মনুষ্যদের কল্যাণকারী ধারণকৰ্ত্তা, দাতার আনন্দরস যাহারা বিতরণ কর ৷ (৭) ৷

হে বিশ্বদেবেরা স্বর্গ নদী তরণ করিয়া ত্বরিত এস সােম যজ্ঞের যেন স্ব স্ব বিশ্রাম স্থানে ত্রিদিবের দীপ্ত গাভীসংঘ ৷ (৮) ৷

হে বিশ্বদেবেরা, তােমরা তীব্রজ্ঞানী, নাই তােমাদের বিরােধী, নাই তােমাদের বিনষ্টা ৷ আমার মনের এই যজ্ঞ বহন কর, বরণ কর ৷ (৯)

বিশ্বপাবনী দেবী সরস্বতী বহুবৈভবে বৈভবশালিনী চিন্তাধনে ঐশ্বৰ্য্যময়ী, তিনিও যেন আমার এই যজ্ঞকর্মকে কামনা করেন ৷ (১০)

সরস্বতী সত্যবাকের প্রেরণাদাত্রী সরস্বতী সুচিন্তায় জ্ঞানজাগরণকী, আমার যজ্ঞকৰ্ম্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করিয়া বসিয়াছেন ৷ (১১) ৷

সরস্বতী মনের দৃষ্টির বলে চেতনার মহাসমুদ্রকে আমাদের জ্ঞানের বস্তু করেন ৷ আমার সকল চিন্তায় আলােকবিস্তার করিয়া তিনি আসীন ৷ (১২) ৷


প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ৪

প্রতিদিন সেই সুন্দর রূপগুলির শিল্পীকে যেন জ্ঞানরশ্মির দোহন করিতে কুশল দোহনকারীকে আহ্বান করি ৷ (১)

আনন্দরসের আনন্দপায়ী, সােমযজ্ঞে এস ৷ পান কর ৷ বহু ঐশ্বৰ্য্য, তােমার মত্ততা ৷ (২)

তােমার সেই অন্তরতম সুচিন্তাসকল আমাদের জ্ঞানে আসে ৷ এস, তােমার প্রকাশ আমাদের ওপারে যেন না যায় ৷ (৩)

অগ্রসর হও ওই পারেই, শক্তিমান অপরাজিত আলােকিতচিত্ত ইন্দ্রকে প্রাপ্ত কর, যিনি তােমার সখাদের যাহা পরম তাহা বিধান করিবেন ৷ (৪)

যাহারা আমাদের সিদ্ধির নিন্দা করে, তাহারা বলিবে “যাও, হইয়াছে, অন্য ক্ষেত্রেও সাধনা কর ৷ ইন্দ্রেই তােমাদের কৰ্ম্ম স্থাপিত কর” ৷ (৫)

হে কৰ্ম্মী এই আৰ্য্য জাতিরাও আমাদের সৌভাগ্যশালী বলুক ৷ ইন্দ্রর শান্তিতে আনন্দে আমরা যেন বাস করি ৷ (৬)

তীব্র গতি ইন্দ্রকে এই তীব্রগতি যজ্ঞশ্রী, এই নরচিত্ত মত্তকারী আনন্দমদিরা লইয়া দাও ৷ তাহাকে পথপ্রেরণা দাও যিনি তাঁহার সখাদের আনন্দমত্ততায় বিভাের করেন ৷ (৭)

হে শতকর্মী, এই আনন্দরস পান করিয়া তুমি আবরণকারীদের বিনাশ করিয়াছ, ঐশ্বৰ্য্যশালী মনুষ্যকে তাহার ঐশ্বর্য্যে বর্ধিত করিয়াছ ৷ (৮)

হে ইন্দ্ৰ শতকৰ্ম্মী, ঐশ্বর্য্যে ঐশ্বৰ্য্যশালী তােমাকে ঐশ্বর্য্যে ভরণ করি, তুমি আরও ধনরাশি আমাদের হইয়া জয় করিবে ৷ (৯)

যিনি ঐশ্বৰ্য্য নদী, যিনি মহান, যিনি ওপারে নিত্য পথে পৌঁছান, যিনি সােম-দাতার সখা, সেই ইন্দ্রকে গান কর ৷ (১০)


প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ৫

হে স্তোমবাহক সখাগণ, এস, বল, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে গান কর ৷ (১)

বহুর মধ্যে যাহার বহুত্ব শ্রেষ্ঠ, সকল কমনীয় বস্তুর যিনি ঈশ্বর, প্রকাশ – আনন্দসকে দোহন করিয়া সেই ইন্দ্রকে গান কর ৷ (২)

তিনি যেন যােগে আমাদের লভ্যলাভে, তিনি ঐশ্বৰ্য্য ও আনন্দ দিতে, তিনি এই পুরীর অধিষ্ঠাত্রী শক্তিতে আবির্ভূত হন ৷ যেন তাহার সকল বৈভব লইয়া আমাদের কাছে আসেন ৷ (৩)

যাঁহার যুদ্ধে দীপ্ত অশ্বদেরকে শত্রুরা সংগ্রামে রােধ করিতে অসমর্থ, সেই ইন্দ্রকে গান কর ৷ (৪)

তিনি আনন্দরসকে পবিত্র করেন, পবিত্র হইয়া এই যে দধিমিশ্রিত সােম পানার্থে তাহার নিকট যাইতেছে ৷ (৫)

হে সুতকৰ্ম্মী ইন্দ্র তাহা পান করিতে, মহতের মহত্তম হইতে তুমি সেই মুহূর্তে নিজেকে বিস্তার কর ৷ (৬)

হে মন্ত্রপ্রিয়, সেই তীব্রগতি আনন্দরস যেন তােমার মধ্যে প্রবিষ্ট হৌক, যেন তােমার জ্ঞানী মনকে আনন্দ দিক ৷ (৭)

হে শতকৰ্ম্মী আমাদের উক্তি, আমাদের স্তব তােমাকে আগেও বর্ধিত করিতেন, এখনও যেন আমাদের বাক্যসকল আরাে বর্ধিত করুক ৷ (৮)

অক্ষয়বৃদ্ধিশালী ইন্দ্র যেন এই সেই বৈভব জয় করুন যাহার মধ্যে সর্ববিধ বলবীৰ্য্য নিহিত ৷ (৯)

হে মন্ত্রপ্রিয়, দেখ যেন কোন মৰ্ত্ত আমাদের শরীরের হানি না করুক ৷ তুমি সকলের ঈশ্বর, তাহার অস্ত্রকে অন্যপথে চালিত কর ৷ (১০)


প্রথম মণ্ডল – সূক্ত ১৭

মূল

ইন্দ্রাবরুণয়ােরহং সম্রাজোরব আ বৃণে ৷ তা নাে মৃড়াত ঈদৃশে ॥১॥
গন্তারা হি স্থােহবসে হবং বিপ্রস্য মাবতঃ ৷ ধর্তারা চর্ষণীনাম ॥২॥
অনুকামং তর্পয়েথামিন্দ্রাবরুণ রায় আ ৷ তা বাং নেদিষ্ঠমীমহে ॥৩॥
যুবাকু হি শচীনাং যুবাকু সুমতীনাম্ ৷ ভূয়াম বাজদাাম ॥৪॥
ইন্দ্ৰঃ সহস্ৰদানাং বরুণঃ শংস্যানা ৷ ক্রতুৰ্ভবত্যুকথ্যঃ ॥৫॥
তয়ােরিদবসা বয়ং সনেম নি চ ধীমহি ৷ স্যাদূত প্ররেচন ॥৬॥
ইন্দ্রাবরুণ বামহং হুবে চিত্রায় রাধসে ৷ অস্মাৎসু জিগ্‌ষস্কৃতম্ ॥৭॥
ইন্দ্রাবরুণ নূ নু বাং সিষাসন্তীষু ধীষা ৷ অস্মভ্যং শর্ম যচ্ছত ॥৮॥
প্র বামশ্নোতু সুষ্ঠুতিরিন্দ্রাবরুণ যাং হুবে ৷ যামৃধাথে সধস্তুতিম্ ॥৯॥

ঈদৃশে ৷ কিম্বা “এই দৃষ্ট্যর্থে” ৷ এতদৃষ্টে ৷ মাবতঃ ৷ “ম” ধাতু বংশের সকলের ধারণই আদিম অর্থ কিন্তু চূড়ান্ত প্রাপ্তি, সম্পূর্ণতা ও সিদ্ধিও “ম” দ্বারা ব্যক্ত হয় ৷ বিপ্রস্য মাবতঃ এই কথার “যে জ্ঞানী জ্ঞানের বা সাধনার শেষ সীমায় পৌছিতেছেন” এই অর্থও হইতে পারে; কিন্তু যখন কাৰ্য্যর ধারণকৰ্ত্তা বলিয়া ইন্দ্র ও বরুণ আহূত হইলেন, তখন প্রথম অর্থই সমর্থনীয় ৷ শক্তিধারণে কাৰ্য্য সিদ্ধি, শক্তিধারণে যে সমর্থ, মানসিক বলের দেবতা ইন্দ্র এবং ভাব মহত্ত্বের দেবতা বরুণ তাহারই সহায়তা করেন ৷ দুৰ্বলকে তাঁহাদের আবেশ সহ্য করিতে অসমর্থ বলিয়া তাহারা সেই পরিমাণে সাহায্য ও রক্ষা করিতে পারেন না ৷

ক্রতুঃ কথাটীর প্রাচীন অর্থ ছিল শক্তি, বল বা সামর্থ্য; গ্রীক ভাষায় সেই অর্থে ক্রতস্ (kratos, বল, krateros, বলবান) শব্দটি পাওয়া যায় ৷ এখানে যখন ইন্দ্র ও বরুণকে ক্রতু বলিয়া প্রশংসিত হইলেন, ইহাও প্রমাণিত হয় যে এই শব্দের বলবান বা প্রভু অর্থও ছিল ৷

প্ররেচনং শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ ছিল কুমতি ও কুবৃত্তিকে বহিষ্কৃত করিয়া আধারকে মলশূন্য ও শুদ্ধ করা ৷ ইহাই গ্রীকদের সেই বিখ্যাত “katharsis” ৷

সধস্ – সধূ ধাতুর বিশেষণ ও বিশেষ্য, যে ধাতু হইতে সাধন কথাটী উৎপন্ন হয় ৷ কিন্তু পরে সংস্কৃতে সেই ধাতু লুপ্ত হয় ৷ “বলদ” অর্থদ্যোতক সধিষ্ঠ শব্দ আছে – যে জন্তু পরিশ্রম করে, জমিকে চাষের যােগ্য করে, সেই সধিষ্ঠ ৷

অনুবাদ

হে ইন্দ্র, হে বরুণ, তােমরাই সম্রাট, তােমাদিগকেই আমরা রক্ষকরূপে বরণ করি, – সেই যে তােমরা এইরূপ অবস্থায় আমাদের উপর সদয় হও ৷ (১)

কারণ, যে জ্ঞানী শক্তি-ধারণ করিতে পারেন, তােমরা তাহার যজ্ঞস্থলে রক্ষণার্থে উপস্থিত হও; তােমরাই কাৰ্য সকলের ধারণকৰ্ত্তা ৷ (২) ৷

আধারের আনন্দপ্রাচুর্যে যথা কামনা আত্মতৃপ্তি অনুভব কর ৷ হে ইন্দ্র ও বরুণ, আমরা তােমাদের অতিনিকট সহবাস চাই ৷ (৩)

যে সকল শক্তি এবং যে সকল সুবুদ্ধি আন্তরিক ঋদ্ধি বর্ধন করে, সেই সকলের প্রবল আধিপত্যে আমরা যেন প্রতিষ্ঠিত থাকি ৷ (৪)

যাহা যাহা শক্তিদায়ক ইন্দ্র তাহার এবং যাহা প্রশস্ত ও মহৎ বরুণ তাহারই শৃহণীয় প্রভু হন ৷ (৫) ৷

এই দুইজনের রক্ষণে আমরা স্থির সুখে নিরাপদ থাকি এবং গভীর ধ্যানে সমর্থ হই ৷ আমাদের সম্পূর্ণ শুদ্ধি হৌক ৷ (৬)

হে ইন্দ্র, হে বরুণ, আমরা তােমাদিগের নিকট চিত্রবিচিত্র আনন্দলাভার্থে যজ্ঞ করি, আমাদিগকে সর্বদা জয়ী কর ৷ (৭)

হে ইন্দ্র, হে বরুণ, আমাদের বুদ্ধির সকল বৃত্তি যেন বশ্যতা স্বীকার করে, সেই বৃত্তিসকলে অধিষ্ঠিত হইয়া আমাদিগকে শান্তি দান কর ৷ (৮)

হে ইন্দ্র, হে বরুণ, এই সুন্দর স্তব তােমাদিগকে যজ্ঞরূপে অৰ্পণ করি, সে যেন তােমাদের ভােগ্য হয়, সেই সাধনার্থ স্তববাক্য তােমরাই পুষ্ট ও সিদ্ধিযুক্ত করিতেছ ৷ (৯)

ব্যাখ্যা

প্রাচীন ঋষিগণ যখন আধ্যাত্মিক যুদ্ধে অন্তঃশত্রুর প্রবল আক্রমণে দেবতাদের সহায়তা লাভ প্রার্থনা করিতেন, সাধনপথে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া অসম্পূর্ণতা বােধে পূর্ণতা-প্রতিষ্ঠা-মানসে “বাজঃ” বা শক্তির স্থায়ী জমাট অবস্থা কামনা করিতেন অথবা অন্তঃপ্রকাশ ও আনন্দের পরিপূর্ণতায় তাহারই প্রতিষ্ঠা করিতে ভােগ করিতে বা রক্ষা করিতে দেবতাদের আহ্বান করিতেন, তখন আমরা প্রায়ই তাহাদিগকে জোড়া জোড়া অমরগণকে একবাক্যে একস্তবে ডাকিয়া মনের ভাব জানাইতে দেখি ৷ অশ্বিনদ্বয়, ইন্দ্র ও বায়ু, মিত্র ও বরুণ এইরূপ সংযােগের উদাহরণ ৷ এই স্তবে ইন্দ্র ও বায়ু নহে, মিত্র ও বরুণ নহে, ইন্দ্র ও বরুণের এইরূপ সংযােগ করিয়া কন্ববংশজ মেধাতিথি আনন্দ, মহত্ত্বসিদ্ধি ও শান্তির প্রার্থনা করিতেছেন ৷ তাহার এখন উচ্চ বিশাল ও গম্ভীর মনের ভাব ৷ তিনি চান মুক্ত ও মহৎ কৰ্ম্ম, চান প্রবল তেজস্বী ভাব কিন্তু সেই বল স্থায়ী ও গভীর বিশুদ্ধ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইবে, সেই তেজ শান্তির বিশাল পক্ষদ্বয়ে আরূঢ় হইয়া কৰ্ম্ম-আকাশে বিচরণ করিবে, তিনি চান আনন্দের অনন্ত সাগরে ভাসমান হইয়াও, আনন্দের চিত্রবিচিত্র তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হইয়াও সেই আনন্দে স্থৈর্য্য, মহিমা ও চিরপ্রতিষ্ঠার অনুভব ৷ তিনি সেই সাগরে মজিয়া আত্মজ্ঞান হারা হইতে, সেই তরঙ্গে লুলিতদেহ হইয়া হাবুডুবু খাইতে অনিচ্ছুক ৷ এই মহৎ আকাঙক্ষালাভের উপযুক্ত সহায়তাকারী দেবতা ইন্দ্র ও বরুণ ৷ রাজা ইন্দ্র, সম্রাট বরুণ ৷ সমস্ত মানসিকবৃত্তি, অস্তিত্ব ও কর্মকারিতার কারণ যে মানসিক তেজ ও তপঃ, ইন্দ্রই তাহার দাতা এবং বৃত্রদের আক্রমণ হইতে তাহার রক্ষা করেন ৷ চিত্ত ও চরিত্রের যত মহৎ ও উদার ভাব, যাহার অভাবে মনের এবং কর্মের ঔদ্ধত্য, সংকীর্ণতা, দুৰ্ব্বলতা বা শিথিলতা অবশ্যম্ভাবী, বরুণই তাহা স্থাপন করেন ও রক্ষা করেন ৷ অতএব এই সূক্তের প্রারম্ভে ঋষি মেধাতিথি এই দুজনেরই সহায়তা ও সখ্য বরণ করেন ৷ ইন্দ্রাবরুণয়ােরহমব আবৃণে ৷ “সম্রাজোর” – কেননা তাহারাই সম্রাট ৷ অতএব “ঈদৃশে”, এই অবস্থায় বা অবসরে (যে মনের অবস্থার বর্ণনা করিলাম) তিনি নিজের জন্যে ও সকলের জন্যে তাহাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করেন – তা নাে মৃড়াত ঈদৃশে ৷ যে অবস্থায় দেহের, প্রাণের, মনের, বিজ্ঞানাংশের সকল বৃত্তি ও চেষ্টা স্বস্থানে সমারূঢ় ও সংবৃত, কাহারও জীবের উপর আধিপত্য, বিদ্রোহ বা যথেচ্ছাচার নাই, সকলেই স্ব স্ব দেবতার ও পরাপ্রকৃতির বশ্যতা স্বীকার করিয়া স্ব স্ব কৰ্ম্ম ভগবৎনির্দিষ্ট সময়ে ও পরিমাণে সানন্দে করিতে অভ্যস্ত, যে অবস্থায় গভীর শান্তি অথচ তেজস্বী সীমারহিত প্রচণ্ড কৰ্ম্মশক্তি, যে অবস্থায় জীব স্বরাজ্যের স্বরাট, নিজ আধাররূপ আন্তরিক রাজ্যের প্রকৃত সম্রাট, তাহারই আদেশে বা তাহারই আনন্দার্থে সকল বৃত্তি সুচারুরূপে পরস্পরের সহায়তাপূর্বক কৰ্ম্ম করে অথবা তাহার ইচ্ছা হইলে গভীর তমােরহিত নিষ্কৰ্ম্মর্তায় মগ্ন হইয়া অতল শান্তি অনির্বচনীয় রসাস্বাদন করে, প্রথম যুগের বৈদান্তিকেরা সেই অবস্থাকে স্বারাজ্য বা সাম্রাজ্য বলিতেন ৷ ইন্দ্র ও বরুণ সেই অবস্থার বিশেষ অধিকারী, তাহারাই সম্রাট ৷ ইন্দ্র সম্রাট হইয়া আর সকল বৃত্তিকে চালিত করেন, বরুণ সম্রাট হইয়া আর সকল বৃত্তিকে শাসন করেন এবং মহিমান্বিত করেন ৷

এই মহিমান্বিত অমরদ্বয়ের সম্পূর্ণ সহায়তা লাভে সকলে অধিকারী নহেন ৷ যিনি জ্ঞানী, যিনি ধৈর্য্যে প্রতিষ্ঠিত, তিনিই অধিকারী ৷ বিপ্র হওয়া চাই, মাবান হওয়া চাই ৷ বিপ্র ব্রাহ্মণ নহে, বি ধাতুর অর্থ প্রকাশ, বি ধাতুর অর্থ প্রকাশের ক্রীড়া, কম্পন বা পূর্ণ উচ্ছ্বাস, যাঁহার মনে জ্ঞানের উদয় হইয়াছে, যাঁহার মনের দ্বার জ্ঞানের তেজীয়সী ক্রীড়ার জন্য মক্ত, তিনিই বিপ্র ৷ মা ধাতুর অর্থ ধারণ ৷ জননী গর্ভে সন্তানের ধারণকত্রী বলিয়া মাতা শব্দে অভিহিত ৷ আকাশ সকল ভূতের সকল জীবের জন্ম, ক্রীড়া ও মৃত্যু স্বকুক্ষিতে ধারণ করিয়া স্থির অবিচলিত হইয়া থাকে বলিয়া সকল কর্মের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণস্বরূপ বায়দেবতা মাতরিশ্বা নামে খ্যাত ৷ আকাশের ন্যায় যার ধৈৰ্য্য ও ধারণশক্তি, প্রচণ্ড ঘূর্ণবায়ু যখন দিঙমণ্ডলকে আলােড়িত করিয়া প্রচণ্ড হুঙ্কারে বৃক্ষ, জন্ত, গৃহ পৰ্য্যন্ত টানিয়া রুদ্র ভয়ঙ্কর রাসলীলার নৃত্য অভিনয় করে, আকাশ যেমন সেই ক্রীড়াকে সহ্য করে, নীরবে স্বসুখে মগ্ন হইয়া থাকে, যিনি সেইরূপে প্রচণ্ড বিশাল আনন্দ, প্রচণ্ড রুদ্র কৰ্ম্মস্রোত এমন কি শরীর বা প্রাণের অসহ্য যন্ত্রণাকেও স্বীয় আধারে সেই ক্রীড়ার উন্মক্ত ক্ষেত্ৰ দিয়া অবিচলিত ও আত্মসুখে প্রফুল্ল থাকিয়া সাক্ষীরূপে ধারণ করিতে সমর্থ, তিনিই মাবান ৷ যখন এইরূপ মাবান বিপ্র, এইরূপ ধীর জ্ঞানী স্বীয় আধারকে বেদী করিয়া যজ্ঞার্থে দেবতাদের আহ্বান করে, ইন্দ্র ও বরুণের সেইখানে অকুণ্ঠিত গতি, তাহারা স্বেচ্ছায়ও উপস্থিত হন, যজ্ঞ রক্ষা করেন, তাহার সকল অভীপ্সিত কৰ্ম্মের আশ্রয় ও প্রতিষ্ঠা সাজিয়া (ধর্তারা চর্ষণীনাং) বিপুল আনন্দ, শক্তি ও জ্ঞানপ্রকাশ প্রদান করেন ৷


প্রথম মণ্ডল - সূক্ত ৭৫

মূল

জুষস্ব সপ্রথস্তমং বচো দেবরস্তমম্ ৷ হব্যা জুহ্বান আসনি ॥১॥
অথা তে অঙ্গিরস্তমাগ্নে বেধস্তম প্রিয়ম্ ৷ বােচেম ব্রহ্ম সানসি ॥২ |
কস্তে জামির্জনানামগ্নে কো দাশ্বব্বরঃ ৷ কো হ কস্মিন্নসি শ্রিতঃ ॥৩ ॥
ত্বং জামির্জনানামগ্নে মিত্রো অসি প্রিয় ৷ সখা সখিভ্য ইড্যঃ ॥৪॥
যজা নাে মিত্রাবরুণা যজা দেবা ঋতং বৃহৎ ৷ অগ্নে যক্ষি স্বং দম ৫ ॥

অনুবাদ

যাহা ব্যক্ত করিতেছি তাহা অতিশয় বিস্তৃত ও বৃহৎ এবং দেবতার ভােগের সামগ্রী, তাহা তুমি সপ্রেমে আত্মসাৎ কর ৷ যতই হব্য প্রদান করি, তােমারই মুখে অর্পণ কর ৷ (১) ৷

হে তপঃ-দেব! শক্তিধরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ বিধাতা, আমি আমাদের যে হৃদয়ের মন্ত্র ব্যক্ত করিতেছি, তাহা তােমার প্রিয় এবং আমার অভিলষিতের বিজয়ী ভােক্তা হৌক ৷ (২) ৷

হে তপঃ-দেব অগ্নি, জগতে কে তােমার সঙ্গী ও ভ্রাতা? তােমাকে দেবগামী সখ্য দিতে কে সমর্থ? তুমি বা কে? অথবা কার অন্তরে অগ্নি আশ্রিত? (৩)

অগ্নি! তুমিই সর্বপ্রাণীর ভ্রাতা, তুমিই জগতের প্রিয় বন্ধু, তুমিই সখা এবং তােমার সখাদের কাম্য ৷ (৪) ৷

মিত্র ও বরুণের উদ্দেশ্যে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে বৃহৎ সত্যের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ কর ৷ অগ্নি! সেই সত্য তােমারই নিজের গৃহ, সেই লক্ষ্যস্থলে যজ্ঞকে প্রতিষ্ঠিত কর ৷ (৫)


প্রথম মণ্ডল – সুক্ত ১১৩

সর্বজ্যোতির মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ জ্যোতি সেইই আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত ৷ দেখ সৰ্বব্যাপী বিচিত্ৰজ্ঞানময় বােধরূপে তাহার জন্ম! রাত্রীও বিশ্বস্রষ্টা সত্যাত্মার নন্দিনী, তিনিও স্রষ্টার সৃষ্ট্যর্থ সৃষ্টা, রাত্রী উষাকে গর্ভে বহন করিতেছিলেন, এখন গর্ভ শূন্য করিয়া সেই জ্যোতিকে জন্ম দিয়া গিয়াছেন ৷ (১)

রক্তাভ-বৎস-যুক্তা রক্তাভ-শ্বেতবর্ণা আলােকদেবী উপস্থিত, কৃষ্ণবর্ণা তমাে-রূপিণী রাত্রীই জীবের এই সকল নানারূপ গৃহকে তাহার জন্যে মুক্ত করিয়া চলিয়াছেন ৷ এই রাত্রীও এই উষার একই প্রেমময় বন্ধু, দুইজনই অমৃতত্বপূর্ণ, দুইজনই পরস্পরে অনুকূলমনা ৷ এই যে পৃথিবী ও দ্যুলােক বাহিরে ভিতরে আমাদের ক্ষেত্র, তাহার দিকসকল নিশ্চিত করিতে দুইজনই বিচরণ করিতেছেন ৷ (২) ৷

দুই ভগিনীর একই অনন্তপথ, দেবদের শিষ্যা দুই ভগিনী স্বতন্ত্রভাবে সেই পথে বিচরণ করিতেছেন ৷ মিশেনও না, পরস্পরের উপর দানবর্ষণ করিতে করিতে পথে থামেনও না ৷ রাত্রী ও উষার একই মন, রূপমাত্র বিভিন্ন ৷ (৩)

সত্যপথে যিনি আমাদের দীপ্তিময়ী নেত্রী, তিনিই এখন সত্য সকলকে চিত্তে উদ্ভাসিত করিতেছেন ৷ দেখ, কত বিচিত্র অর্গলবদ্ধ দ্বার উদঘাটিত হইল ৷ দশদিকে জগতের সঙ্কীর্ণ পরিধিসকল দেবতা আগলাইয়া দিয়াছেন, আমাদের প্রাণে আনন্দের বহুত্ব প্রকাশিত ৷ উষা আমাদের জগৎক্ষেত্রের অব্যক্ত নানা ভুবন সকল প্রকাশ করিয়াছেন ৷ (৪) ৷

পুরুষ জগতের এই অমৃতময় বক্র পথে শুইয়া পড়িয়াছিলেন ৷ হে পূর্ণতাদায়িনী উষা তুমিই তাহাকে কৰ্ম্মপথে, ভােগপথে, যজ্ঞপথে, আনন্দপথে এগােতে আহ্বান কর ৷ যাহারা অল্পদর্শনে সমর্থ ও সন্তুষ্ট ছিল, তাহাদের বিশালদৃষ্টিলাভের জন্যে তুমি জগৎক্ষেত্রের নানা ভুবন তাহাদের সম্মুখে প্রকাশ করিয়াছ ৷ (৫) ৷

তুমিই ক্ষত্ৰতেজ, তুমিই দিব্যজ্ঞানশক্তি, তুমিই মহতী প্রেরণা, তুমিই আমাদের ক্ষেত্র ও পথ, তুমিই সেই পথে চলনশক্তি ৷ জীবনের যত একাত্ম নানারূপ বিকাশ ও ক্রীড়া দেখাইবার জন্যে উষাদেবী জগৎক্ষেত্রের নানা ভুবন প্রকাশ করিয়াছেন ৷ (৬)

এই দেখ স্বর্গের দুহিতা সম্পূর্ণ প্রভাত হইতেছেন, আলােকবসনা যুবতী দেখা দিয়াছেন ৷ হে পূর্ণভােগময়ী উষা, আজিই এই মর্ত্যলােকে পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্যের ঈশ্বরীরূপে নিজেকে প্রকাশ কর ৷ (৭)

যাঁহারা অগ্রে চলিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের গন্তব্যস্থলে ইনিও অনুসরণ করিতেছেন; যাঁহারা নিত্যই নিত্য স্রেতে আসিবেন, তাঁহাদের ইনিই প্রথমা ও অগ্রগামিনী ৷ যেই জীবিত, তাহাকে আরােহণ মার্গে তুলিয়া যাইতেছেন ৷ বিশ্বপ্রাণে কে মৃত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাকেও জাগাইতেছেন ৷ (৮) ৷

উষা, তুমি যে বলদেবতা অগ্নিকে পূর্ণদীপ্তি লাভের সমর্থ করিয়াছ, তুমি যে সত্যাত্মা সূর্যের সত্যদৃষ্টিদ্বারা এই সমস্তকে প্রকাশ করিয়াছ, তুমি বিশ্বযজ্ঞার্থে মানবকে তমঃ হইতে আলােকে আনয়ন করিয়াছ ৷ দেবতাদের ব্রতে ইহাই তােমার আনন্দদায়ক কৰ্ম্ম ৷ (৯) ৷

জ্ঞানের কি ইয়ত্তা, প্রকাশের কি বিশালতা, যখন যে সকল উষা আগে প্রভাত হইয়াছে আর যাহারা এখন প্রভাত হইতে আসিতেছে তাহাদের সঙ্গে অদ্যকার উষারূপ বিশ্বময় জ্ঞানােন্মেষ একদীপ্তি হইয়া যায় ৷ প্রাচীন প্রভাত সকল এই প্রভাতকে কামনা করিয়াছিল, তাহাদের আলােকে ইনি আলােকিত ৷ এখন ধ্যানস্থ হইয়া ভাবী উষা সকলের সঙ্গে মিলিত ও একচিত্ত হইবার মানসে সেই আলােক ভবিষ্যতের দিকে বাড়াইতেছেন ৷ (১০)


তৃতীয় মণ্ডল – সূক্ত ৪৬

মূল

যুধমস্য তে বৃষভস্য স্বরাজ উগ্রস্য শূনঃ স্থবিরস্য ঘৃষ্যেঃ ৷
অজুর্যতাে বর্জিণাে বীর্যাণীন্দ্র তস্য মহতাে মহানি ॥১॥
মহা অসি মহিষ বৃষ্ণ্যেভির্ধনশৃদুগ্ৰ সহমানাে অন্যা ৷
একো বিশ্বস্য ভুবনস্য রাজা স যােধয়া চ ক্ষয়য়া চ জনা ৷২ ॥
প্র মাত্রাভী রিরিচে রােমানঃ প্র দেবেভির্বিশ্বতাে অপ্রতীতঃ ৷
প্র মজুমনা দিব ইন্দ্রঃ পৃথিব্যাঃ প্রােরাের্মহাে অন্তরিক্ষাদৃজীষী ॥৩॥
উরুং গভীরং জনষাভ্যগ্রং বিশ্বব্যচসমবতং মতীনাম ৷
ইং সােমাসঃ প্রদিবি সুতাসঃ সমুদ্রং ন স্ত্রবত আ বিশন্তি ॥৪ ॥
যং সােমমিন্দ্র পৃথিবীদ্যাবা গর্ভং ন মাতা বিভৃতত্ত্বায়া ৷
তং তে হিন্বন্তি তমু তে মৃজন্ত্যধ্বর্যবাে বৃষভ পাতবা উ॥৫ ॥

অনুবাদ

যে দেবতা পুরুষ যােদ্ধা ওজস্বী স্বরাজ্যের স্বরাট, যে দেবতা নিত্যযুবা স্থির-শক্ত প্রখরদীপ্তিরূপ ও অক্ষয়, অতি মহৎ সেই শ্রুতিধর বজ্রধর ইন্দ্র, অতি মহৎ তাহার বীরকর্ম সকল ৷ (১)

হে বিরাট, হে ওজস্বী, মহান তুমি, তােমার বিস্তার-শক্তির কৰ্ম্ম দ্বারা তুমি আর সকলের উপর জোর করিয়া তাহাদের নিকট আমাদের অভিলষিত ধন বাহির কর ৷ তুমি এক, সমস্ত জগতে যাহা যাহা দৃষ্ট হয় তাহার রাজা, মানুষকে যুদ্ধে প্রেরণা দিয়াে, তাহার জেতব্য স্থিরধামে তাহাকে স্থাপন করাে ৷ (২) ৷

ইন্দ্র দীপ্তিরূপে প্রকাশ হইয়া জগতের মাত্রা সকল অতিক্রম করিয়া যান, দেবদেরও সকল দিকে অনন্তভাবে অতিক্রম করিয়া সকলের অগম্য হন ৷ সবেগে ঋজুগামী এই শক্তিধর তাহার ওজস্বিতায় মনােজগত, উরু ভূলােক এবং মহান প্রাণজগৎকে অতিক্রম করিয়া যান ৷ (৩) ৷

এই বিস্তৃত ও গভীর, এই জন্মতঃ উগ্র ও ওজস্বী, এই সৰ্ববিকাশক সৰ্ব্ব-চিন্তা-ধারক ইন্দ্ররূপ সমুদ্রে জগতের আনন্দ-মদ্যকর রসপ্রবাহ সকল মনােলােকের মুখে অভিব্যক্ত হইয়া স্রোতস্বিনী নদীর মত প্রবেশ করে ৷ (৪)

হে শক্তিধর, এই সেই আনন্দ-মদিরা মনােলােক ও ভূলােক মাতা যেমন অজাত শিশুকে ধারণ করে, সেইরূপে তােমারই কামনায় ধারণ করে ৷ অধ্বরের অধ্বর্য্য তােমারই জন্যে হে বৃষভ, তােমারই পানার্থে সেই আনন্দপ্রবাহকে ধাবিত করে, তােমারই জন্যে সেই আনন্দকে মার্জিত করে ৷ (৫) ৷

চতুর্থ মণ্ডল – সূক্ত ১

হে তপােদেবতা অগ্নি, তােমাকেই একপ্রাণ দেববৃন্দ উচ্চাশয় কৰ্ম্মধররূপে মানবের অন্তরে প্রেরণ করিয়াছেন, চিন্ময় ক্রিয়াশক্তির আবেশে প্রেরণ করিয়াছেন ৷ হে যজ্ঞকারিন, তাহারাই মৰ্ত্ত মানবের অন্তরে অমর দেবতাকে জন্মাইয়াছেন ৷ যাহার প্রজ্ঞাবলে মানবে দেবতা প্রকাশিত, যে বিশ্বময়ের জ্ঞানসঞ্চারণে দেবতা মানবে বিকশিত, জন্মাইয়াছেন তাহাকে দেববৃন্দ ৷ (১)

হে তপঃ-অগ্নি, সেই তুমি আমাদের ভ্রাতা বরুণকে, যজ্ঞানন্দ বৃহত্তম অনন্তব্যাপীকে পথে প্রবর্তিত কর, মনের সুমতিতে দেবধাম উদ্দেশ্যে মানবের আরােহণ সাধিত কর ৷ (২) ৷

হে কৰ্ম্মনিস্পাদক সখা, যেন বা অশ্বযুগল, যেন বেগবান অশ্বযুগল শীঘ্রগামী রথচক্রকে পথধাবনে প্রবর্তিত করে, সেইরূপে আমাদের যাত্রার্থে এই সখাকে প্রবর্তিত কর ৷ বরুণ সঙ্গী, সব্বজ্যোতিপ্রকাশ মরুদগণ সঙ্গী, খুঁজিয়া লও পরম সুখ ৷ হে ফলদায়িন! পবিত্র জ্বালায় দীপ্ত তপঃ-অগ্নি! যােদ্ধার পথপ্রেরণা পূরণে আত্মপুত্ররূপ দেবতা সৃজনে যে সুখশান্তি অন্তরে সে গঠন কর ৷ (৩) ৷

বরুণ যখন ক্রুদ্ধ, জ্ঞানী তুমি তঁাহার উদ্ধত প্রহারকে অপসারিত কর ৷ যজ্ঞে সমর্থ, কৰ্ম্মধারণে বলবান, পবিত্র দীপ্তি প্রকাশে প্রাণে অশুভ সেনার বিদারক স্পর্শকে দূর কর ৷ (৪) ৷

আমাদের এই উষায়, এই জ্ঞানােদয়ে নিম্নতম পার্থিবভুবনে নামিয়া মানবের অতি নিকট সঙ্গী হইয়া তপঃ-অগ্নির আনন্দ যেন বরুণের গ্রাস ছাড়াইয়া সুখশান্তিতে পহুচিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ সর্বদা আহ্বান শুনিয়া সত্বরে এস হৃদয়ে তপঃ-অগ্নি ৷ (৫)

মৰ্ত্তগণে এই সুখভােগী দেবতার দর্শন শ্রেষ্ঠ চিত্রতম ও শৃহণীয় যেন অবিনাশ্য বিশ্বধাত্রী জগদ্ধের দান-স্রোত, যেন তাহার স্বচ্ছ সুতপ্ত ঘৃত ক্ষরিত হইল ৷ (৬)

এই অগ্নির তিনটী পরম জন্ম আছে, তিনটীই সত্যময়, তিনটীই স্পৃহণীয় ৷ সেই ত্রিবিধরূপে অনন্তের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সঞ্চরণে প্রকাশিত অনন্ত অগ্নি সান্তে আসিয়াছেন ৷ পবিত্র শুভ্র আৰ্য্যকৰ্ম্মা, তাহার দীপ্তি প্রকটিত হইতেছে ৷ (৭)

অগ্নি দূত হইয়া মানবাত্মার বাসভবনরূপ সৰ্ব্ব ভুবনে নিজ কামনা প্রসার করিতেছেন, সৰ্বভুবনে হােতা জ্যোতির্ময় রথে সঞ্চরণ করিয়া আনন্দময় জিহ্বায় সৰ্ববস্তু ভােগ করেন ৷ তাহার অশ্ব রক্তবর্ণ, বপুর মহৎ আলােক সৰ্ব্বত্র বিস্তারিত, সৰ্ব্বদা তিনি আনন্দময় যেন ভােগ্যবস্তু পূর্ণ সভাগৃহ ৷ (৮) ৷

ইনিই মানুষকে জ্ঞানে জাগ্রত করেন, ইনিই মানবযজ্ঞের গ্রন্থি, যেন দীর্ঘ রজ্জ্ব তাহাকে অগ্রসর করিয়া লইয়া যায়, আত্মার এই দ্বারযুক্ত নানা বাসগৃহে তপঃ-অগ্নি সিদ্ধির সাধনে রত হইয়া বাস করেন ৷ দেবতা মৰ্ত্ত মানবের সাধনের উপায়স্বরূপ হইতে স্বীকৃত ৷ (৯)


সপ্তম মণ্ডল – সূক্ত ৭০

হে অশ্বীদ্বয় যাহা যাহা বরণীয়, তােমরাই তাহা দান কর! এস, তােমাদের সে স্বর্গ পৃথিবীতেই ব্যক্ত হইয়াছে ৷ জীবনের অশ্ব সুখময় পৃষ্ট হইয়া সেই স্থানে প্রবৃষ্ট হইয়াছে, সেই স্থান তােমাদের জন্ম ও আশ্রয়স্থান সেই স্থানে তােমরা ধ্রুব স্থিতির জন্যে আরােহণ কর ৷ (১)

ওই সেই তােমাদের আনন্দময়ী সুমতি আমাদের দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করিতেছে, মানুষের এই বহুদ্বারযুক্ত পুরে মনের স্বচ্ছ তপঃ তপ্ত হইয়াছে ৷ সেইই শক্তি সুযুক্ত শ্বেতকিরণময় অশ্বদ্বয় রূপ ধারণ করিয়া আমাদের রথে যােজিত হয় ৷ সমুদ্রসকল, নদীসকল পার করিয়া দেয় ৷ (২) ৷


সপ্তম মণ্ডল – সূক্ত ৭৭

উষাস্তোত্র

তরুণ প্রেয়সী উষার দীপ্তিময় দেহ প্রকাশ হইয়াছে, বিশ্বময় জীবনকে উদ্দেশ্যপথে প্রেরণা করিয়াছেন উষা ৷ তপােদেব অগ্নি মনুষ্যের মধ্যে জ্বলিতে জন্মিয়াছে ৷ উষা সৰ্বরূপ অন্ধকার ঠেলিয়া জ্যোতির সৃজনে কৃতার্থ ৷

মহৎ বিস্তার, নিখিলের দিকে সম্মুখ দৃষ্টি জনি উঠিয়াছেন ৷ পরিধান আলােক-বস্ত্র পরিয়া শুক্ল-তত্ত্বের শ্বেতকায় প্রকাশ করান দেবী ৷ তাঁহার বর্ণ স্বর্গের সােনা, তাঁহার দর্শন পূর্ণদৃষ্টি স্বরূপ, জ্ঞানের রশ্মিফুথের মাতা, জ্ঞানের দিবসের নেত্রী, তাহার আলােকময় দেহ প্রকাশ হইয়াছে ৷

দেবতাদের চক্ষু সূৰ্য্যকে ভােগময়ী বহন করিতে, সেই দৃষ্টিসিদ্ধ শ্বেত প্রাণ-অশ্বকে আনয়ন করিতে, সত্যের কিরণে সুব্যক্ত, দেখা দিয়াছেন দেবী উষা ৷ দেখি নানা দৈব ঐশ্বৰ্য্য, দেখি নিখিলের মধ্যে সদ্ভূতা সর্বত্র সেইই আলােকময়ী ৷

যাহাই আনন্দময় তাহা অন্তরে, যাহাই মনুষ্যের শত্রু তাহা দূরে, এইরূপ তােমার প্রভাত চাই ৷ গঠন কর আমাদের সত্যদীপ্তির অসীম গােচারণ, গঠন কর আমাদের ভয়শূন্য আনন্দভূমি ৷ যাহা দ্বৈত ও দ্বেষময় তাহা দূর কর, মনুষ্য-আত্মার যত ধন বহিয়া এস ৷ হে ঐশ্বৰ্য্যময়ী, আনন্দ ঐশ্বৰ্য্য প্রেরণ কর জীবনে ৷

দেবী উষা, তােমার যে শ্রেষ্ঠ দীপ্তির ক্রীড়া, তাহা লইয়া আমাদের অন্তরে বিকশিত হও, এই দেহীর জীবন বিস্তারিত কর ৷ হে সৰ্বানন্দময়ী, স্থির প্রেরণা দাও, দাও সেই ঐশ্বৰ্য্য যেখানে সত্যের কিরণময় গাভীই ধন, যেখানে জীবনের সেই অনন্তগামী রথ ও অশ্ব ৷

সেই ধনে ধনী বশিষ্ঠ আমরা, – হে সুজাতা, হে স্বৰ্গনন্দিনী, যখন চিন্তাস্রোতে তােমাকে বর্ধিত করি, তুমিও আমাদের অন্তরে ধারণ কর লব্ধ জ্ঞান বৃহৎ সেই আনন্দরাশি ৷


নবম মণ্ডল – সূক্ত ১

দেবমন ইন্দ্রের পানার্থে অভিযুত হইয়া স্বাদুতম মাদকতম ধারায় বহিয়া যাও, সােমদেব ৷ (১)

প্রতিরােধী রাক্ষসের হন্তা সৰ্ব্বকৰ্ম্মা শক্তিধর জ্ঞানবিদ্যুৎ-প্রহৃত জন্মস্থান হইতে ইন্দ্রিয়-আধারে ঢালা হইয়া সিদ্ধিস্থানে আসীন হউক ৷ (২)

বৃত্রের হননকারী, তব ধনের মুক্তহস্ত দাতা তুমি, পরম সুখের বিধাতা হও, ঐশ্বৰ্য্যশালী দেবতাদের ঐশ্বৰ্য্যসুখ আমাদের নিকট পার করিয়া লইয়া এস ৷ (৩)

তব আনন্দসারের বলে মহৎ দেবতা সকলের জন্ম দিতে, ঐশ্বৰ্য্যপূর্ণতা সত্য-শ্রুতির পূর্ণতা সৃষ্টি করিতে যাত্রা কর ৷ (৪)

সেই দেবজন্মই আমাদের গন্তব্যস্থল, তাহারই উদ্দেশ্যে দিনদিন আমরা কৰ্ম্মপথে অগ্রসর হই ৷ হে আনন্দদাতা, তােমাতেই আমাদের সত্যদ্যোতক উক্তিসকল প্রকাশিত হয় ৷ (৫)

জ্ঞানময় সূৰ্য্যদেবের দুহিতা মনপবিত্রের অবিচ্ছিন্ন বিস্তারে তােমার রস গ্রহণ করিয়া পূত করেন ৷ (৬)

যে মানসলােক আমরা পার হইব, সেই দ্যুলােকে মনের সূক্ষ্মশক্তি কৰ্ম্মপ্রয়াসে এই দেবতাকে ধরে ৷ তাহারা দশটী ভগিনী, দেবতার দশটী ভােজ্যা রমণীস্বরূপ ৷ (৭)

এই দেবতাকে অগ্রগামিনী শক্তিসকল পথধাবনে চালাইয়া দেয়, তাহার আধার-পাত্রকে সশব্দে ভরিয়া দেয় ৷ সেই আনন্দমদিরা সৰ্বব্যাপী, তিন পরম তত্ত্বে নির্মিত ৷ (৮)

দেবমন ইন্দ্রের পানার্থে স্বর্গের অহননীয় ধেনুগণ এই শিশু আনন্দকে জ্যোতি-দুগ্ধে মিশ্রিত করে ৷ (৯)

ইহারই মত্ততায় বীর দেবমন যত বিরােধী দানবকে নাশ করে এবং স্বর্গের প্রভূত ধন প্রভূত দানে বিতরণ করে ৷ (১০)


নবম মণ্ডল – সূক্ত ২

দেবত্ব জন্মাইতে মনপবিত্রকে অতিক্রম করিয়া সবেগে বহিয়া যাও, সােমদেব ৷ হে আনন্দ, বিশ্বধনের বর্ষণকারী হইয়া দেবমন ইন্দ্রেতে প্রবেশ কর ৷ (১)

হে আনন্দের দেবতা, অতিশয় জ্যোতির্যক্ত হও বিশ্বধনের বর্ষণকারী বৃষভ তুমি, মহৎ সুখভােগ আমাদের ভিতরে বিকাশ কর ৷ নিজধামে আসীন হও, বিশ্বজীবনকে ধারণ কর ৷ (২)

সুত হইলে এই সৰ্ব্ব বিধাতার আনন্দধারা প্রীতিময় স্বর্গমধু দোহন করিয়া দেয় ৷ ইচ্ছাবলে সিদ্ধ হইয়া ইনি বিশ্বপ্রবাহকে বসনস্বরূপ পরিধান করিলেন ৷ (৩)

সেই মহতী বিশ্বপ্রবাহরূপ স্বৰ্গনদীসকল এই মহানের দিকে ধাবিত হয় যখন জ্যোতি্যুথে আচ্ছাদিত হইতে চান ৷ (৪)

এই যে আনন্দ-সমুদ্র লােকের ধারণকারী ভিত্তিস্বরূপ, সেই প্রবাহে সে মনপবিত্রে পরিমার্জিত হয়, মনপবিত্রে আনন্দদেব মানুষকে চায় ৷ (৫)

জ্যোতির্ময় আনন্দবৃষভ হুঙ্কার ছাড়িয়াছেন ৷ মহান সে, মিত্রের মতাে সৰ্ব্বদর্শী জ্ঞানসূৰ্য্য কিরণে উদ্দীপ্ত ৷ (৬)

হে আনন্দদেব, তােমার কৰ্ম্মেচ্ছুক উক্তিসকল মহাবলে পূত ও মার্জিত হয় যখন তুমি মত্ততা দিতে নিজ শরীরকে শােভমান কর ৷ (৭)

সেই তেজস্বী মত্ততার জন্য আমরা তােমাকে চাই, আমাদের ভিতরে তুমি অতিমানসলােকের স্রষ্টা, তুমি যাহা ব্যক্ত কর, সবই মহৎ ৷ (৮)

সুমধুর মদিরার ধারায় আমাদের জন্যে দেবমন-আকাঙক্ষী হইয়া বর্ষণকারী পৰ্জ্জন্য সাজিয়া ধাবিত হও ৷ (৯)

হে আনন্দদেব, তুমি সেই লােকের জ্যোতির্ময় গাভী, আশু অশ্ব, বীর যােদ্ধা পুরুষ ও পূর্ণ ধন জয় করিয়া আন, সােমদেব, তুমিই যজ্ঞের আদি ও পরম আত্মা ৷ (১০)


নবম মণ্ডল – সূক্ত ১১৩

এই সূক্তে কশ্যপ ঋষি অমরত্বের প্রকাশ্য আনন্দস্বরূপ সােমদেবকে আহ্বান করিয়া সেই মহৎ দেবতার স্তবপূৰ্ব্বক অমরত্ব যাজ্ঞা করিলেন ৷ সূক্তের তত্ত্ব এইরূপ:

আনন্দ সরসীতে সােমরস পান করুন বৃহন্তা ইন্দ্র, সােমপানে করুন আত্মায় বলধারণ, সােমপানে করুন মহৎ বীরকর্মের ইচ্ছা ৷ আনন্দময়! বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (১)

অনন্তদিম্পতি সৰ্ববরদায়ি! ঋজুতার জন্মভূমি হইতে আবহমান এস, সােমদেব! সত্যবলে সত্যবাণীর গর্ভে শ্রদ্ধায় তপস্যায় তুমি সমুদ্ভূত ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (২)

পৰ্জ্জুন্যের সর্বদানে এই মহৎ দেবতা বর্ধিত, সূৰ্য্যদুহিতার সর্বজ্ঞানে এই মহৎ দেবতা আনীত, গন্ধর্বের রসগ্রহণে এই মহৎ দেবতা গৃহীত, গন্ধর্বগ্রহণে সােমরসে সে পরমরস বিহিত ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৩)

সত্যজ্যোতির্ময় তুমি, বাক্যে ব্যক্ত কর সত্যধৰ্ম্ম, সত্যকৰ্ম্মা তুমি, ব্যক্ত কর সত্যসত্তা, আনন্দের রাজা সােমদেব তুমি, বাক্যে ব্যক্ত কর সত্যশ্রদ্ধা ৷ ধাতার হস্তে তােমার নির্দোষ সৃষ্টি, সােমদেব ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৪)

বিশাল উগ্র আনন্দের পূর্ণ নানাবিধ প্রবাহ সত্যসত্তায় সঙ্গম করিতে ধাবিত, মিলনেচ্ছায় রসময়ের অসংখ্য রস পরস্পরে পড়িতেছে ৷ হৃত সত্যমন্ত্রে তুমি পূত, হৃত সত্যমন্ত্রে দ্যুতিমান, হে দেবতা! বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৫)

মনের যে উচ্চ চূড়ায় ছন্দের গতিতে মন্ত্রদ্রষ্টার চিন্তা বাক্যে উদগত, সেইখানে সােমনিঃসারণে সােমরসপ্লাবনে আনন্দের সৃষ্টি, আনন্দে স্বর্গীয় মহিমা ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৬)

যে ধামে অবিনাশ্য জ্যোতি, যে ধামে স্বর্লোক নিহিত, হে আবহমান সােমদেব, সেই ধামে আমাকে তুলিয়া, স্থান দাও অমর অক্ষয় লােকে ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৭)

যে ধামে সূৰ্য্যতনয় ধৰ্ম্মরাজ রাজা, যে ধামে দ্যুলােকের আরােহণীয় সানুর চূড়া, যে ধামে প্রবল বিশ্বনদী সকলের উৎস, সেই ধামে আমাকে অমর করিয়া তােল ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৮)

যে ধামে স্বচ্ছন্দ-বিচরণ দ্যুলােকের ত্রিদিবের স্বর্লোকের ত্রিপুট আনন্দধামে, যে লােকের অধিবাসী আত্মাগণ নিৰ্ম্মল জ্যোতির্ময়, সেই ধামে আমাকে অমর করিয়া তােল ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (৯)

যে ধামে কামনা অতিকামনার নিঃশেষ প্রাপ্তি, যে ধামে মহৎ সত্যের নিবাস-ভূমি, যে ধামে স্বভাবের সকল প্রেরণার তৃপ্তি, স্বপ্রকৃতি পূর্ণ, সেই ধামে আমাকে অমর করিয়া তােল ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (১০)

যে ধামে সকল আনন্দ সকল প্রমােদ, যে ধামে সকল প্রীতি সকল সুখক্রীড়া চিরতরে আসীন, যে ধামে কামের সর্বকামনার নির্দোষ সুখাস্বাদন, সেই ধামে আমাকে অমর করিয়া তােল ৷ বিশাল প্রবাহে বহিয়া ইন্দ্রকে প্লাবিত কর ৷ (১১)


দশম মণ্ডল – সূক্ত ১০৮

হৃদয়ে কি বাসনা, সরমে? কেন এই দেশে আগমন? দূর সেই পন্থা, পরমশক্তিতে প্রকাশিত ৷ আমাদের নিকটে কি আশা, কি প্রেরণা? পথে কি গভীর বাণী? অতল রসা-নদীর তরঙ্গ কোন রঙ্গে পার হইলি, সরমে? (১)

ইন্দ্রের দূতি আমি ইন্দ্রের প্রেরণায় বিচরণ করিতেছি তােমাদের সুবিশাল গুপ্তনিধির বাসনায়, পণিগণ ৷ উল্লংঘনের ভয়ে রাত্রী সরিল ৷ রসানদীর তরঙ্গমালা পার হইলাম উল্লম্ফনে ৷ (২)

কিরূপ সেই ইন্দ্র, সরমে? কি বা তাহার দৃষ্টিবল যাহার দৌত্যকাৰ্য্যে জগতের চূড়া হইতে এই দেশে আসিলি? আসুন সে দেবতা, করিব তাহাকে সখা, করিব জ্যোতির্ময় গােফুথের গােপতি ৷ (৩)

কাহারও না বিজিত কখন ইন্দ্র,...2যাহার দৌত্যকার্যে জগতের চূড়া হইতে এই দেশে আসিলাম! সুগভীর অবহমান নদীসকল তরঙ্গে গুপ্ত করেন না ৷ (৪)









Let us co-create the website.

Share your feedback. Help us improve. Or ask a question.

Image Description
Connect for updates